বৈরুতে ট্র্যাজেডির মূলে রাশিয়ার ব্যবসায়ীর রাসায়নিক

বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডে পুরো বন্দর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বৈরুত বন্দরের ছবিটি গতকাল ড্রোন থেকে তোলা।  রয়টার্স
বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ডে পুরো বন্দর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বৈরুত বন্দরের ছবিটি গতকাল ড্রোন থেকে তোলা। রয়টার্স

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে বিশাল বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত চলছে। তবে কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই এই বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, স্থানীয় কর্মকর্তাদের সতর্কতার পরও কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে বছরের পর বছর ওই বন্দরে ভেড়ানো একটি রুশ জাহাজই এই বিস্ফোরণের কারণ। ওই রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন। 

গত মঙ্গলবারের ওই বিস্ফোরণের বিষয়ে নতুন নথি পেয়েছে সিএনএন। নথির তথ্যমতে, ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে রাশিয়ার এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এমভি রোসাস নামের একটি জাহাজ ২০১৩ সালে পোর্ট অব বৈরুত বন্দরে এসে আটকা পড়ে। জাহাজটির গন্তব্যস্থল ছিল মোজাম্বিক। রুশ ও ইউক্রেনের ক্রুদের সঙ্গে জাহাজের মালিকের দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের জন্যই বৈরুতে এসে থেমে যায় জাহাজটি, যা আর যাত্রা শুরু করতে পারেনি।

লেবাননের শুল্ক বিভাগের পরিচালক বাদরি দাহারের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে থামার পর আর কখনো বন্দর ত্যাগ করেনি জাহাজটি। বাদরি ও অন্য কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার পণ্যবাহী জাহাজটি ‘ভাসমান বোমা’ হিসেবে অভিহিত করে সতর্ক করলেও জাহাজটি নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়নি।

বিস্ফোরক দ্রব্যবোঝাই জাহাজটির অবস্থানের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এই মামলা পরিচালনা করা এক বিচারকের কাছে ২০১৬ সালে চিঠি লেখেন বাদরির পূর্বসূরি ছফিক মেরহি। সেখানে তিনি লেখেন, ‘অনুপযুক্ত আবহাওয়ায় এই পণ্য মজুত করে রাখায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এর কাজ সচল রাখতে অবিলম্বে এই পণ্যগুলো পুনরায় রপ্তানি করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে আবারও অনুরোধ করেছি।’ 

ওই বিস্ফোরণের সূত্র হিসেবে এমভি রোসাসের নাম সরাসরি উল্লেখ করেনি লেবাননের কর্তৃপক্ষ। তবে প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এই বিপর্যয়কর বিস্ফোরণের কারণ। তিনি বলেন, কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই ওই রাসায়নিক পদার্থ ছয় বছর ধরে বন্দরের গুদামে পড়েছিল।

জননিরাপত্তা বিভাগের প্রধানও বলেছেন, উচ্চমাত্রায় বিস্ফোরক পদার্থগুলো কয়েক বছর আগে বাজেয়াপ্ত করে তা বন্দরের গুদামে রাখা হয়েছিল।

এই বিস্ফোরক পদার্থ জানমালের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে, এমন উদ্বেগ থাকায় বিষয়টি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার চিঠি ও নথি চালাচালি হয়। 

এমভি রোসাসের ক্যাপ্টেন ছিলেন বরিস প্রোকোশেভ। জাহাজ চলাচলের বিষয়ে তাঁর দেওয়া দিকনির্দেশনামূলক তথ্যমতে, ২০১৩ সালে জর্জিয়ার বাতুমি থেকে যাত্রা করে করে। গন্তব্য ছিল আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক। জাহাজে ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল। এটি সাধারণত সার তৈরিতে কারখানাগুলোতে ব্যবহার করা হয়। মলদোভার পাতাকাবাহী জাহাজে পুনরায় জ্বালানি ভরার জন্য গ্রিসের একটি বন্দরে থামে। তখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাবিকদের জাহাজের রুশ মালিক বলেন, তাঁর আর অর্থ নেই। তাই জাহাজের ভ্রমণ খরচ মেটাতে তাঁদের আরও পণ্য তুলতে হবে। আর সে জন্য যেতে হবে বৈরুতের বন্দরে। জাহাজটি টেটো শিপিং নামের একটি কোম্পানির। জাহাজের নাবিকেরা বলেছেন, ওই কোম্পানির মালিক রাশিয়ার ব্যবসায়ী ইগর গ্রেচুশকিন, যিনি বর্তমানে সাইপ্রাসে থাকেন। 

রাশিয়ার নাবিকদের সংগঠন এসইউআরের তথ্যমতে, একসময় বৈরুতে এসে পৌঁছায় জাহাজটি। কিন্তু চলাচল নীতিমালা লঙ্ঘন, বন্দরের ফি পরিশোধ না করায় স্থানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজটি আটক করে। জাহাজের ক্রুদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। কিন্তু এরপর থেকে জাহাজটি আর কোথাও যাত্রা শুরু করতে পারেনি। 

প্রোকোশেভ বুধবার রুশ রেডিও ইকো মস্কোকে  বলেন, ‘নাবিকেরা সামান্য খাবার খেয়ে ১১ মাস ওই জাহাজে ছিলেন। জাহাজটি যাতে ছেড়ে দেয়, সে জন্য আমি প্রতিদিনই পুতিনের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) কাছে চিঠি লিখতাম। আমাদের কেউ সাহায্য করেননি। এমনকি মালিক আমাদের খাবার–পানি দিয়েও সাহায্য করেননি।’ এসইউআরের তথ্যমতে, একপর্যায়ে জাহাজটি ত্যাগ করতে শুরু করেন নাবিকেরা। পরে  জাহাজ ভাসমান রেখেই তাঁরা নিজ দেশে ফিরে আসেন।

এদিকে বন্দরে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলাকালে তাঁদের গৃহবন্দী করা হলো। এই বিস্ফোরণের জন্য সরকারের অবহেলাকে দায়ী করছে সাধারণ মানুষ।