উত্তপ্ত চীন সাগর

চীনের ঘোষিত বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে উড়ছে মার্কিন বোমারু বিমান ৷ ছবি: রয়টার্স
চীনের ঘোষিত বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে উড়ছে মার্কিন বোমারু বিমান ৷ ছবি: রয়টার্স

এই নভেম্বর-ডিসেম্বরের শীতের মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে চীন সাগর। বলা ভালো, চীনের সঙ্গে তার প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের। এই উত্তেজনায় জড়িয়ে গেছে বিশ্বের মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রও।
উত্তেজনার কারণ, পূর্ব চীন সাগরে কিছু এলাকায় বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চীনের ঘোষণা। গত ২৩ নভেম্বর চীনা সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, অন্য কোনো দেশের বিমান যদি এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে চলাচল করতে চায়, তাহলে তাদের চীনা কর্তৃপক্ষকে আগেভাগে জানাতে হবে এবং বিমান চলাচলে বেইজিংয়ের নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে।
শুধু তা-ই নয়, চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটারে বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলের একটি মানচিত্রও প্রকাশ করে। এতে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপানের কিছু অংশসহ পূর্ব চীন সাগরের বিশাল অঞ্চলকে চীনের সীমানাভুক্ত দেখানো হয়।
চীনের এ ঘোষণার পর ওই অঞ্চলে উত্তেজনা দেখা দেয়। দ্রুত জবাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ওই বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠান চীনকে না জানিয়েই। এরপর ২৮ নভেম্বর ওই অঞ্চলে বিমান পাঠায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। বিমান পাঠানো থেকে বাদ যায়নি তাইওয়ানও। তাইপে জানিয়েছে, তার সামরিক বিমান চীনের বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল দিয়ে অন্তত ৩০ বার যাতায়াত করেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন জানিয়েছে, তারা প্রতিরক্ষা ও নজরদারির জন্য ওই অঞ্চলে জঙ্গি বিমান মোতায়েন করেছে।

বিশ্বের অনেক দেশই বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো এলাকায় তারা সেটা করেনি। চীন ঠিক সেই কাজটি করেছে। পূর্ব চীন সাগরের যে এলাকায় নতুন Èবিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল গড়ে তুলেছে বেইজিং, সে এলাকায় জাপানের জাপানের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেনকাকু বা দিয়াউ দ্বীপপুঞ্জ ও নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন লিয়োডো রিফ রয়েছে।

চীনের এ পদক্ষেপে প্রতিবেশী দেশগুলো (বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের আশঙ্কা, এই বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে চীন পূর্ব চীন সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে এবং এসব এলাকার আকাশসীমায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাবে।

তবে এ ব্যাপারে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কিন গাং বলছেন, ওই অঞ্চলে টহল দেওয়ার অধিকার চীনের রয়েছে এবং Èবিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে গড়ে তোলা হয়নি ।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য চীনের এ যুক্তি মানতে নারাজ। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, চীনের এ ঘোষণায় তার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, চীনের এই পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেবে। এটা এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতিকে একেবারে পাল্টে দেবে, জন্ম দেবে ভুল বোঝাবুঝি ও দুর্ঘটনার।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু হ্যামন্ড সিএনএন ডট কমের জন্য লেখা এক ধারাভাষ্যে লিখেছেন, বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল ঘোষণার পেছনে বেইজিংয়ের যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, এই ঘটনা চীন তার ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রদর্শন করতে চাইছে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সন্দেহ বিরাজমান, তার দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে৷

পর্যবেক্ষকদের মতে, চীনের বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল ঘোষণার প্রভাব শুধু জাপানের ওপর নয়, এটি এই অঞ্চল দিয়ে অন্য যেসব দেশের বিমান নিয়মিত চলাচল করে তাদের ওপরও প্রভাব ফেলবে ।

পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকু বা দিয়াউ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চীন ও জাপানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। উভয় দেশই দ্বীপপুঞ্জটিকে নিজের বলে দাবি করছে। জাপান দ্বীপটির নাম দিয়েছে সেনকাকু । আর চীন নাম দিয়েছে দিয়াউ। এই বিরোধের জের ধরে দুটি দেশ গত বছর ওই দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় পাল্টাপাল্টি জাহাজ ও বিমান পাঠিয়েছে। তাইওয়ানও এই দ্বীপপুঞ্জের দাবিদার৷ এই দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে।

 এ উত্তেজনা নিরসনের লক্ষ্য নিয়ে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। পূর্ব এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে তিনি এই দেশ তিনটিতে যান। জাপান সফরে গিয়ে তিনি চীনের এই বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চল ঘোষণার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে জাপানের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি এই সঙ্গে চীনকে উত্তেজনা নিরসনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।

এর সপ্তাহ খানেক আগে চীনের কাছে পরিষ্কার বার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষায়,È ‘আমাদের বার্তা সহজ ও পরিষ্কার: প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নিরাপত্তাবিষয়ক আবাসিক প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্র, আমরা এখানে থাকার জন্য এসেছি এবং আমরা এই এলাকায় সবকিছুর সঙ্গে ঘ​িনষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের অাহ্বানে চীন কীভাবে সাড়া দেয়, সেটাই এখন দেখার বিষ​য়৷

রোকেয়া রহমান

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন ও এএফপি