নিষিদ্ধ কবিতার আসরে

আসরে প্রেমের কবিতা পড়ছেন নাদিয়া l এএফপি
আসরে প্রেমের কবিতা পড়ছেন নাদিয়া l এএফপি

‘প্রিয়তম বিহনে সারা রাত পুড়ি আর জ্বলি
আমি এক মোমের বাতি, নীরবেই পুড়ি আর গলি’
আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরের একটি গোপন কবিতা পাঠের আসরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পশতু ভাষায় নিজের লেখা এই লান্দে পড়ছিলেন ২০ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী নাদিয়া।
লান্দে হচ্ছে প্রেম-বিষয়ক দুই লাইনে লেখা বিশেষ ঘরানার অণুকাব্য—অনেকটা তিন লাইনের জাপানি হাইকুর মতো। ওই কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন নারী কবি। তাঁরা এমন এক ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠ করছিলেন, যার খবর তালেবানের কানে গেলে তাঁরা খুনও হতে পারেন। এই ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়টির নাম ‘প্রেম’!
ঐতিহ্যবাহী পশতুন লোককাব্যের অনন্য এক ঘরানার নাম ‘লান্দে’। সাধারণত এই কাব্যের বিষয়বস্তু নারী ও পুরুষের শাশ্বত প্রেম। রাজধানী কাবুলে বেশ আয়োজন করে প্রকাশ্যে এই কবিতা পাঠের আসর বসানো হয়। তবে তালেবান-অধ্যুষিত কান্দাহার বা হেলমান্দ প্রদেশে এ ধরনের কাব্যের আসর এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তালেবান মনে করে, এ ধরনের কাব্যচর্চা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে উৎসাহিত করে।
তবে সব ঝুঁকি ও ভয় উপেক্ষা করে আফগানিস্তানের নারী কবিরা ‘মিরমান বাহির’ নামের একটি সাহিত্য সংগঠন করেছেন। এই সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় নারী কবিরা প্রতি সপ্তাহে গোপন সাহিত্য বাসরে মিলিত হন। যাঁরা ভয়ে আসতে পারেন না, তাঁদের জন্য টেলিফোনের হটলাইন আছে। তাঁরা ফোন করে কবিতা পড়ে শোনান।
শুধু তালেবান নয়, কান্দাহার বা হেলমান্দের সমাজও সাধারণভাবে নারীদের এ প্রেমের কবিতাচর্চাকে বাঁকা চোখে দেখে। নাদিয়া জানান, মা তাঁকে এই সাহিত্য সংগঠনে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন। নাদিয়া বলেন, ‘মা বলেছেন, “প্রেমের কবিতা লেখে যে মেয়ে তাকে বিয়ে করবেটা কে?”’
তবে এই মিরমান বাহির-এর মাধ্যমে পশতুন নারীদের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন নাদিয়া। আই অ্যাম এ বেগার অব দ্য ওয়ার্ল্ড: লান্দেজ ফ্রম কনটেমপোরারি আফগানিস্তান বইয়ের লেখিকা এলিজা গ্রিসওল্ড এএফপিকে বলেন, ‘নীল বোরকার আড়ালে চুপ মেরে থাকা মৃতবৎ পশতুন নারীদের সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে, লান্দে তার গ্লানি, প্রেম ও ক্ষোভের শক্তি দিয়ে সেই ধারণার বিরুদ্ধে এক সুপ্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।’
মার্কিন জোটের অভিযানে ১৫ বছর আগে কট্টরপন্থী তালেবানের পতন হওয়ার পরও আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গায়ই নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে।
মিরান বাহির-এর সমন্বয়ক পাকিজা আরজু বলেন, ২০১০ সালে হেলমান্দে জারমিনা নামের এক কবি গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি টেলিফোনে সাপ্তাহিক আসরে লান্দে পড়ে শোনাতেন। জারমিনার ভাই মনে করেছিলেন, তিনি কোনো পুরুষের সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন। এই নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। পরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
টেলিফোনে নিয়মিত নিজের লেখা পড়ে শোনান এমন একজন কবির একটি লান্দে শোনান পাকিজা আরজু:
‘কার পাপে আমি আজ প্রথার বলি?
আমি শুধু নারী, এ আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ।’