ঘোর সংকটে ইউক্রেন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেন বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি না করায় কিয়েভে িবক্ষোভ ৷ ছবি: এএফপি
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেন বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি না করায় কিয়েভে িবক্ষোভ ৷ ছবি: এএফপি

বাল্টিক সাগর-তীরবর্তী লিথুয়ানিয়ায় গত ২৮ ও ২৯ নভেম্বর বসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় পূর্ব ইউরোপীয় সম্মেলন। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব আর সহযোগিতা আরও দৃঢ় করাই ২৮ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই উদ্যোগের লক্ষ‍্য। ঠিক ছিল, এই সম্মেলনেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইউক্রেনের একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এ ছাড়া মলদোভিয়া ও জর্জিয়ার সঙ্গে একটি যৌথ ঘোষণা আসবে।
লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এবারের পূর্ব ইউরোপীয় সম্মেলনে ইইউ জোটের ২৮টি সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা ছাড়াও রাশিয়ার পূর্ব আর পশ্চিমের প্রতিবেশী ইউক্রেন, মলদোভিয়া, বেলারুশ, জর্জিয়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার রাষ্ট্র/সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিত্‍স বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না বলে বেঁকে বসেন। এর প্রতিবাদে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী পথে নেমে আসে। দেশজুড়ে শুরু হয় সাধারণ ধর্মঘট। কয়েক দিন ধরে দেশটিতে মারাত্মক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ২০০৪ সালের ‘অরেঞ্জ বিপ্লবের’ পর এবারের এই বিক্ষোভই ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী আন্দোলন।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভিয়া, জর্জিয়া বা আজারবাইজানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ও অন্যান্য সহযোগিতাকে সোভিয়েতের উত্তরাধিকারী রাশিয়া কখনোই ভালো নজরে দেখেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়লেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একদা সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সৌহার্দ‍্য ও সংহতি ছিল। তবে নানা বাস্তবতার কারণে ক্র​েমই তা শিথিল হয়ে পড়েছে আর দেশগুলো ঝুঁকে পড়ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে। এ জন্য রাশিয়ার ‘দাদাগিরি’ রাজনীতিও অনেকটা দায়ী।

গত কয়েক দশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেশীয় ঐক্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার সময়ের তুলনায় এখনকার ইউরোপের চেহারা অনেক আলাদা। শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভিবাসন, কর্মসংস্থান, সামাজিক কল্যাণ, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও মানবাধিকার ইত্যাদিসহ সব বিষয়ে সদস্যদেশগুলোকে একই নিয়মকানুনে বঁাধার চেষ্টা করেছে ইইউ। জোটের বিশাল অভিন্ন বাজার ব্যবস্থায় পণ্য ও সেবা অবাধে চলাচল করে। পাশাপাশি বৈদেশিক নীতিও এক। সব মিলিয়ে সব ক্ষেত্রেই চলে সমন্বয় আর সহযোগিতার প্রয়াস।

পূর্ব ইউরোপবিষয়ক সম্মেলনের আগেই ইইউ নেতারা ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ জুলিয়া তিমোশেঙ্কোকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানি বা অন্য কোথাও পাঠানোর কথা বলছিলেন। কিন্তু ইউক্রেনের পার্লামেন্ট তা নাকচ করে দেয়। দু-দুইবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত জুলিয়া তিমোশেঙ্কোর দল ২০১০ সালের নির্বাচনে প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি হয়। কিন্তু দেশের প্রধান বিচারপতিকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে কারারুদ্ধ হয়ে আছেন তিমোশেঙ্কো। তিনি বলেছেন, এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিমোশেঙ্কোকে উন্নত চিকিৎ‍সার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভের প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরোক্ষভাবে হলেও সম্পর্কযুক্ত।

তিমোশেঙ্কো সমর্থকেরা এমনিতেই খেপে ছিল। এবার দেশজুড়ে মানুষকে আরও খেপিয়ে তোলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিত্‍সের অস্বীকৃতি। ইয়ানকোভিত্‍স সরকারের বিরুদ্ধে নানা অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ইউক্রেন একটি সার্বভৌম দেশ হলেও ইয়ানকোভিত্‍সের ‘নতজানু নীতি’ দেশটিকে রাশিয়ার উপনিবেশে পরিণত করেছে। রাজধানী কিয়েভের স্বাধীনতা চত্বরে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সপ্তাহজুড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জমায়েত হয়। তারা নগর পরিষদ ভবন দখল করে নেয়। পার্লামেন্টের স্পিকার ভ্লাদিমার রাইব্যাক বলেছেন, সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে। এ লক্ষে‍্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে।

বিরোধী ফাদারল্যান্ড দলের নেতা আরসেনি ইয়াত্‍সেনিউক জানিয়েছেন, বিরোধীদলীয় জোট সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছে ‘অজনপ্রিয়’ এই সরকারের পতন ঘটিয়ে আগাম নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। নির্বাচনের চার বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানকোভিত্‍সের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে মাত্র ১৬ শতাংশে। আগামী ২০১৫ সালের নির্বাচনে তঁাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে হলে অবিলম্বে অর্থনৈতিক সংস্কার ও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে।