কণ্ঠ

আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মাহবুবের কিছু একটা হয়েছে। অনেক দিন ধরেই দেখছি সব সময় অন্ধকার করে রাখে মুখ। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ পরিষ্কার। প্রশ্ন করলে ‘কিছু হয়নি’ বলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু ও যে বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়েছে তা তার আচার-আচরণ দেখে বোঝা যায়। মাহবুবকে শেষ কবে হাসতে দেখেছি মনে পড়ে না আমার। সেদিন ইংরেজির ক্লাসে ওকে চেহারা আরও ম্লান করে ঢুকতে দেখলাম। আমার পাশের ডেস্কে বসল। তারপর ভীষণ করুণ মুখ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল বাইরে। আমাকে গ্রাহ্যই করল না।

খুব রাগ হলো আমার। নোট খাতা থেকে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে লিখলাম, ‘কী রে চেহারাটা অমন করে রেখেছিস কেন? মনে হচ্ছে তোর কেউ মরেছে।’

কাগজটা মাহবুবের ডেস্কে রেখে কনুই দিয়ে মৃদু গুঁতো দিলাম। লাফিয়ে উঠল। ইঙ্গিতে কাগজের টুকরোটা দেখালাম। লেখাটা পড়ল ও। তারপর আমার দিকে চাইল মুখ তুলে। ভীতবিহ্বল দৃষ্টি। বুকটা ধক করে উঠল আমার।

ঠিক ওই সময় আমাদের ইংরেজির টিচার মি রাইয়ান মাহমুদ ডাক দিলেন আমাকে। এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য র‌্যাভেন’ আবৃত্তি করে শোনাতে বলছেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। শুরু করলাম আবৃত্তি। পোর এই কবিতাটি বেশ প্রিয় আমার। কিন্তু আজ কেন জানি গা’টা ছমছম করে উঠল কবিতা পড়ার সময়।

প্রথম স্তবক পড়ার পর রাইয়ান স্যার আরেকজনকে দ্বিতীয় স্তবক পড়তে বললেন। আমি বসে পড়লাম ডেস্কে। তাকালাম মাহবুবের দিকে। আমাকে একটা কাগজ এগিয়ে দিল ও স্যারের চোখ বাঁচিয়ে।

ভাঁজ খুলে মেলে ধরলাম কাগজটি। একটি মাত্র বাক্য লেখা :  ভয়ানকএকটিদুর্ঘটনাঘটতেচলেছে

 সরাসরি চাইলাম মাহবুবের দিকে। ওর মায়াবী চোখে ফুটে আছে ভয়। আবার চিরকুটের দিকে নজর ফেরালাম। আবার লেখাটা পড়লাম। কোনো প্রশ্ন বা অনুমান নয়, মাহবুব পরিষ্কার বলে দিচ্ছে একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে। বুঝতে পারলাম না এ লেখার মানে কী।

আরেকটা কাগজ ছিঁড়ে লিখলাম, ‘তোর মাথা ঠিক আছে তো?’ কাগজটা মুড়ে চালান করে দিলাম মাহবুবের ডেস্কে।

লেখাটা পড়ে ঠোঁট কামড়াল মাহবুব। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা কাগজে দ্রুত কী যেন লিখে ফেলল। তারপর ওটা ঠেলে দিল আমার ডেস্কে। আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

কাঁপা হাতে কাগজটা খুললাম আমি। ‘দেখতেই পাবে’ লেখা চিরকুটে।

সেদিন মাহবুবের সঙ্গে স্কুলে আর কথা হলো না। ওকে খুঁজে পেলাম না কোথাও। আরেক বন্ধুর সঙ্গে ফিরে এলাম বাড়ি। রাতে একবার ভাবলাম ফোন করি মাহবুবকে। কিন্তু ও আমাকে বারবার এড়িয়ে চলছে মনে পড়তেই রাগ হলো। চলে গেল ফোন করার ইচ্ছে।

পরদিন সকালে দেখা হয়ে গেল মাহবুবের সঙ্গে ইংরেজির ক্লাসে ঢোকার সময়। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। শূন্যদৃষ্টি চোখে। একটু পরে ইংরেজির টিচার এলেন। তবে রাইয়ান স্যার নন, অন্য আরেকজন।

আমার পেছনে বসেছে মাহবুব। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘রাইয়ান স্যার আর তাঁর স্ত্রী কাল রাতে কার অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। দুজনই মারাত্মক আহত। শুনেছি রাইয়ান স্যার অনেক দিন ক্লাস নিতে পারবেন না।’

রাইয়ান স্যারের জন্য খুব কষ্ট হলো আমার। মাত্র গত বছর বিয়ে করেছেন ভদ্রলোক। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে হিম একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম মাহবুবের দিকে। ওর চোখ ঝকঝক করে জ্বলছে দামি পাথরের মতো। বাঁকা হাসি ঠোঁটে। ‘দেখলি তো আমি মিথ্যা বলিনি,’ ফিসফিস করল মাহবুব।

ওর ঝকঝকে চোখের চাহনি সহ্য হলো না আমার, নামিয়ে নিলাম চোখ। ভাবতে কষ্ট হলো এই আমার বাল্যবন্ধু মাহবুব! যার সঙ্গে কেজি থেকে পড়ছি স্কুলে। রাইয়ান স্যারের জন্য ওর একটুও কষ্ট হচ্ছে না? সেই কথাটা মনে পড়ে গেল আবার। কালই না মাহবুব চিরকুটে অ্যাক্সিডেন্টের কথা লিখেছিল। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম আমি। সারাটা ক্লাসে একবারও মাহবুবের দিকে চাইতে পারলাম না চোখ তুলে। ঘণ্টা পড়তে ওর আগে বেরিয়ে পড়লাম ক্লাস থেকে। আমার মনে তখন একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে—যে করেই হোক মাহবুব অ্যাক্সিডেন্টের কথা আগেভাগে জেনে ফেলেছিল। সেদিন আর অন্য ক্লাসও করতে ইচ্ছে করল না। এতটাই অস্বস্তিবোধ করছিলাম আমি।

মাহবুবকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারলাম না। বাসে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, দৌড়াতে দৌড়াতে এল ও। ওকে দেখে কেটে পড়ার চিন্তা করছিলাম, হাত তুলে থামিয়ে দিল।

‘দাঁড়া,’ চেঁচাল মাহবুব। ‘কথা আছে তোর সাথে।’

দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাঁপাচ্ছে মাহবুব। ঘাম ফুটেছে মুখে। ‘তোকে ক্লাসে খুঁজে না পেয়ে ভাবলাম বাস স্টপেজে যাই,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মাহবুব। ‘বাসায় যাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ,’ ওর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলাম আমি।

‘আজ রাতে কোথাও বেরুচ্ছিস না তো?’ জানতে চাইল মাহবুব।

‘কোথাও বেরুচ্ছি না। কেন?’

‘না বেরুনোই ভালো।’ আমাকে লাইন থেকে বের করে আনল মাহবুব। কানের কাছে মুখ এনে ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলল, ‘আজ রাতে ভয়ানক এক অগ্নিকাণ্ড ঘটবে।’

অনেকক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। কথা বলার সময় কেঁপে গেল গলা। ‘কে লাগাবে আগুন—তুই?’

মাহবুবের মুখটা হঠাৎ বাঁকা হয়ে গেল, যেন ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

‘ওরা আমাকে শুধু বলেছে আগুন লাগবে,’ হিসিয়ে উঠল ও। ‘কে লাগাবে জানি না।’ চট করে রাগ উঠে গেল মাথায়। ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম। ‘কী বলছিস, মাহবুব?’ ওর ঠান্ডা ঝকঝকে চোখে চোখ রাখলাম আমি। ‘এসব ভয়ংকর কথা কে বলে তোকে?’

মাহবুব কাঁধ ঝাঁকিয়ে, ঝাঁকি মেরে মুক্ত করল নিজেকে। তারপর দৌড় দিল রাস্তার দিকে। ফিরেও চাইল না। বাড়ি ফেরার পথে সারাক্ষণ ভাবলাম কী করা উচিত আমার। বাবা-মাকে বলে দেব, নাকি স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারকে জানাব? কিন্তু কেউ যদি বিশ্বাস না করে আমার কথা?

সে রাতে এগারোটা পর্যন্ত থাকলাম টেবিলে। আমার চাচাতো ভাই সিনেমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। যাইনি। সোশ্যাল স্টাডিজের ওপর একটা নোট লিখলাম। নিচতলায়, ড্রয়িং রুম থেকে টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে। হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। ব্যাপার কী জানার জন্য এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। টিভিতে খবর হচ্ছে। যা দেখলাম তাতে হিম হয়ে গেল বুক।

চাচাতো ভাই বলাকায় ছবি দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমাকে। সেই হলেই আগুন ধরে গেছে। একুশে টিভির এগারোটার খবরে সেই ঘটনাই বিস্তৃত দেখাচ্ছে।

খবর দেখে অসুস্থ, বমি বমি ভাবটা আবার ফিরে এল। আরেকবার ঘটনাটা ঘটেছে। যে করেই হোক মাহবুব আগে জানতে পেরেছে অগ্নিকাণ্ডের কথা। ও বলেছিল আজ রাতে কোথাও আগুন লাগবে।

তক্ষুনি ফোন করলাম মাহবুবের বাড়িতে। ওর মা বললেন হঠাৎ করে মাহবুবের জ্বর এসেছে। জ্বরে কী সব আবোলতাবোল বকছে। আমি মাহবুবের মাকে দু-একটা সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে রেখে দিলাম ফোন।

পরদিন স্কুলে এল না মাহবুব। স্কুলের সবাই উত্তেজিত হয়ে বলাকা হলের অগ্নিকাণ্ডের কথা বলছিল। আমাদের স্কুলের একটি ছেলে জনতার হুড়োহুড়িতে আহত হয়েছে। তবে সিনেমা হলের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হল কর্মচারীরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে নিভিয়ে ফেলেছে আগুন। তবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা সম্ভব হয়নি।

ক্লাসটা আমার কাটল অদ্ভুত ঘোরের মাঝে। খুব ইচ্ছে করছিল মাহবুবের গোপন কথাটা বলে দিই কাউকে। কিন্তু আদৌ কি কেউ বিশ্বাস করবে এ কথা? শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম মাকে জানাব।

বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই উদ্বিগ্ন মুখে মা বলল, ‘মাহবুবের মা ফোন করেছিলেন। মাহবুবের অবস্থা খুবই খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মাহবুব নাকি বারবার তোর কথা বলছিল।’

কথাটা শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। মাহবুবের জন্য যা খুশি করতে পারতাম আমি। কিন্তু এখন ভয় করছে ওর কথা শুনে।

মাহবুবদের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তাই মা-ই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে। রাস্তায় কোনো কথা বললাম না দুজনে। সারাক্ষণ ভাবছিলাম মাহবুব কি ওর গোপন কথাগুলো বলার জন্যই আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে? এরপর কী করব আমি?

মাহবুবের কেবিনে ঢুকলাম। টের পেলাম বুকের ভেতর দমাদম পিটছে হৃৎপিণ্ড। মাহবুবের চেহারা থেকে রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ। তবে চোখজোড়া জ্বলছে। আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলাম মণির ভেতরে লাল টকটকে দুটি বিন্দু রুবির মতো জ্বলজ্বল করছে।

আমাকে দেখে ফ্যাকাসে হাসল মাহবুব। আমার মা ওর দিকে এগিয়ে গেল। ‘কেমন আছো, বাবা,’ বলতে বলতে। মাহবুব দুর্বল গলায় বলল, ‘ফয়সালের সাথে একটু কথা বলব, আন্টি। আপনারা যদি...’

মাহবুবের মা ছেলের শিয়রে বসে ছিলেন। কাঁদছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘চলেন আপা। আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। মাহবুবটা তখন থেকে ফয়সাল ফয়সাল করছে।’

মা কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন। আমি মাহবুবের মাথার কাছে বসলাম। মাহবুব আমার মাথাটা ধরল দুহাত দিয়ে, টেনে নিল ওর মুখের ওপর।

‘ওরা বলেছে আমি আর বাঁচব না,’ ফিসফিস করল মাহবুব।

‘ডাক্তাররা বলেছেন?’ ভীরু গলায় জানতে চাইলাম আমি, ওর চোখের দিকে চাইতে ভয় লাগছে।

‘না, কণ্ঠগুলো,’ বলল মাহবুব। ‘কণ্ঠগুলো বলেছে আমি মারা যাব...খুব শিগগির।’

ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি উঠে গেছে আমার, ইচ্ছে করল এক ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু মাহবুব আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওকে এভাবে রেখে যাই কী করে? ওকে আমার সাহায্য করা দরকার।

‘কোনো কণ্ঠ তুই শুনতে পাসনি, মাহবুব,’ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ‘আর চিন্তা করিস না। শিগগিরই ভালো হয়ে উঠবি তুই।’

সিধে হয়ে বসলাম আমি। মাহবুবের ম্লান চেহারায় যন্ত্রণাকাতর হাসির সঙ্গে ফুটে আছে ভয়ার্ত একটা ভাব।

‘আমি পাগল নই,’ ফিসফিস করল মাহবুব। ‘ওরা সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলে। কণ্ঠগুলো কথা বলে।’

হঠাৎ আমার ঘাড় চেপে ধরল মাহবুব, ওর মাথার কাছে নিয়ে এল মাথা। হিসিয়ে উঠল, ‘শোন!’

চিৎকার করে উঠলাম আমি। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। ওর দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, দেখি তৃপ্তির হাসি হেসে চোখ বুজল মাহবুব। কণ্ঠগুলো আমাকে বলেছে, আমি এখানে যেন বসে থাকি, বিদায় জানাই মাহবুবকে। কারণ ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার ইচ্ছে করল দৌড়ে পালাই, তাহলে সবকিছুর হাত থেকে রক্ষা পাব। কিন্তু কেউ যেন মেঝের সঙ্গে আমার পা পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে। নড়তে পারলাম না একচুল।

ভুল ভেবেছিলাম আমি। ওই কণ্ঠগুলো আমার সঙ্গেই আছে। গত দুই মাস ধরে কথা বলছে আমার সঙ্গে। ভয় পাচ্ছি আমি। কারণ ওরা যা বলছে বাস্তবে ঠিক তেমনটিই ঘটে চলেছে। ইদানীং ওরা একটা অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলছে। বোঝাতে চেষ্টা করছে অ্যাক্সিডেন্টের শিকার কে হবে। আমি বুঝে গেছি কে হবে ওদের পরবর্তী শিকার।

অলংকরণ: জুনায়েদ আজীম চৌধুরী