ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে লেবানন

বিস্ফোরণের পর বিধ্বস্ত বৈরুত।  ছবি: এএফপি
বিস্ফোরণের পর বিধ্বস্ত বৈরুত। ছবি: এএফপি

গত ৪ আগস্ট ব্যাপক মাত্রার একটি বিস্ফোরণেই একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। দেশটির বাসিন্দাদের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃস্বপ্নের দিন এর আগে আসেনি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীর বন্দরে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটকে যথাযথভাবে গুদামজাত করে না রাখাকে এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করছেন কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণে দেড় শতাধিক নিহত ও ৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা আর শব্দতরঙ্গের তীব্রতায় নগরজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু ভবন।

ছাই–ভস্মের ভেতর থেকে কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, বৈরুত নগরের তা জানা আছে। বলা হয়ে থাকে, এই শহর তার ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে সাতবার ধ্বংস ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। অতীতে এ নগরের ওপর দিয়ে যত যুদ্ধ, আগ্রাসন বা ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা ঘটেছে, সাম্প্রতিকতম বিপর্যয় যেন এগুলোর সব ছাপিয়ে গেছে। এর কারণ সম্ভবত এটি বাইরের কোনো বৈরী শক্তি বা প্রাকৃতিক ঘটনার ফল নয়, নিজ দেশের ক্ষমতাসীন অভিজাতদের ডেকে আনা বিপর্যয় এটি।

বৈরুতের বেসামরিক বন্দরে বেপরোয়াভাবে সাত বছর আগে ফেলে রাখা অত্যন্ত বিস্ফোরক উপাদানে পূর্ণ কার্গো জাহাজে প্রথম কীভাবে আগুন লাগল, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে যা–ই ঘটুক, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে মঙ্গলবারের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। লেবাননের রাষ্ট্রীয় শক্তির গভীরে যে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অবহেলা শিকড় গেড়ে বসেছে, এটা তারই সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ফলাফল।

প্রকৃত কোনো রকমের সরকারি নজরদারি ছাড়াই সচল ছিল বৈরুত বন্দর। এটির যৌথ ব্যবস্থাপনায় ছিল শুল্ক বিভাগ ও বৈরুত বন্দর কর্তৃপক্ষ। শুল্ক কর্তৃপক্ষ লেবাননের প্রেসিডেন্ট মাইকেল আউনের অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে। আর পরেরটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির সমর্থক আমলা পরিবেষ্টিত। কাগজে–কলমে এই উভয় সরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে আছে ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু বাস্তবে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে নেই দায়িত্ব ও ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক শ্রেণিবিন্যাস বা পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ।

লেবানন দীর্ঘদিন ধরে তার ভঙ্গুর অর্থনীতি, নাজুক রাজনৈতিক অবস্থা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখতে যে লড়াই–সংগ্রাম চালাচ্ছে, এই বিস্ফোরণ তাতেও এক ভয়ানক প্রভাব ফেলতে চলেছে। বিস্ফোরণে বাড়িঘর হারানো ৩ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া ও বিস্ফোরণ–পরবর্তী সময়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অঙ্কের অর্থের সংস্থান সরকার করতে পারবে কি না, তা–ও পরিষ্কার নয়।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও জনরোষের সঙ্গে এখন ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে লেবাননের অভ্যন্তরে থাকা বিদেশি শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা। এটি লেবানন সরকারকে আরও দুর্বল করবে ও বিরাজমান দেশীয় রাজনৈতিক উত্তেজনায় ঘি ঢালবে। প্রধানমন্ত্রী হাসান দায়েব ও তাঁর সমর্থকেরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির প্রভাব কমানোর চেষ্টায় বিস্ফোরণের ঘটনাকে ব্যবহার করতে চাইবেন। বিপরীতে হারিরি দ্রুজ নেতা ওয়ালিদ জামব্লাতকে নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রচারণা গতিশীল করার চেষ্টা চালাতে পারেন। লেবাননের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও বসে থাকবে না। তারাও এই রাজনৈতিক উত্তেজনাকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালাবে।

আজ লেবাননের জনগণ নজিরবিহীন শোকাবহ ঘটনার মুখোমুখি। মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি সীমিত সম্পদ দিয়ে করোনাভাইরাস মহামারিকে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। এখন তাঁদের সামনে হাজার হাজার আহত মানুষকে সারিয়ে তোলা, রাজধানী ও দেশের প্রধান বন্দরকে পুনর্গঠনের মতো বিশাল কাজ বাকি। যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন, তাতে তাঁদের ভেতরে কাজ করছে হতাশা ও ক্লান্তির অনুভূতি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা লেবাননের দরকার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের উঁচু শ্রেণির মানুষ, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁরা যেন এই সহায়তাকে জনরোষ থেকে নিজেদের বাঁচানোর হাতিয়ার না বানান, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও দৃশ্যত মনে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিস্ফোরণকে নিতান্তই বৈরুতের এক মানবিক সংকট হিসেবে দেখছে। বর্তমান সংকটের পেছনে লেবাননের রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুলে সহায়তা করলে তাতে জনগণের উপকার নয়, প্রকারান্তরে ক্ষতিই হবে। এতে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী শ্রেণির মানুষেরা জবাবদিহি ও দায়দায়িত্ব এড়ানো, দেশে অবকাঠামোগত সংস্কারকাজ বাস্তবায়ন না করার আরেক সুযোগ পাবে।

কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি লেবাননবাসীকে প্রকৃতই সহায়তা করতে চায়, তবে শুধু সহায়তা পাঠালেই হবে না। তাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে বৈরুতে ৪ আগস্ট যা ঘটেছে, তা অবহেলা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীকে ধ্বংস ও জনগণকে মেরে ফেলে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সরকারের চেষ্টার নামান্তর।