জাদিপাই ঝরনার জলে
আজ এক ঝরনার কথা শোনাব সবাইকে, যে ঝরনার পাশ দিয়ে খুব নিচু স্বরে এসে থমকে দাঁড়ায় দিনের বাতাস, যে ঝরনায় প্রবেশের জন্য আকাশসমান গাছের কাছে অনুমতি চেয়ে বেড়ায় ভোরের রোদ্দুর, যে ঝরনায় কাচের মতো স্বচ্ছ টলটলে পানি আয়না হয়ে অপেক্ষা করে নতুন কোনো বিস্ময় বিহ্বল চোখের জন্য, যে ঝরনা এখনো শহুরে মানুষের চোখে অদেখা এক ‘জাদুকরি ঝরনা’। নিজেকে আর সবার কাছ থেকে আড়াল করে শতাব্দীর পর শতাব্দী বান্দরবানের গহিন অরণ্যে নিরলস বয়ে চলা এই ঝরনার নাম ‘জাদিপাই ঝরনা’। জাদিপাই ঝরনা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝরনা।
জাদিপাই ঝরনা বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার গহিনে জাদিপাই পাড়ায় অবস্থিত। এর এক পাশে বিশাল সুউচ্চ ‘কেউক্রাডং’ পাহাড় আর বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আদিবাসীদের গ্রাম ‘পাসিং পাড়া’। পাড়াটা মেঘের ওপরে, বর্ষাকালে যখন ঝুমবৃষ্টি হয়, তখন এই পাড়ায় অনেক সময়ই বৃষ্টি পড়ে না, বৃষ্টি শুরুই হয় এর নিচ থেকে! এখান থেকে একই সঙ্গে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়, এই দুই সময়েই পাহাড়ের মেঘগুলোতে আগুন ধরে যায়, লাল টকটকে মেঘের দল মুখ ভার করে বসে থাকে দিগন্তের কোনায়। পাসিং পাড়ার নিচেই জাদিপাই পাড়া, আর সে পাড়া পার হলে উদয় হবে জাদিপাই ঝরনা। ঝরনাটি বাংলাদেশের আর সব ঝরনা থেকে আলাদা। অন্য সব ঝরনার পানি পড়ে লম্বালম্বি করে আর জাদিপাইয়ের পানি পড়ে সিঁড়ির মতো স্তরে স্তরে। এই ঝরনার চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু বিশাল সব গাছের দেয়াল একে আড়াল করে রেখেছে আর সবার কাছ থেকে। এই গাছের জন্য একেবারে কাছে গেলেও একে দেখার উপায় নেই, জাদিপাইকে খুঁজে বের করতে হয় এর পানি পড়ার একটানা ঝিরঝির শব্দ দিয়ে। বর্ষাকালে সেকেন্ডে কয়েক টন পানি পড়তে থাকা এই ঝরনায় একসঙ্গে অনেক রংধনু দেখতে পাওয়া যায়। সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে পড়তে থাকা ঠান্ডা পানি কাঁপন ধরিয়ে দেয় শরীরে। সোজাসুজি পানি পড়ে না বলে অন্য সব ঝরনা থেকে এই ঝরনা অনেক নিরাপদ, ওপর থেকে ভারী কিছু মাথায় পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। জাদিপাইয়ের সবচেয়ে মজার দিক হলো, একে পাহারা দিয়ে রেখেছে অগুনিত বানরের এক চৌকস দল, তাদের কাজই হলো খানিক পরপর পাহাড়ের মাথায় বসে ঝরনার নিচের দিকে তাকিয়ে পাহারা দেওয়া, অচেনা কাউকে ঢুকতে দেখলেই তারা তাদের ভাষায় অন্যদের সাবধান করে দেয়, সেই সাবধানবাণী কেউ না শুনলে শুরু করে হইহুল্লোড়। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে ছুটে আসে বুড়ো বানরের দল। তারপর সবাই মিলে নানান অঙ্গভঙ্গি করে আহূত আগন্তুকদের প্রতি, সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
বানরের দল ছাড়াও জাদিপাইতে দেখার মতো আরও অনেক কিছু আছে, ঝরনার একপাশে একটা বিশাল মোটা গাছ অনেক বছর আগে ভেঙে পড়ে রয়েছে, তার গায়ে জমেছে বিস্তর শেওলা, সে গাছের কোঠরে বাসা বেঁধেছে একজোড়া কাঠবিড়ালী। ঝরনার পানি জমে জমে তৈরি করেছে কোমরসমান গভীর এক পুকুরের, সে পুকুরের পানি এতই স্বচ্ছ যে পায়ের আঙুলে জমে থাকা খুদে পাথরের টুকরাগুলোও অনায়াসে গোনা যাবে। মাথার ওপর বৃষ্টির মতো পড়তে থাকবে বরফশীতল পানির কণা। আঁজলা ভরে সেই পানি আকণ্ঠ পান করা যাবে। একটু সাহস করলে ঝরনার কয়েকটা পাথরে আরাম করে উঠে বসে থাকা যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কুয়াশার মতো ছুটে আসা পানি মুখে-চোখে মাখতে মাখতে মনে হবে, এই তো জীবন, এর জন্যই বুঝি বেঁচে থাকা। ঠিক সেই সময়েই অচেনা, অজানা এক চঞ্চল পাহাড়ি ঝরনার জন্য মনের গহিন কোণে জন্ম নেবে অগাধ ভালোবাসা।
তোমরা যারা জাদিপাই যেতে চাও, তাদের জন্য বলছি, জাদিপাই যাওয়ার রাস্তা কিন্তু খুব সোজা, প্রথমে বান্দরবান শহরে যেতে হবে, সেখান থেকে বাসে বা জিপে করে যেতে হবে পাহাড়ি নদী ‘সাঙ্গু’কে ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর এক জায়গা ‘রুমা বাজারে’। রুমা বাজার থেকে আবার জিপে করে তোমরা চলে যাবে ২৭০০ ফুট ওপরে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জলাশয় বা লেক ‘বগা লেকে’। বগা লেক সে এক দেখার মতো জায়গা, প্রতিদিন শত শত মানুষ বগা লেকে যায় শুধু এই লেকটা দেখার জন্য। একদিন আরাম করে বগা লেক দেখে পরদিন শুরু করবে হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে কয়েক ঘণ্টা পর উঠে যাবে কেউক্রাডং পাহাড়ে। সেখান থেকে আশপাশের সবকিছু কী অদ্ভুত সুন্দর দেখা যায়! দেখে মনে হয়, তুমি সবার ওপরে আর বাকি দুনিয়া অনেক অনেক নিচে! তারও নিচে সাদা সাদা মেঘের সারি, এককথায় তুমি চলে যাবে মেঘের ওপরে। কেউক্রাডং পাহাড় দেখে যখন তুমি জাদিপাই ঝরনা দেখার জন্য রওনা দেবে, তখন তোমার চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। মেঘের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু সময় পরই তুমি পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝরনাতে।
জাদিপাই ঝরনাতে নামতে হলে কিন্তু টারজানের মতো গাছ ধরে ঝুলে ঝুলে নামতে হবে, সে আরেক অ্যাডভেঞ্চার—এপাশের কলাগাছ ধরে যখন ওপাশের জারুলগাছে ছুটে যাবে, তখন পা দিয়ে ঠেক দিতে হবে মাঝের কোনো কাঠবাদামগাছে। কখনো আবার বসে বসে নামতে হবে মিনিটের পর মিনিট। সঙ্গে একটু রশি নিয়ে গেলেই আর কোনো টেনশন নেই, ঝুলতে ঝুলতেই পৌঁছে যাবে রংধনুর জগতে। এটা কিছু বানরের আস্তানা। তোমার হঠাৎ আগমনে তারা একটু অবাক হবে বটে, তবে তাদের না ঘাঁটালে তারাও কিছু বলবে না। এর পরের অংশটুকুও কি আমাকে বলতে হবে! যাও, ঝাঁপিয়ে পড়ো ঝরনার সাদা হিমহিম ঠান্ডা পানিতে, এতক্ষণের ঘামে ভেজা শরীরটাকে আরাম দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো বাথটাব দুনিয়ার আর কোথাও পাবে না... তবে সাঁতার জানা না থাকলে সে জায়গায় না যাওয়ায় ভালো
ফিরে আসার সময় গাছে ঝুলে উঠতে উঠতে আরেকবার পেছনে ফিরে তাকিয়ো, দেখবে, বাতাসের দোলায় দুলতে থাকা গাছের ফাঁক দিয়ে হাসছে জাদিপাই ঝরনার সাদা পানি। বিশাল সবুজ বন নিজের কোলের মধ্যে পরম মমতায় আড়াল করে রেখেছে প্রকৃতির এই জাদুকে। এখানে যে একবার আসে, এই জাদুর মোহে বারবার তাকে আসতেই হবে।
ছবি: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী