অভিধানের গল্প

একই শব্দ দীর্ঘদিন ব্যবহারে, চারপাশের নানান শব্দের ঘাতপ্রতিঘাতে শব্দের অর্থ পাল্টে যায়। কোনো কোনো শব্দের অর্থ ভয়ংকরভাবে পাল্টায়। কিছু শব্দ ভাষায় কীভাবে এল সাধারণ চোখে তার হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। শব্দের ইতিহাস কখনো জটিল, কখনো রোমাঞ্চকর। অভিধানের আজকের গল্প এই রকম মজার মজার কিছু শব্দ নিয়ে।

 বিনীত

আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রে বিনীত শব্দের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পত্র শুরু হয় বিনীত নিবেদন দিয়ে, আবার শেষও হয় স্বাক্ষরের শেষে বিনীত বিশেষণ বসিয়ে। চিঠিপত্র ছাড়াও ভদ্রতার খাতিরে মানুষ বিনীত হয়। স্থান-কাল-পাত্রভেদেও মানুষের ভাবভঙ্গি বিনীত হয়ে থাকে। বিনীত স্বভাবের বালক ও যুবাদের সবাই বেশ পছন্দ করেন। যারা দুর্বিনীত তাদের কেউ পছন্দ করে না।

বিনম্র, বিনয়ী, শান্ত ইত্যাদি ভাব বোঝাতে বিনীত শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিনীত শব্দের যে মূল অর্থ তার সঙ্গে কিন্তু এসব ভাবের কোনো সম্পর্ক নেই। বিনীত শব্দের মূল অর্থ যদি অনুসরণ করা হতো তাহলে মানুষ চিঠিপত্রে বিনীত না লিখে বিনত লিখত আর বালক ও যুবারা আরও বিনীত হওয়ার চেষ্টা করত। কারণ বিনীত শব্দের মূল অর্থ হলো সুশিক্ষিত, সংযত, মার্জিত রুচি, সংস্কৃতবান ইত্যাদি।

এসব গুণের অধিকারী কে না হতে চায়? আর যাঁরা এসব গুণের অধিকারী তাঁরা কি নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে নিজেকে সুশিক্ষিত, সংস্কৃতবান বলে জাহির করতে পারেন?

শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ইত্যাদি বিশেষণ যেমন নিজের নামের আগে নিজের হাতে বসানো চলে না, বিনীত বিশেষণও তেমনি চলার কথা নয়। কিন্তু তার পরও চলে। অজ্ঞাতসারেই চলতে থাকে। এটাই হলো ভাষার রহস্য।

 সম্ভ্রান্ত

শব্দের অর্থ প্রায়ই শব্দের অর্থের মূল সীমানা পেরিয়ে যায়। লোমহর্ষকরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায় শব্দের অর্থ। বাংলা ভাষায় সম্ভ্রান্ত শব্দটি সেই জাতীয় একটি শব্দ, যার অর্থ এ যুগে এসে একেবারেই পাল্টে গেছে।

অভিধানে সম্ভ্রান্ত শব্দের অর্থ দেওয়া রয়েছে অভিজাত, কুলীন, আশরাফ, মান্য, মর্যাদাশীল, সমাদরযোগ্য ইত্যাদি। আমরা আমাদের সমাজে সম্ভ্রান্ত বলতে ধন, মান, বংশমর্যাদাসম্পন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিকেই বুঝে থাকি। জ্ঞানী বা বিদ্বান ব্যক্তি, শিল্পী, সাহিত্যিক অধ্যাপকগণ আমাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র হলেও আমরা কিন্তু তাঁদের সম্ভ্রান্ত হিসেবে গণ্য করি না।

সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে দেখলেই আমরা চিনে ফেলি। কিংবা চিনতে বাধ্য হই। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ধন ও ক্ষমতার প্রতাপটা মুখ্য।

তবে রহস্যময় ব্যাপার হলো সম্ভ্রান্ত শব্দের মূল অর্থ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। সম্ভ্রান্ত শব্দের মূল অর্থ হলো আবর্তিত, ভীত, উৎকণ্ঠিত, হতবুদ্ধি ইত্যাদি। একজন সম্ভ্রান্তের দাপটে সাধারণ মানুষ যা হয়ে থাকে, সেটাই সম্ভ্রান্ত শব্দের আসল অর্থ।

 ইংরেজ

ইংল্যান্ডের মানুষকে আমরা ইংরেজ বলি। তাদের যে ভাষা তাকে বলি ইংরেজি ভাষা। তাদের ভাবসাব, রকমসকম, কাজকারবারও আমাদের চোখে ইংরেজি। এই ব্যাপারগুলো কোনো বাঙালির মধ্যে প্রকট হয়ে উঠলে সেটাকে বলি ইংরেজিয়ানা। এই ইংরেজিয়ানা হলো ইংরেজ সাহেবদের উৎকট অনুকরণ।

ইংরেজরা প্রায় দুই শ বছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করেছে। বাংলা দখল করেই ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের সূত্রপাত। কিন্তু তার পরও বাঙালি কিংবা অন্যরা ইংরেজদের ইংরেজি ভাষায় ডাকেনি, ডেকেছে আরেক ভিনদেশি ভাষায়। কেননা ইংরেজ শব্দটি ইংরেজি নয়।

কালের কুটিল গতি বা ইতিহাসের বিচিত্র গতি বলে একটা কথা আছে। ইংরেজদের ইংরেজি ভাষায় না ডাকার পেছনে এই ব্যাপারটাই কাজ করেছে। ভারতবর্ষ তথা বাংলা ইংরেজদের চিনেছে পতু‌র্গিজদের মাধ্যমে। পতু‌র্গিজরাই প্রথম এসেছিল এ দেশে। তারা ইংরেজদের বলত  Engrez। আর এই শব্দটিই বাংলা সাধু ভাষায় হয়েছে ইংরাজ, চলতি ভাষায় ইংরেজ, হিন্দিতে হয়েছে আংরেজ, উদু‌র্তে এংরেজ।

শ্বেতহস্তী

খবরের কাগজে মাঝেমধ্যে খবর বেরোয়, সরকার কোনো কোনো জায়গায় অকারণে কিছু শ্বেতহস্তী পুষছে। তখন এই শ্বেতহস্তী পোষার অর্থ দাঁড়ায়, সরকারের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয় কিন্তু সরকার বা জনগণ সেখান থেকে কিছুই পায় না। শ্বেতহস্তী বা শ্বেতহস্তী পোষা একটি বাগ্‌ধারা। সরল বাংলায় শ্বেতহস্তী হলো সাদা রঙের হাতি। সাদা বর্ণের কারণেই যে শ্বেতহস্তী বাগ্‌ধারা হিসেবে বাংলা ভাষায় ঠাঁই পেয়েছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বস্ত্তত এর একটা ইতিহাস রয়েছে।

বাংলা এই বাগ্‌ধারা সরাসরি ইংরেজি ভাষা থেকে গ্রহণ করা। ইংরেজি বাগ্‌ধারাটির উৎপত্তি থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডের নাম সিয়াম বা শ্যাম, বাংলায় শ্যামদেশ। জাপানকে যেমন বলা হয় উদিত সূর্যের দেশ, তেমনি শ্যামদেশকেও বলা হতো শ্বেতহস্তীর দেশ। শ্যামদেশের সব শ্বেতহস্তীর মালিক ছিলেন রাজা। জনগণের অর্থে শ্বেতহস্তী প্রতিপালিত হতো। শ্বেতহস্তী ছিল পবিত্রতার প্রতীক। রাজার ক্ষমতার স্মারক। শ্বেতহস্তীরা ইচ্ছেমতো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত। তাদের বাধা দেওয়ার অধিকার কারও ছিল না। শ্বেতহস্তী দিয়ে কোনো কাজ করানো হতো না।

রাজা যদি কোনো মন্ত্রী বা অমাত্যের প্রতি নারাজ হতেন তাহলে কোনো বাক্যব্যয় না করে তিনি সেই মন্ত্রী বা অমাত্যকে একটি শ্বেতহস্তী উপহার দিতেন। এই উপহার প্রদানের মেসেজ ছিল অতি পরিষ্কার। উপহার প্রাপকের হতো সাপের ছঁুচো গেলার অবস্থা। শ্বেতহস্তী প্রতিপালন করতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হতেন। শ্যামদেশের রাজার এই লোমহর্ষক উপহার থেকেই ইংরেজরা তাদের বাগ্‌ধারাটি নির্মাণ করে।

 ঠুনকো

 অনেক সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাও শব্দ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে থাকে। এ রকম একটা শব্দ হলো ঠুনকো, যার অর্থ যা সহজে ভাঙে অর্থাৎ ভঙ্গুর জিনিস।

সংসারের নিত্যদিনের বহুল ব্যবহৃত একটা শব্দ হলো ঠুনকো। শব্দটি যে শুধু জিনিসপত্রের বেলাতেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, জীবনের অনেক ক্ষেত্রেও ঠুনকো শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।

কাচ, চীনামাটির তৈজসপত্র অতিশয় ভঙ্গুর। লঘু আঘাতেই তা সহজে ভেঙে যায়। আর ভাঙার সময় ঠুন করে শব্দ করে বলেই এগুলো ঠুনকো।