অচেনা কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা

ঘন কুয়াশায় ঢাকা পথঘাট। এক হাতে দূরের কোনো কিছু দেখা যায় না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনী একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমি ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ গার্ড রেজিমেন্টের সঙ্গে মিলিতভাবে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে দিনাজপুর-ফুলবাড়ী-চরখাই অক্ষপথে সম্মুখসমরে রত। ডিসেম্বর মাসের এ সময়ে বাংলাদেশের এই উত্তর জনপদে, বিশেষ করে রংপুর ও দিনাজপুরে, প্রচণ্ড শীত পড়ে। এই শীতের মধ্যে প্রচণ্ড ঠান্ডা ও কুয়াশা উপেক্ষা করে আমরা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দল পিঁপড়ের লম্বা সারির মতো এগিয়ে চলছি। এবার আমাদের টার্গেট চরখাইয়ে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের ডিফেন্স পজিশন। ফুলবাড়ী থেকে পশ্চাদপসরণকারী পাকিস্তানি সেনারা এখন চরখাইয়ে অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে কত অচেনা গ্রাম, পথঘাট এবং জনবসতি পার হয়ে এসেছি তার ঠিক নেই। এই নিস্তব্ধ গভীর রাতে গ্রামবাংলা যেন তার চিরাচরিত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা জনবসতি, খেজুর রসের তাজা গন্ধ, শিশিরে ঢাকা পায়ে চলা মেঠোপথ, চকিত হুতুম পেঁচার ডাক, প্রহরে প্রহরে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। সব মিলিয়ে এক মাদকতাময় পরিবেশ। হঠাৎ এই নিশুত পরিবেশের বুক চিরে সম্মুখের গ্রাম থেকে ভেসে এল শত্রুর ভারী মেশিন গানের ঠা-ঠা-ঠা গুলি। শা-শা করে গুলি মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। আমরা সবাই মাটি কামড়ে শুয়ে পড়লাম। শত্রুর ফায়ারের তীব্রতা বেড়ে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল শত্রু আমাদের আক্রমণের সংবাদ আগাম জেনে গেছে। শত্রুর তরফ থেকে এমনভাবে ফায়ার আসতে লাগল যে আমরা মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছিলাম না। এমন সময় মিত্রবাহিনীর অনকল ফিল্ড রেজিমেন্টের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। পুরো এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে আর্টিলারির গোলা প্রচণ্ড জোরে ফাটতে লাগল। শব্দে কান পাতা দায়। গোলাবর্ষণের তীব্রতায় পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ারের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। এই সুযোগে আমরা নিজেদের ডিফেন্স পজিশন ঠিক করে নিলাম। ইতিমধ্যে শেষ রাতের কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে ধীরে ধীরে ভোরের সোনালি আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এখন আমরা সবকিছু স্পষ্ট দেখতে লাগলাম। দূরে দেখা যাচ্ছে রেললাইন চরখাই হয়ে হিলি গিয়েছে। রেললাইনের ওপারে চরখাই স্টেশনের লাল দালান। দালানের ওপরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। দালানের আশপাশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে। বোঝা গেল শত্রু জায়গা ছেড়ে একচুল নড়েনি এবং আজকে আমরা ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হব। ক্রমে বেলা বাড়তে লাগল। দুই পক্ষের তরফ থেকে এখন ফায়ার বন্ধ। গোটা এলাকায় শুধু শীতের সকালের শিরশির বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি ভোরের পাখি ও সকালের কাকেরাও যুদ্ধের ভয়াবহতায় উড়ে গেছে। রাত জাগা চোখ জ্বালা করছে, কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই। শত্রু সম্মুখে। সদা সজাগ থাকতে হবে। আক্রমণের প্রথম পর্ব তিনটি ট্যাংক গড়গড় করে এগিয়ে চলল সম্মুখে কিন্তু যেইমাত্র গ্রাম ছেড়ে মাঠে নেমেছে অমনি শত্রুর রিকয়েলেস রাইফেলের (ট্যাংক বিধ্বংসী কামান) গোলা এসে একটি ট্যাংকের চেইনে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে থেমে গেল ট্যাংকটি। বাকিগুলো পিছু ফিরে এল। সামনে এগোনো শক্ত। অ্যান্টি ট্যাংক ডিফেন্স নিয়ে বসে আছে শত্রু।

এমন সময় আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শর্মা এসে দাঁড়ালেন আমার পজিশনে। ইশারায় আমাকে ডেকে গ্রামের পূর্ব কোনায় গেলেন, যাতে করে সম্মুখে শত্রুর পজিশন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আমরা একটু এগোতেই ডোপ, ডোপ করে দুবার শব্দ হলো, স্পষ্ট বোঝা গেল শত্রু মর্টার ফায়ার করেছে, মর্টারের গোলা কোথায় পড়ল কে জানে, তাড়াতাড়ি পাশের ছোট্ট পুকুরের আড়ালে শটান হয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমাদের দশ হাত দূরে মর্টারের গোলা পড়ে প্রচণ্ড জোরে ফাটল। আড়ালে বসে থাকার জন্য গোলার স্প্লিন্টার আমাদের আঘাত করল না। তবে প্রচুর পরিমাণ কাদামাটি এসে আমাদের শরীরে লাগল। আমরা উঠে আবার যাওয়ার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ পিং শব্দে একটি বুলেট এসে আমার পাশের জোয়ানের মাথার হেলমেটে ট্যাং করে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বসে পড়লাম। তার মানে শত্রুর স্নাইপারের নিশানের মধ্যে ধরা পড়েছি। সামনে এগোনো সম্ভব নয়। যেভাবেই হোক এই স্নাইপারকে হটাতে হবে, তা না হলে অনেকে নিহত হবে। খুব সাবধানে আমরা ক্রল করে পেছনে চলে এলাম। যেই সামনের একটা বাড়ির আড়ালে দৌড়ে চলে এলাম সঙ্গে সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে দুটো বুলেট এসে বাড়ির দেয়ালে এসে বিঁধল। এর মানে শত্রুর স্নাইপার আমাদের পুরো গতিবিধি লক্ষ করছে। সে কাছেপিঠে কোথাও লুকিয়ে আছে। যেভাবেই হোক একে খঁুজে বের করতে হবে। আমরা সবাই যার যার বাইনোকুলার দিয়ে সম্মুখের গাছপালা ঝোপঝাড় খঁুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথাও স্নাইপারের টিকিটিও দেখতে পেলাম না। হঠাৎ দেখি আমার ডান পাশের খোলা জমির ভেতর দিয়ে ১২-১৩ বছরের এক কিশোরী দৌড়ে আসছে। আমি চিৎকার করে ওকে বললাম, এই মেয়ে গুলি হচ্ছে, বসে পড়ো। আমার চিৎকারে মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাটিতে বসে পড়ল। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে এল। সে তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। আমি বললাম,

—দেখছ না গুলি হচ্ছে, গুলি লেগে মারা যাবে তো, ভয় ডর নাই, কী হয়েছে?

—স্যার, এদিকে আসেন, জঙ্গলের কোনার বটগাছের ওপর এক মিলিটারি চড়্যা বসে আছে।

আমরা সবাই বুঝতে পারলাম, এটাই লুকানো সেই স্নাইপার হবে। একটা এলএমজি গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটির পেছনে আমরা রওনা দিলাম। ঘন বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে দুটো কর্দমাক্ত নালা পার হয়ে আমরা গ্রামের কিনারায় এলাম। একটা প্রচুর কচুরিপানা ও জঙ্গলে ভর্তি পুকুরের পাড়ে এসে সে বসে পড়ল। আমরাও সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম পুকুরের উঁচু পাড়ের আড়ালে, যাতে স্নাইপার আমাদের দেখতে না পারে। পুকুরপাড়টি লতানো বেতগাছের ঝোপে ভর্তি আর বেতের কাঁটা ছড়িয়ে আছে সবখানে। এর ফলে আমাদের নড়াচড়া করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। মেয়েটির হাত ও পা বেতের কাঁটার আঁচড়ে রক্তাক্ত। তবুও সে অতি উৎসাহের সঙ্গে আমাকে বলল, সে যখন আজ খুব ভোরবেলা এখানে আসে তখন দেখে একজন মিলিটারি গাছে উঠছে। এটা দেখে ভয় পেয়ে বাড়ি চলে যায়। তারপর গোলাগুলি শুরু হলে যখন সে আমাকে মানে মুক্তিবাহিনীকে দেখে তখন তার মন বলে এ ব্যাপারে জানানো দরকার। তাই সে গোলাগুলিকে ভয় না করে এসেছে আমাকে জানাতে। আমি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম। ও আমাদের দেখিয়ে দিল কোন গাছে শত্রু বসে আছে। এলাকাটি ঘন ঝোপঝাড়েভর্তি একটি জংলা জায়গা। ওখানে পাশাপাশি বড় দুটি বটগাছ লম্বা হয়ে অনেক উঁচুতে উঠেছে আর তার ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। বটগাছের কোনো এক ডালে বসে আছে স্নাইপারটি। বাইনোকুলার দিয়ে আমরা সবাই অনেক চেষ্টা করলাম শত্রুকে দেখার কিন্তু এত ঘন গাছের পাতার ভেতরে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। স্নাইপারটি অবশ্য আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না, কারণ, আমরা তার একেবারে কোনাকুনি এসে পজিশন নিয়েছি, ওর দৃষ্টি ছিল সম্মুখে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সুবেদার করন সিং-এর বাইনোকুলারে সে ধরা পড়ল। এলএমজির নিশানা লাগিয়ে পরপর দুবার ট্যা-ট্যা-ট্যা করে ফায়ার করতেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম ধপ করে বটগাছের উঁচু ডাল থেকে গুলি লাগা স্নাইপারটি মাটিতে পড়ল। ইতিমধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি ট্যাংকের স্কোয়াড্রন দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আমাদের অগ্রাভিযানের সময় হয়েছে। স্কোয়াড্রন কমান্ডার আমাদের ইশারায় ট্যাংকে চড়তে বললেন। আমরা ট্যাংকে উঠতেই ঘড়ঘড় করে ফুল স্পিডে সম্মুখে এগিয়ে চলল ট্যাংক স্কোয়াড্রন। কিছুদূর এগোতেই আমার হঠাৎ মনে পড়ল, আরে কিশোরী মেয়েটির নামও তো আমাদের জানা হলো না। কোনো ধন্যবাদও দিলাম না। যে কি না দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে আমাদের সাহায্য করেছে। যুদ্ধের ব্যস্ততায় তার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি। অসীম সাহসী একটি কিশোরী আমার কাছে অজানা রয়ে গেল। এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধারাই তো বাংলাদেশের গর্ব হবে একদিন। অকুতোভয় এই কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে অচেনা রয়ে গেল।