কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ইবোলা?

এভাবে নিজেদের আপাদমস্তক ঢেকে ইবোলা রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তা দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা
এভাবে নিজেদের আপাদমস্তক ঢেকে ইবোলা রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তা দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা

পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাণঘাতী ইবোলা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তাতে বিশ্ববাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আট হাজারেরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
পশ্চিম আফ্রিকা ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ইবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। ইবোলায় আক্রান্ত প্রথম মার্কিন নাগরিক টমাস এরিক ডানকান গত বুধবার টেক্সাসের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। সপরিবারে লাইবেরিয়া ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরার প্রায় দুই সপ্তাহ পর তাঁর শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি ধরা পড়ে। ইতিমধ্যে স্পেনের একজন নার্স আফ্রিকার বাইরে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে প্রথম ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ইউরোপে যাওয়া ইবোলা-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তা করতেন।
মার্কিন ও স্প্যানিশ এই দুই ব্যক্তির শরীরে ইবোলা সংক্রমণের ঘটনায় ভাইরাসটি আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ার মতো বিপজ্জনক আশঙ্কার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় থাকা সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া ও গিনিতে ভাইরাসটি সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছে। আক্রান্ত রোগীদের প্রায় অর্ধেকেরই মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা কাগজপত্রে তিন হাজার ৮৫৭ জন হলেও ধারণা করা হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। সাহায্য সংস্থাগুলো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, চলতি মাসের শেষ নাগাদ রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ভয়ংকর ইবোলা ভাইরাসটি অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এটি অন্যান্য ভাইরাসের মতো সহজে ছড়িয়ে পড়ে না। আক্রান্ত রোগীদের আলাদা করে বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা করলে এটি আর ছড়িয়ে পড়তে পারে না। কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে এ ধরনের পরিচর্যা বা সেবার সুবিধা পশ্চিম আফ্রিকায় নেই বললেই চলে। দশকের পর দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ওই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার মান ইতিমধ্যে নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে ইবোলা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, লাইবেরিয়ায় ইবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য যেখানে প্রয়োজন দুই হাজার ৯৩০টি শয্যা, সেখানে রয়েছে মাত্র ৬২১টি। আর সিয়েরা লিওনে প্রয়োজনীয় এক হাজার ১৪৮টি শয্যার বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৩০৪টি।
ইবোলা নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার জন্য বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাদী শক্তিগুলোও দায়ী। ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে পুঁজিবাদী শক্তিগুলো সহায়তার নামে যা করছে, তাকে নির্লজ্জ ভান ছাড়া আর কী বলা যায়? ইবোলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ সামরিক আগ্রাসনের জন্য তারা খরচ করছে শত শত কোটি ডলার।
আসলে, ইবোলায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের ছলে সাবেক উপনিবেশ দেশগুলোয় পঁুজিবাদী দেশগুলো সামরিক অভিযান জোরদার করার সুযোগ নিচ্ছে। লাইবেরিয়ায় ইবোলা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে তিন হাজার সেনা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আসলে দেশটি আফ্রিকা অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন ও গিনি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় থাকলেও নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। দেশগুলো আজও তাদের সাবেক উপনিবেশিক প্রভুদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহের উৎস, যেমনটা তারা ১০০ বছর আগে ছিল। গিনিতে ফ্রান্সের উপনিবেশিক দখলদারি বজায় ছিল ১৮৯৮ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে সেখানে কলা চাষ, কফি বিন, আনারস, পাম তেল ও চিনাবাদাম চাষ করে ফরাসিরা বিপুল মুনাফা তুলে নেয়। বর্তমানে বিশ্বে বক্সাইটের ২৫ শতাংশ মজুত রয়েছে গিনিতে।
বিশ্বের হীরার প্রধান উৎস হচ্ছে সিয়েরা লিওন। দেশটি ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রাবার উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে লাইবেরিয়া। দেশটি ১৮২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ও একমাত্র উপনিবেশ হিসেবে। ১৮৪৬ সালে দেশটি নামে স্বাধীন হলেও কার্যত ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেখানকার সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় আফ্রিকীয় মার্কিনদের হাতে।
দেশগুলো ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও সাবেক উপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য সেখানকার গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দেয়। সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়া ১৯৮৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আসলে গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিয়নের এসব সম্পদের প্রতি লোভ পশ্চিমাদের। ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেয়ে এসব সম্পদ বাগানোই তাদের লক্ষ্য, যে ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।