হ্যামিলিনের নতুন বাঁশিওয়ালা

বিষয়টি হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো। শুধু বাঁশির বদলে আমাদের জাকির হোসেনের ঝোলায় রয়েছে বই। ঝোলা নিয়ে বের হলেই তার পিছু নেয় শিশু-কিশোরের দল। সবাইকে দিতে হয় বই। এখন তিনি পাঁচ গ্রামের শিশু-কিশোরদের কাছে যেন এক নতুন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা। তাঁকে দেখলেই শিশুরা নতুন বইয়ের আশায় তাঁর পিছু নেয়।

প্রথম দিকে জাকির হোসেন শুধু শিশুদের বর্ণপরিচয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ জন্য প্রথম পড়তে শিখবে এমন দরিদ্র শিশুদের হাতের বর্ণমালার বই তুলে দিতেন। দিনে দিনে ধনী-গরিব সব পরিবারের লোকেরাই জাকিরের কাছে বইয়ের বায়না ধরতে শুরু করে। এভাবে গত আট বছর পাঁচ গ্রামের শিশুদের বর্ণপরিচয় হচ্ছে জাকির হোসেনের বই দিয়ে। সেই শিশুরা—যারা কিশোর হচ্ছে, তারা আবার জাকির হোসেনের কাছে বইয়ের জন্য বায়না ধরছে। এবার জাকির হোসেন কিশোরদের হাতেও তুলে দিচ্ছেন গল্পের বই।

জাকির হোসেনের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার লক্ষ্মণবাড়িয়া গ্রামে। পেশায় তিনি একজন পল্লি চিকিৎসক। বয়স প্রায় ৩০ বছর। জাকির হোসেন খেয়াল করেন, তাঁর এলাকার বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা একটু দেরিতে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। আবার অনেকেই যাওয়ার সুযোগই পায় না। আবার গেলেও বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে তাদের পরিচিত হতেই অনেক সময় চলে যায়। এই চিন্তা থেকে ২০০৬ সালে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ্মণবাড়িয়া গ্রামের শিশুদের মধ্যে বর্ণমালার বই তুলে দেন। সেদিন ১১৭ জন শিশু বর্ণমালার বই পায়। সেই হলো শুরু।

গত কয়েক বছরে জাকির হোসেনের এই কার্যক্রম রীতিমতো একটা আন্দলনে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে তা লক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে সাধুপাড়া, বোয়ালিয়াপাড়া, বিলটুনাপাড়া, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দীঘা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এখন আর শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতে নয়, বছরের শুরুতেই শিশুর অভিভাবকেরা জাকির হোসেনের কাছে খবর পাঠাতে শুরু করেন। তাই এখন প্রতিবছর ডিসেম্বর মাস এলেই জাকির হোসেনের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তিনি এই গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে শিশুদের তালিকা সংগ্রহ করতে শুরু করেন।

এবার কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা আগেভাগেই জাকিরের পিছু নিয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর বই কিনে বাড়ি ফেরার সময় সাধুপাড়া বাজারে একদল শিশু-কিশোর তাকে ঘিরে ধরে। বাধ্য হয়ে জাকির সেখানেই বই বিতরণ শুরু করেন। কিশোরদের জন্য তিনি নিয়ে এসেছেন ‘জানতে হলে পড়তে হবে’, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘গোপাল ভাঁড়ের গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার’ ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আছে শিশুদের জন্য বর্ণপরিচয়ের বই। কিশোরদের মধ্যে বই পেয়ে মহাখুশি সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সারোয়ার কবির, ইমুল হোসেন, তুহিন আলী, সাইদ আহাম্মেদ, নবম শ্রেণীর ফিরোজ আহাম্মেদ ও দশম শ্রেণীর ছাত্র আবদুল্লাহ। সারোয়ার জানায়, জাকির হোসেনের বই দিয়ে তার বর্ণপরিচয় হয়েছিল। এ জন্য জাকির হোসেনের কাছে তারা গল্পের বইয়ের জন্য বায়না ধরেছে। তিনি তাদের জন্য বই এনেছেন। বই পেয়ে খুব ভালো লাগছে।

দীঘা কলেজের শিক্ষক গোলাম তোফাজ্জল কবির জানান, জাকির হোসেনের এই ব্যতিক্রমী চিন্তা মানুষের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। এলাকার মানুষের মধ্যে শিশুদের পড়াশোনা নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ বিষয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। এর পর থেকে জাকির হোসেন এলাকার শিশুদের কাছে নতুন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হয়ে উঠেছেন। তাঁকে দেখলেই শিশুরা ‘বই ভাইয়া’ বলে ডাকে। জাকির হোসেন এটা খুবই উপভোগ করেন।

এই বই কেনার টাকা কোথায় পান জানতে চাইলে জাকির হোসেন হাসেন বলেন, নিজের পেশার কিছু আয় আছে। তা থেকে খরচ করেন। এ ছাড়া তাঁকে সহযোগিতা করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হাসিনা আক্তার। এটা দেখে রাজশাহীর আরও দু-একজন চিকিৎসক তাঁকে সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।