গাছের ওপর ঘর

দুপুর। ঢাকার কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ ভবনের সামনের রাস্তাটা ভীষণ ব্যস্ত। ব্যস্ত বিজিএমইএ ভবনের সামনের বটগাছের নিচের চায়ের দোকানও। দোকানির কছে গিয়ে জানতে চাই, ‘এখানে মোশাররফ মিয়া থাকেন না?’

‘হ, থাকেন।’

‘তিনি আছেন?’

‘না, এখন নাই।’

‘কোথায় আছেন, বলতে পারেন?’ চায়ে চিনি ঘুঁটতে ঘুঁটতে চায়ের দোকানির জবাব, ‘মনে লয় রেললাইনের ওই দিকে। এট্টু বসেন, আইসা পড়ব।’ আমরা বসি না, ঘুরে ঘুরে মোশাররফ মিয়ার বাড়িটা দেখি। দেখার মতো বাড়ি বটে! মিনিট দশেক বাদে কাঁধে গামছা আর মুখে দাঁড়িওয়ালা লম্বামতন একজন সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আঙ্কেল, আমার খোঁজে আইছেন?’

‘আপনি এই বাড়ির মালিক?’

‘হ, মালিক বলতে, এইখানে থাকি...’

মোশাররফ মিয়ার সঙ্গে হাত মেলাই আমরা। বলি, ‘আপনাকেই খঁুজছি আমরা। আপনি তো ফাটাফাটি একটা বাড়ির মালিক!’ তাঁর মুখে লাজুক হাসি, ‘এইটা আবার বাড়ি হয় ক্যামনে! ঘর বলতে পারেন।’ মোশাররফ মিয়ার কথাই ঠিক, বাড়ি বলার চেয়ে ঘর বলাই ভালো। আমরা যাই তাঁর ঘরটা দেখতে। ঘরটা দেখার জন্য আমাদের অনেক কায়দা-কসরত করে উঠতে হলো প্রায় ২৫ থেকে ২৬ ফুট লম্বা বটগাছে! হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গাছটায় ওঠার পর নিজেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের  জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়  উপন্যাসের ‘মুনির’ কিংবা ‘সলীল’ মনে হতে লাগল! ঘর তো ঢাকা শহরে অনেক আছে, এমন গাছঘর যে বিরল! 

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা

প্রায় তিন-চার মাস হয় ঘরটা তৈরি করেছেন মোশাররফ মিয়া। বটগাছের তিনটা ডালের মাঝখানে পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করেছেন কাঠ আর বাঁশের ফালি। ফালিগুলো গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধেছেন দড়ি দিয়ে। প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে ঘিরেছেন চারপাশ। আর ছাদ বলতে একটা প্লাস্টিক ও ছেঁড়াফাড়া ত্রিপলের অংশবিশেষ। ঘরের ভেতরটাও দেখতে বেশ। সাজানো-গোছানোই বলা চলে। একপাশে শোয়ার জায়গা, পাশেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, গ্লাস-প্লেট, শামুকের খোল, টিনের মগ, কাচের বয়াম, কাপড়চোপড় আর একটা ছবি। অর্ধেক ঘোড়া আর অর্ধেক নারীর রহস্যময় ছবি। সেই অর্ধেক নারী ও ঘোড়ার পিঠে আবার দুটি ডানা, আকাশে উড়ছে মেঘের মতো! ঘরে ঢোকার মুখে ছোট্ট একটা বারান্দামতো জায়গা। সেখানে পা দুলিয়ে বসে মোশাররফকে প্রশ্ন করি, ‘এত জায়গা থাকতে গাছে ঘর বাঁধলেন কেন?’ তিনি দাঁত বের করে হেসে বলেন, ‘গাছের উপ্রে মনে করেন আমার বিরাট আবেগ! এই আবেগ থেইকাই এইখানে ঘর বাঁধছি।’

আসলেই গাছ নিয়ে তাঁর অনেক ‘আবেগ’! মজার বিষয় হলো, যে বটগাছটায় ঘর বেঁধেছেন, সেটা তাঁরই লাগানো। মোশাররফ মিয়া মাথা চুলকে গাছটার বয়স মনে করার চেষ্টা করেন, ‘এরশাদের আমলে লাগাইছিলাম গাছগুলা। পাশের যে দুইটা বটগাছ দেখেন, ওই দুইটাও আমি লাগাইছি।’ গাছের বয়স না হয় জানা গেল, আপনার বয়স কত? এবার মাথা চুলকে নয়, মোশাররফের ত্বরিত জবাব, ‘সঠিক সন মনে নাই, তয় মুক্তিযুদ্ধের পরে। শরীয়তপুরের দাদপুর গ্রামে দ্যাশের বাড়ি। বড় হওনের পর ঢাকায় আইছি। মা মারা গেছে, পরে বাপ হইছে তালুই (তাওয়াই। এর মানে বাবা একটু দূরের মানুষ হয়ে গেছেন!)। তার সাথে বিশেষ যোগাযোগ নাই। বিয়া করছিলাম, বউ চইলা গেছে। সন্তানাদি নাই। একলা মানুষ। তাই এই ঘর বানায়া আছি।’

মোশাররফ মিয়া যে একেবারে একলা, তা বলা যায় না। তাঁর গাছঘরের ওপরেই একটা কাকের বাসা। একজোড়া কাক তাঁর প্রতিবেশী। এই প্রতিবেশী আবার অ্যালার্ম ঘড়ির কাজও করে। মোশাররফের ভাষায়, ‘সকালে এই কাউয়ার ডাকেই ঘুম ভাঙ্গে। আগে এই গাছটার নিচেই একটা চা-পানের দোকান আছিল। রাস্তা বানানের সময় ভাইঙ্গা দিছে। এহন কাওরান বাজারে মাছের কারবার করি। মাছ কিনি-বেচি। সারা দিন ঘুরিফিরি। এই হাতিরঝিলের পাড়ের গাছগুলার দেখাশোনা করি।’

মোশাররফ মিয়া
মোশাররফ মিয়া

ঘরবাড়ি ভালা না আমার

গাছঘর থেকে নেমে মোশাররফ মিয়ার লাগানো গাছগুলো দেখি আমরা। ঝিলের পাড়ে লাগানো তাঁর সবজির গাছগুলোও বেশ লকলক করে বেড়ে উঠেছে। করলাগাছে হলুদ ফুল, লতানো লাউগাছ, ফুলে ভরপুর পেঁপেগাছ দেখাতে দেখাতে বলেন, ‘এইখানে আমারে কেউ ডিস্টাব করে না, আমিও কাউরে ডিস্টাব করি না। পত্যেক সন্ধ্যায় অনেকগুলো চড়ুই পাখি, কাউয়া আইসা থাকে। শীতকালে বাদুড় আসে। ঘরে খাওন থাকলে ওগোরে দেই। আরামেই আছি।’

‘গাছপালা আর পাখিদের দেখাশোনা তো করেন, অসুস্থ হলে আপনার দেখাশোনা কে করে?’ মোশাররফ হেসে ফেলেন, ‘কে আর দেখব, নিজেরেই নিজে দেখি!’ বলে চলে মোশাররফ, ‘মাঝেমধ্যে আল্লায় খালি এট্টু বৃষ্টি দেয়। ঘরে পানি পড়ে।’ বলতে বলতে একটা পলিথিন নিয়ে তিনি উঠে পড়েন। বলেন, ‘আমার এক নানি ধুন্দলের পাতার ভর্তা খাইব। যাই গিয়া, দেখি ধুন্দল-পাতা পাইনি।’ কথা শেষ করেই হাতিরঝিলের পাড়ের দিকে হাঁটা দেন গাছঘরের মালিক মোশাররফ মিয়া।