জো বাইডেন-কামালা জুটি ভারতকে চিন্তায় ফেলছে

নিজেদের প্রথম যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জো বাইডেন ও কামালা হ্যারিস। গত বুধবার ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে।  ছবি: এএফপি
নিজেদের প্রথম যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জো বাইডেন ও কামালা হ্যারিস। গত বুধবার ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন-কামালা হ্যারিস জুটি কিছুটা হলেও ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের চিন্তা বাড়িয়েছে। যদিও দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকের একটি অংশের ধারণা, আগামী নভেম্বরের ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হলে এই দুই ডেমোক্র্যাট জুটি ‘রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের আলোয় চলমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নিরীক্ষণ করবেন।’

গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন আফ্রিকান-আমেরিকান ও ভারতীয়-আমেরিকান সিনেটর কামালা হ্যারিসকে ‘রানিং মেট’ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। গত মঙ্গলবার তিনি নিজেই বলেন, ‘দারুণ খবর! কামালা হ্যারিসকে আমি রানিং মেট হিসেবে বেছে নিয়েছি।’

ওই ঘোষণা এবং সাম্প্রতিক জরিপের নিরিখ, যা বাইডেনের সম্ভাব্য জয়ের ইঙ্গিতবাহী, নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভ্রুকুঞ্চনের কারণ। জুটি হিসেবে বাইডেন-কামালার ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। ভোটে তার প্রতিফলন ঘটলে চার বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির যে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল, তা আর কতটা ফলদায়ী হবে, সেটাই প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে
নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে বাইডেন-কামালা জুটির সঙ্গে। ভ্রুকুঞ্চনের দ্বিতীয় কারণ, কাশ্মীর নীতি ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে বাইডেন ও কামালা দুজনের মনোভাবই যথেষ্ট কঠোর। দুজনেই এই দুই বিষয়ে দ্বিধাহীনভাবে সরব।

কদিন আগেই জো বাইডেন ভারতের সাম্প্রতিক কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করেছেন এবং পাকিস্তানকে তা উৎসাহিত করেছে। পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকান-পাকিস্তানি পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির প্রধান ইজাজ আহমেদ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে এক অনলাইন আলোচনায় বসেন বাইডেন। সেই আলোচনায় তিনি বলেন, অধিকৃত উপত্যকার মানুষজনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সব ধরনের বন্দোবস্ত মোদি সরকারের করা দরকার। তিনি বলেন, বিক্ষোভ দেখানো নিষিদ্ধ করা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে বাধা সৃষ্টি করা, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা বা গতি শ্লথ করা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।

শুধু ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করাই নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অত্যাচারিত ও বিতাড়িত মানুষজনের জন্য মোদি সরকারের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনেরও সমালোচনা করেছেন বাইডেন। ওই বিষয়ে তাঁর মনোভাবের কথা তিনি একাধিকবার প্রকাশও করেছেন। ওই বৈঠকে ইজাজ আহমেদ মুসলিম আমেরিকানদের সমর্থন বাইডেনের পক্ষে নিশ্চিত করেন।

বাইডেনের মতো কামালা হ্যারিসও মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতির ঘোর সমালোচক। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডিকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘কাশ্মীরিদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই পৃথিবীতে তাঁরা একাকী নন। আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। প্রয়োজন হলে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’

সম্ভবত সে কারণেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে হিউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে হ্যারিস যোগ দেননি। পরের মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মার্কিন হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে দেন। কারণ, ভারতীয়-আমেরিকান কংগ্রেস সদস্য প্রমীলা জয়পাল কাশ্মীর পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য প্রস্তাব রেখেছিলেন। কামালা হ্যারিস সেই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জয়পালের সঙ্গে। আমি খুশি জয়পালের সতীর্থরাও তাঁরই সঙ্গে। সদস্যরা কী আলোচনা করবেন, তা ঠিক করার কোনো অধিকার কোনো বিদেশি সরকারের থাকতে পারে না।’

বাইডেন-কামালা জুটি নভেম্বরে ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে মোদি সরকারকে নতুনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। যদিও দুই সাবেক কূটনীতিক মনে করছেন, তাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুব একটা অসুবিধা হওয়া উচিত নয়। বীণা সিক্রি গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক, কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন দুটোই মোদির সরকারের আদর্শগত বিষয়। দুটি বিষয়েই সরকারের অবস্থানও নীতিগত। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলে নতুন সরকারকে তার অবস্থান নতুন আলোয় খতিয়ে দেখতে হবে। নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অবস্থান একটু বদলাবে হয়তো। সম্পর্ক মেরামতের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন রণেন সেন। বাইডেন-কামালা জুটি ক্ষমতাসীন হলে ভারতের কাশ্মীর নীতিতে কোনো প্রতিফলন ঘটবে কি না জানতে চাওয়া হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একটু অসুবিধা হয়তো হবে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সার্বিক বিবেচনায় গড়ে ওঠে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ইতিবাচক দিক দুই দেশের গণতন্ত্র। দুই গণতন্ত্রের কাঠামোও যুক্তরাষ্ট্রীয়। তা ছাড়া ভারতীয় গণতন্ত্রের যে দিকটা মার্কিনদের আগ্রহের কারণ তা হলো, স্থিতিশীলতা। এ ছাড়া বিবেচনায় থাকার কথা ভারতীয় অর্থনীতির অগ্রসরতা। কাশ্মীর বা নাগরিকত্ব আইন সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা গ্রহণের আগে এসব বিষয় অবশ্যই বিবেচিত হবে।’ রণেন সেন বলেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী ভারতের অবস্থানও যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে অবশ্যই থাকবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি।