নোবেলে শান্তি সন্ধান

মালালা ইউসুফজাই
মালালা ইউসুফজাই

চির বৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান। তাদের বিরোধপূর্ণ সীমান্তে চরম উত্তেজনা, গোলাগুলি, বারুদের ঝাঁজাল গন্ধ। উভয় পক্ষে প্রায় এক কুড়ি প্রাণহানির মধ্যেই নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই ও ভারতের কৈলাস সত্যার্থীকে যৌথভাবে চলতি বছর শান্তিতে নোবেল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকের এখন প্রশ্ন, এই নোবেল পুরস্কার দেশ দুটির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা রাখবে? জবাব দেওয়াটা বেশ কঠিন।
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার বৈরিতার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকেই তাদের মধ্যে সীমান্তসহ নানা বিষয়ে চরম বিরোধ ও মতপার্থক্য বিরাজ করছে। তারা একাধিক যুদ্ধেও জড়িয়েছে। শত চেষ্টায়ও দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা টানা সংঘর্ষে ভারতের অন্তত আটজন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের ১২ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছে। পরিস্থিতি আপাতত কিছুটা শান্ত। তবে দুপক্ষের মধ্যে আরও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভারতের পক্ষ থেকে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, সীমান্তে গুলি ছুড়ে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তান। এ জন্য দেশটিকে চরম মূল্য দিতে হবে। জানমালের ক্ষতি স্বীকার করে হলেও পাকিস্তানকে উচিত জবাব দিতে ভারত পিছ-পা হবে না বলেও শোনা যাচ্ছে।
প্রতিপক্ষকে শাসাতে পাকিস্তানও কম যায়নি। অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের জন্য উল্টো ভারতকেই দুষছে ইসলামাবাদ। একই সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে উভয় দেশই অবগত। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দুই দেশের নেতাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলার যেকোনো চেষ্টার জবাব পূর্ণ শক্তিতেই দেবে ইসলামাবাদ। সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী প্রস্তুত।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বৈরিতার এই গুরুতর নাজুক পর্যায়ে মালালা ও কৈলাসের যৌথভাবে শান্তির নোবেলপ্রাপ্তি অনেকের কাছে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, এই পুরস্কারের সুবাদে বরফ গলবে। দুই দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী হবে। অন্তত নোবেল কমিটি তেমনটা ভাবতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো শুভ লক্ষণ দেখা যায়নি।
মালালা ও কৈলাস যৌথভাবে শান্তির নোবেল পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁদের অবদানের ক্ষেত্র শিশু, শিক্ষা ও শৈশব। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ঐতিহাসিক সংঘাত বন্ধে তাঁরা কোনো অবদান রাখেননি। তাই দেশ দুটির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই পুরস্কার খুব একটা কাজে দেবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ নেই।
১৭ বছর বয়সী মালালা নারীশিক্ষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার এই কিশোরী তালেবানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মেয়েদের শিক্ষালাভের অধিকারের পক্ষে কাজ করায় ২০১২ সালের অক্টোবরে তার মাথায় গুলি করে জঙ্গিরা। যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠে সে। এখন বার্মিংহামে থেকে পড়ালেখা করছে মালালা। তার আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত টাইম সাময়িকীর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তার নাম উঠেছে। অনেক সম্মানজনক পুরস্কার তার ঝুলিতে জমা হয়েছে। বিশ্বের কাছে নারীশিক্ষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এই কিশোরী।

কৈলাস সত্যার্থী
কৈলাস সত্যার্থী

৬০ বছর বয়সী কৈলাস কাজ করেন শিশু অধিকার নিয়ে। তিনি ২৬ বছর বয়সে শিশু অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বাচপান (শৈশব) বাঁচাও আন্দোলন’ নামের সংস্থাটি শিশুশ্রম নিরসন, শিশু অধিকার আদায় ও মানব পাচার অবসানের লক্ষ্যে কাজ করে। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের ৮০ হাজার শিশু শ্রম-দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর এই অনুসারী বৈশ্বিক শিক্ষা অভিযান ও শিশুশ্রমবিরোধী বৈশ্বিক পদযাত্রারও প্রধান।
নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির কাছ থেকে গত সপ্তাহে মালালা ও কৈলাসকে যৌথভাবে শান্তির পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাটি আসে। কমিটি বলে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষার জন্য ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে একই লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন একজন মুসলিম ও একজন হিন্দু, একজন পাকিস্তানি ও একজন ভারতীয়।
মালালা ও কৈলাস নোবেল পাওয়ার পর গণমাধ্যমে যেসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক।
শান্তিতে নোবেল গ্রহণের উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এক ছাদের নিচে মিলিত করার ভাবনা মালালার। সেই ভাবনা থেকেই লন্ডনে গণমাধ্যমকে মালালা বলেছে, ‘আমাদের পুরস্কার নেওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
দুই দেশের সীমান্তের সর্বশেষ পরিস্থিতিও মালালার নজর এড়ায়নি। এ প্রসঙ্গে এই কিশোরী বলেছে, ‘পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য আমরা লড়াই করতে চাই।’
শান্তির জন্য কৈলাসও উন্মুখ। তিনি মালালাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
মালালার উদ্দেশে কৈলাসের উদার আহ্বান, ‘চলো, আমরা শান্তির জন্য হাত মেলাই।’
মালালার সঙ্গে নোবেল ভাগাভাগির বিষয়টি শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুই দেশকে উৎসাহিত করবে বলে এনডিটিভির কাছে মত ব্যক্ত করেছেন কৈলাস। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে সময় লাগবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এর আগে আরও অনেকে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ও এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক (১৯৯৩) কিংবা উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন হিউম ও ডেভিড ট্রিমবেলের (১৯৯৮) কথা বলা যায়। দীর্ঘ সংঘাত অবসানে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের ওই পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু মালালা-কৈলাসের অবদান ভিন্ন। জন্ম থেকে এ অবধি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলা সংঘাত নিরসনে তাঁদের কোনো অবদান নেই। কাজের ধরনের (নারীশিক্ষা ও শিশু অধিকার) কারণে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে তাঁরা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন বলেও খুব একটা আশাবাদী হওয়া যায় না।
এখন দ্বিপক্ষীয় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি দুই দেশের অন্য কোনো জুটি শুরু করতে পারেন। সেই উদ্যোগ সফল হলে শান্তিতে নোবেল ভাগাভাগির আরেকটি ঘোষণা প্রত্যাশা করাই যায়।