সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার এটাই সময়

রক্তাক্ত পেশোয়ার
রক্তাক্ত পেশোয়ার

মাত্র এক সপ্তাহ আগে নরওয়ে গিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে এলেন মালালা ইউসুফজাই ও কৈলাস সত্যার্থী। ঘটনাটা উদ্যাপন করা হলো উপমহাদেশজুড়েই। একই দিন সন্ধ্যায় মালালা অসলো থেকে আমাকে এবং এনডিটিভির বারখা দত্তকে একটি সাক্ষাৎকার দেয়। সে জানায়, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সে পাকিস্তানে ফিরে আসবে। পাকিস্তানে আরও স্কুল বানাবে।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) মালালার এ ঘোষণায় ক্ষুব্ধ ছিল। তারা একই দিন সন্ধ্যায় একটি বিবৃতি দিয়ে হুমকি দেয়, যারা মালালার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি উদ্যাপন করবে, তাদের ওপর হামলা চালানো হবে। এক সপ্তাহের ভেতরেই তারা পাকিস্তানিদের আনন্দকে প্রচণ্ড দুঃখ ও শোকে রূপান্তরিত করে দিল। টিটিপি ১৬ ডিসেম্বর সকালে পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে হামলা চালাল। এতে ঝরে গেল ১৩২ শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষকদের প্রাণ।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি কালো দিন। স্কুলপড়ুয়া ১৩২ জন শিক্ষার্থীর এই আত্মদানের ঘটনায় ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও বিরোধী নেতা ইমরান খান তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গেলেন। ইমরান খান রাজধানী ইসলামাবাদে তাঁর ১৮ ডিসেম্বরের আন্দোলন কর্মসূচি বাতিল করেছেন, ছুটে গেছেন পেশোয়ারে। ২০১৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এই শহর থেকেই নির্বাচিত হন ইমরান খান। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের লোকজন তাঁর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলকে ম্যান্ডেট দেন এ আশায় যে তিনি তাঁদের শান্তি দেবেন। শান্তির এই স্বপ্ন কখনোই সত্যি হয়নি। ২০১৪ সালের জুনে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে টিটিপির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। সেই অভিযানকে সমর্থন করার পরিবর্তে নওয়াজ শরিফের নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আন্দোলনে নামেন ইমরান খান। সঙ্গে ছিলেন তাহির উল-কাদরি।
ইমরান খানের ওই আন্দোলন বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করে। কারণ, ইসলামাবাদের নির্বাচিত সরকার সন্দেহ করছিল, পার্লামেন্ট ভবনের সামনে পিটিআইয়ের অবস্থান ধর্মঘটের পেছনে কিছু সাবেক ও বর্তমান গোয়েন্দা কর্মকর্তার ইন্ধন ছিল। এ আন্দোলন নওয়াজ শরিফকে দুর্বল করে দেয়। পক্ষান্তরে পিটিআই আত্মপ্রকাশ করে আন্দোলনের সুবিধাভোগী হিসেবে। টিটিপি গত ২ নভেম্বর লাহোরের কাছে ওয়াগা সীমান্তে একটি জনসভায় হামলা চালায়। সেখানে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর হাতে প্রাণ দেয় ৫৫ ব্যক্তি। এই ট্র্যাজেডিও দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ পেশোয়ারে ১৩২ জন স্কুলশিশুর মৃত্যু রাজনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য ভুলে যেতে বাধ্য করল।
প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ পেশোয়ারে আজ একটি জরুরি সভা ডেকেছেন। সেখানে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব থাকা সব রাজনৈতিক দলের প্রধানদের উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। এটা হবে ছোটখাটো একটা সর্বদলীয় সম্মেলন। সেখানে নওয়াজ টিটিপির বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করবেন।


পাকিস্তানের জনগণের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানা খুবই দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, নিরাপত্তা বাহিনী কেন এমন একটি স্কুলকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলো, যেটি পেশোয়ারে মার্কিন কনস্যুলেট ও গভর্নর হাউসের একেবারে কাছে অবস্থিত? আর্মি পাবলিক স্কুলটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত। ওই স্কুলের চারপাশে অনেকগুলো তল্লাশিচৌকি রয়েছে। সন্ত্রাসীরা পার্লামেন্টারি বাহিনীর উর্দি পরে এতগুলো নিরাপত্তাচৌকিকে কীভাবে ধোঁকা দিল? কিছু সূত্র বলছে, ১৬ ডিসেম্বর পেশোয়ারে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারকে আগেই সতর্ক করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাহলে ১৬ ডিসেম্বর উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে প্রাদেশিক সরকার কেন ব্যর্থ হলো? এটা কি একটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা, না খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পিটিআই সরকারের ব্যর্থতা?
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, কাপুরুষোচিত এ হামলা আসলে সামরিক অভিযানের সফলতার একটা জবাব, যে অভিযান ছয় মাস আগে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে শুরু হয়েছিল। এ অভিযান যদি সফলই হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরা কীভাবে পেশোয়ারের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকায় ভয়াবহ হামলা চালাতে সক্ষম হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান, না সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলকে এককাট্টা হওয়ার এটাই সময় এবং সেনাবাহিনীকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ কৌশল অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২৫৬ অনুচ্ছেদকে তার সত্যিকারের মর্মকথা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। পাকিস্তানের কোনো অংশেই কোনো ব্যক্তিগত মিলিশিয়া বাহিনীকে কর্মকাণ্ড চালাতে দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসবাদ আমদানি বা রপ্তানির জন্য পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক হবে না। এই ট্র্যাজেডিকে আমাদের সবার চোখ খুলে দেওয়ার একটা উপলক্ষ হওয়া উচিত। আসুন, সবাই ঐক্যবদ্ধ হই এবং এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমরা যদি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখি, তাহলে তা হবে সন্ত্রাসীদের হাতগুলোকেই শক্তিশালী করা।
হামিদ মির, পাকিস্তানের জিয়ো টেলিভিশনের নির্বাহী সম্পাদক