চৌধুরী সাহেব, ছোট বলে কি আমি চা খেতে পারব না?

আব্বু-আম্মুর সঙ্গে বেড়াতে গেছি আব্বুর এক বন্ধুর বাসায়। আব্বু আম্মুকে চা দেওয়া হলেও আমাকে তো দেওয়া হলোই না, এমনকি একবারের জন্য কেউ জিজ্ঞেসও করল না, খাব কিনা! খুবই অপমানজনক! সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় তিন বিলিয়ন কাপ চা খাওয়া হয়, আর আমার জন্য কিনা একটা কাপ চা বরাদ্দ হলো না, এইটা কোন কথা?

চা নাকি আমার স্বাস্থে্যর জন্য উপযোগী না। আরে বাবা, চা না দিয়ে তুমি আমাকে কী দিয়েছ? অ্যাপল জুস। তুমি কি জানো, এক কাপ সবুজ চায়ে যে পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, ১০ কাপ অ্যাপল জুসেও তা থাকে না? তুমি হয়তো জানোই না, সিডনি স্মিথ লিখেছিলেন, আই অ্যাম গ্লাড, আই ওয়াজ নট বর্ন বিফোর টি। আর আমি কিনা চা আবিষ্কারের পরে জন্মেও চা থেকে বঞ্চিত হলাম। দুঃখজনক।

নেদারল্যান্ডসে পাঁচ-ছয় বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে দু-তিন কাপ চা খায় তাদের হার্ট অ্যাটাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি যারা একদমই চা খায় না তাদের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কম। চা হাড়কে শক্তিশালী করে, চিনি ছাড়া চা পান দাঁতকেও সুন্দর করে, সাহায্য করে খাদ্য পরিপাকেও।

সাধে কি আর চাচায় চা চায়? কিন্তু চাচি চেঁচায় কেন বুঝি না? চাচি কি জানে না, চায়ের ক্ষমতা আলু ফালু কালুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়! এই বীর যোদ্ধা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তো রাখেই, একই সঙ্গে সে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ায়। আমরা অনেক সময় দেখি, লোকে চায়ের দোকানে র চা চাইতে চেঁচায়, চাচা রং চা দেন। ভাবটা এমন, রাইট চা নামে আরেক ধরনের চা আছে! অথচ রং চা খাওয়াই কিন্তু বেশি সঠিক। এতে ক্যালরি কম থাকে। সত্যি বলতে কি, দুধ চিনি না দিলে চায়ে ক্যালরি থাকে না বললেই চলে।

চা আড্ডাকে করে আরও জমজমাট
চা আড্ডাকে করে আরও জমজমাট

 নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন -এ ৪৭ বছর বয়সী এক নারীকে নিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল। যেখানে উঠে এসেছে, বেশি চা পানের জন্য ওই নারীর হাড়গুলো একেবারেই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল, সবগুলো দাঁতও পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তিনি গড়ে প্রতিদিন মাত্র ১০০-১৫০টি টি ব্যাগ একাই সাবাড় করতেন। তুমি তো একটাই পাচ্ছ না, তাই না? আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কী? ছেলেরা যদি প্রতিদিন সাত-আট কাপের বেশি চা ২৮ বছরের বেশি সময় ধরে খায়, তবে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, সুতরাং ২-৩ কাপের বেশি না খেলেই হলো।

একদিন হলের ক্যানটিনে বসে আছি, হঠাৎ এক বড় ভাই এসে চাওয়ালাকে বললেন, ‘মামা, দুধ চা হবে?’ চাওয়ালা বলল, ‘না মামা, দুধ চা হইব না, রং চা দিমু?’

বড় ভাই চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘কী আর করা। দুধ-চিনি বাড়াইয়া একটা রং চা-ই দেন।’

মেডিকেলে পড়ার সময় এই ক্যানটিনে বসে অনেক চা খেয়েছি, দুধ চা, রং চা, কফি মেশানো চা, আদা চা, লেবু চা, মালটোভা মেশানো চা কিংবা হরলিকস মেশানো চা। কাগজে-কলমে কিন্তু চায়ের এমন কোনো প্রকারভেদ নেই, চা অনেক ধরনের হয়, তবে প্রচলিতগুলো হলো হোয়াইট টি, গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, অলঙ্গা টি ইত্যাদি।

এই ক্যানটিনেই এক দিন অসময়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী আছে?

মামা বললেন, ‘চা’। আমি বললাম, ‘ঠান্ডা কিছু নাই?’ মামার নির্লিপ্ত জবাব, ‘পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন, চা-ই ঠান্ডা হবে।’ কিছু বললাম না, কারণ এক জায়গায় পড়েছি, বেশি গরম চা খাদ্যনালির ক্যানসার তৈরি করতে পারে। চাটাই খুব বেশি গরম খাওয়াটা অনুচিতই হবে।

ছোটবেলায় চা থেকে যেটুকু বঞ্চিত হয়েছিলাম, তার প্রায় সবটুকু হলের ওই ক্যানটিনে বসেই উশুল করে নিয়েছি। এই আশায় যে, গবেষক ডেনিস তিরান লিখেছিলেন, ‘গড়পড়তায় একজন মানুষ যে পরিমাণ চা খায়, সে পরিমাণে খেলে দেহের ক্ষতি হয়, এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। এক দিনে তুমি কতই-বা চা খাবে, বড়জোর এক গ্যালন চা, তাতেও তুমি ভালোই থাকবে।’ কথাটা ফালতু কথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস পাইনি, লেখাটা যে ছেপেছিল ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন।’

উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন বলেছিলেন, তোমার যদি ঠান্ডা লাগে, চা তোমাকে গরম করবে। তোমার যদি মাথা গরম হয়ে যায়, চা তোমাকে ঠান্ডা করবে। তুমি যদি মনমরা হয়ে থাকো, চা তোমাকে উচ্ছ্বাস দেবে। তুমি যদি অতি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়, চা তোমাকে শান্ত করবে।

এক লোক গেল চোখের ডাক্তারের কাছে, ‘স্যার, আমি চা খাওয়ার সময় চোখে খুব ব্যথা পাই।’

ডাক্তার বললেন, ‘তাহলে কী আর করা, চা খাওয়া বন্ধ করে দিন।’

লোকটি কাকুতি করে বলল, ‘কিন্তু আমি তো চা খুব পছন্দ করি।’

ডাক্তার বললেন, তাহলে চা খাওয়ার সময় কাপ থেকে চামচটা সরিয়ে নেবেন।

বুঝলে তো। সবই করবে, তবে একটু চোখ-ক্যান খোলা রেখে। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের কথাটাও কানে ঢুকিয়ে রাখতে পারো। তারা মনে করে, চাকে ভালো কিংবা ক্ষতিকর কোনটা নিশ্চিত করে বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ নাকি এখনো পাওয়া যায়নি। সুতরাং, সবকিছু মাথায় রেখে, দিনে দু-এক কাপ চা খাওয়ার মধ্যে সীমিত থাকলেই মনে হয় আখেরে ভালো হবে। ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা, রাস্তাঘাট, ফুটপাতের মতো যত্রতত্র চা খাওয়ার অভ্যাস করা যাবে না। এতে পেটের পীড়া কিংবা জন্ডিসের মতো নানা রোগ হতেই পারে।

রাস্তার পাশের এক চায়ের স্টলে দুই বন্ধু বসল। একটা ছোট ছেলে এসে তাদের জিজ্ঞেস করল, ‘মামা কী লাগবে।’

প্রথম বন্ধু বলল, ‘আমাকে চা দাও।’

দ্বিতীয় বন্ধু বলল, ‘আমাকেও, কাপ ভালো করে পরিষ্কার করে দিয়ো।’

কতক্ষণ পরে ছেলেটি দুই কাপ চা নিয়ে এসে বলল, ‘এই নিন চা, কে পরিষ্কার কাপ চেয়েছিলেন?’

বুঝলে তো। বুঝলে না?

ছবি: কবীর শাহরীয়ার

মডেল: আদিবা, আবরার ও সাবিন