ডলফিনের ডুবসাঁতার

ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণী — এ কথা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা। এরা যে শুধু স্তন্যপায়ী, তা-ই নয়, অনেকটা সামাজিকও। গর্ভ ধারণ করার পর মা ডলফিন সাত-আট মাসের মাথায় বাচ্চা জন্ম দিয়ে থাকে। বাচ্চাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়ায়।

স্পিনার ডলফিন
স্পিনার ডলফিন

বাবা ডলফিন তখন হয়তো খাবারের খোঁজে চষে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের নীল জল।

ডলফিনরা সাধারণত দল বেঁধে চলাফেরা করতে পছন্দ করে। দু-তিন বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চা ডলফিন থাকে মা-খালাদের আদরে। কোনো কোনো সময় নানির কাছেও বেড়ে উঠতে দেখা যায় তাদের। তবে মা ডলফিন যে শুধু বাচ্চা জন্ম দেওয়া আর তাদের লালন-পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা কিন্তু নয়। এরা পুরুষ ডলফিনের মতো খাবার সংগ্রহ এবং অন্য নানা কাজেও অংশ নিয়ে থাকে সমানভাবে। আমরা যখন নদী বা সমুদ্রের জলে নতুন নতুন ডলফিন খুঁজে ফিরি, তখন ওরা প্রায় সময়ই আমাদের জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে। পানি থেকে লাফিয়ে উঠে ঘুরতে থাকে ঘূর্ণিবায়ুর মতো। দারুণ দৃশ্য!

বিড্রিস ও ফলস কিলার তিমি
বিড্রিস ও ফলস কিলার তিমি

যেভাবে আমার শুরু

আমি তখন একজন টুরিস্ট গাইড হিসেবে সুন্দরবনে নিয়মিত যাতায়াত করি। সালটা ২০০২। এই সময়ই পরিচয় হয় ব্রেইন ডি স্মিথের সঙ্গে। তিনি এশিয়ান ফ্রেশ ওয়াটার ডলফিন বিশেষজ্ঞ। এখানকার নদ-নদীতে কাজ করতে এর আগেও কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। পরিচয়ের পর সুন্দরবনে একদিন তিনি আমাকে ডলফিনের নানা জাত চেনার কৌশল দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। এর আগেও অনেকবার ডলফিন দেখেছি, কিন্তু এভাবে চেনার সুযোগ হয়নি। যে ডলফিনই দেখি, তাকে চিনতে পারার আনন্দে আমি রীতিমতো লাফিয়ে উঠি। সেবারই প্রথম এই দলটির হয়ে ১৮ দিন ব্যস্ত ছিলাম ডলফিন শনাক্ত করার কাজে। অনেকটা এভাবেই ডলফিনের রাজ্যে আমার প্রবেশের শুরু। আমাদের এই টিমের অন্যতম সদস্য আমার বন্ধু মাসুদুর রহমান।

ডলফিন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা

একবার আমরা সমুদ্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আর নজর রাখছি তার জলরাশির দিকে। হঠাৎ দেখি একটা ডলফিন আমাদের নৌযানের পাশে চলে এসেছে। তার মুখে বিশাল একটা মাছ। ধুম করে সেই মাছটাকে সে আমাদের ট্রলারের পাটাতনের ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার দে ছুট। ডলফিনরা বেশ বন্ধুভাবাপন্নও হয়ে থাকে। এরা নিজেদের সমাজে বেশ সংঘবদ্ধ, বিপদে-আপদে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সাহাযে্যর হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, একটা বড় ডলফিন অনেকগুলো বাচ্চা ডলফিনকে পাহারা দিচ্ছে। এরা খেলাধুলা করতেও পছন্দ করে। অনেক সময়ে আমরা নানা আকারের রঙিন বল তাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা চালাই। কাজটা করার পর বেশ আনন্দ পেয়েছি।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র ছাড়াও প্রায় সব নদীতেই আছে বিভিন্ন ধরণের প্রকার ডলফিন
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র ছাড়াও প্রায় সব নদীতেই আছে বিভিন্ন ধরণের প্রকার ডলফিন

আমাদের ডলফিন

বাংলাদেশের প্রায় সব নদীতেই ডলফিন আছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রেও আছে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর ডলফিন। আমাদের মধ্যে যাদের নদীর আশপাশে ঘোরাফেরা করার অভ্যাস, তারা নিশ্চয়ই ডলফিন দেখে থাকবে। ফুস করে উঠে আবার টুপ করে তলিয়ে যাওয়া বড় আকারের যে প্রাণী দেখো নদীতে, সেটাও ডলফিন। তবে ভিন্ন প্রজাতির। অনেকে এদেরকে চেনে ‘শুশুক’ বা ‘শিশু’ নামে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এদেরকে ‘হুরচুর’, খুলনা অঞ্চলে বলা হয় ‘হুইচ্চা’। এ ধরনের ডলফিনকে নদীতেই দেখা যায়। শুশুক ডলফিন ছাড়াও আছে ইরাবতি ডলফিন, রাফটুথ ডলফিন, গোলাপী ডলফিন, বোতলনাক ডলফিন, স্পিনার বা ঘূর্ণি এবং চিত্রা সমেত মোট সাত ধরনের ডলফিন।

এসবের বাইরে আছে পাখনা ছাড়া পরপয়েস ডলফিন। এদের সঙ্গে অন্যান্য ডলফিনের পার্থক্য শুধু দাঁতের। এরা পুরোপুরি পাখনা ছাড়া হলেও আর সবকিছু অন্য ডলফিনের মতো। এ ছাড়া বিড্রিস ও ফলস কিলার বা ছদ্মঘাতক তিমির দেখা মেলে আমাদের জলসীমায়, যা আসলে ডলফিনদেরই একটা অংশ।

ডলফিন গবেষক রুবাইয়াত মনসুর মোগলী
ডলফিন গবেষক রুবাইয়াত মনসুর মোগলী

কোন ডলফিন কতটি আছে

শুশুক পুরোপুরি মিষ্টি পানির ডলফিন। এরা ঘন লবণপানি সহ্য করতে পারে না। তাই তোমরা এই প্রজাতির ডলফিনের দেখা পেতে পারো নদীর ধারে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেই। আমাদের ডলফিনের যে সংখ্যা, তা পুরোপুরি নিভু‌র্ল নয়। তবে এখানে একটি ডলফিনের দুবার গণনা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের গণনার বাইরেও অনেক ডলফিন আছে। এ পর্যন্ত আমরা শুধু সুন্দরবনেই গুনেছি ২৫০টি শুশুক, ৪৫০টি ইরাবতি ডলফিন। ও হ্যাঁ, তোমাদের একটা মজার বিষয় বলে রাখি, আমাদের দেশে যে পরিমাণ ইরাবতি ডলফিনের দেখা মেলে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ তার ধারেকাছেও নেই। আমাদের দেশে মোট ছয় হাজারের বেশি ইরাবতি ডলফিনের দেখা মেলে। এ ছাড়া এক হাজার ১৪৪টি বোতলনাগ ডলফিন শনাক্ত করেছি আমরা।

বাইনোকুলার দিয়ে গোনা হচ্ছে ডলফিন
বাইনোকুলার দিয়ে গোনা হচ্ছে ডলফিন

ডলফিন যেভাবে গোনা হয়

তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, কীভাবে আমরা ডলফিনদের গুণে থাকি। প্রথমটা হচ্ছে লাইন ট্রানজেক্ট পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সাধারণত নদীর ডলফিন গোনা হয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই সাহায্য নেওয়া হয় বাইনোকুলারের। কারণ, নদীতে থাকা ডলফিনের পিঠের পাখনায় ও শরীরে কাটাছেঁড়া কম থাকে। এ কারণে নদীর মাঝ বরাবর জাহাজ চালিয়ে বাইনোকুলার দিয়ে দুই পাশে দৃষ্টি রাখা হয়। অক্সিজেন নেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই ডলফিন পানির ওপরে লাফ দেয়। আর ঠিক তখুনি জাহাজের ওপরে ও নিচের দুই দিকে বাইনোকুলার নিয়ে তৈরি থাকা আমাদের টিমমেটরা ডলফিনদের শনাক্ত করে থাকে।

আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটা হচ্ছে ফটো আইডি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ছবি তুলে গণনা করা হয়। সমুদ্র এবং এর উপকূলীয় অঞ্চলে যেখানে ডলফিনের আবাস, প্রথমে সেসব এলাকা শনাক্ত করা হয়। এরপর সেই এলাকায় দেখা মেলা ডলফিনের ছবি তোলা হয়। সেসব ছবি পরে কম্পিউটারে বাছাই করে নির্বাচন করা হয় এবং তাদের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়। আর এদের যেহেতু শুধু পিঠ বা পিঠের পাখনার ছবি তোলা হয়, তাই পিঠের পাখনার ক্ষত শনাক্ত করাই হয় আমাদের কাজ। পানিতে নানা ধরনের প্রাণীর সঙ্গে লড়াই, জেলের জাল বা নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের মারামারির ফলে ডলফিনের পিঠের নরম মাংসপিণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই ক্ষত দেখেই মূলত ডলফিনের সংখ্যা গণনা করা হয়।


ছবি: ডব্লিউসিএস

অনুলিখন: হাসান ইমাম