বিশ্ব কাঁপবে যে কাপে

বিশেষ বিমানে করে বাংলাদেশ ঘুরে গেল বিশ্বকাপ ট্রফি
বিশেষ বিমানে করে বাংলাদেশ ঘুরে গেল বিশ্বকাপ ট্রফি

তাঁকে একপলক দেখার জন্য বাইরে মানুষের লম্বা সারি। টিকিট হাতে নিয়েও ভেতরে ঢুকতে নিষেধের বেড়াজাল। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বচসা হচ্ছে অনেকের, জাতীয় দলের কোনো এক ফুটবলারের সঙ্গে হচ্ছে ধস্তাধস্তি। তাঁর উজ্জ্বল সোনালি আলোর ছটা কোনো শিশুর চোখে জাগিয়ে তুলছে স্বপ্নমাখা আগামী। আর তিনি হোটেল র‌্যাডিসনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, নিভৃতে বসে আছেন একটা কাচঘেরা কুঠুরিতে।

ইনি বিশ্বকাপ ট্রফি। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, বিখ্যাত ট্রফি। এতই বিখ্যাত যে ১৮ ক্যারেট সোনায় গড়া ৩৬.৮ সেমি উঁচু, ৬.১৭৫ কেজির ট্রফিটিকে মহামূল্যই শুধু নয়, মহামান্য জ্ঞান করা হয়!

বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে ট্রফিটি তিন দিন আতিথ্য নিল বাংলাদেশে। ১৭-১৯ ডিসেম্বর—এই তিন দিন রুদ্ধ বাংলাদেশ এটিকে ঘিরেই ভাসল আনন্দে। বিজয়ের অহংকারে এই ট্রফিটাই হাতে তুলেছেন বেকেনবাওয়ার, দিনো জফ, পাসারেলা, ম্যারাডোনা, ম্যাথাউস, দুঙ্গা, দেশম, কাফু, ক্যানাভারো এবং সর্বশেষ ক্যাসিয়াস। ২০০২ বিশ্বকাপের আগেও একবার বিশ্বকাপ ট্রফি এসেছিল বাংলাদেশে। ‘আসল’ ‘আসল’ হইচই তোলা হলেও সেটি ছিল আসলে নকল ট্রফি। আসল ট্রফিটা হাতে নেওয়ার প্রথম অধিকার বিশ্বকাপ বিজয়ী অধিনায়কের, দ্বিতীয়ত তাঁর সতীর্থদের। আর তুলতে পারেন স্বাগতিক দেশের নির্বাচিত শুভেচ্ছাদূতেরা। ভ্রমণকালে আসল ট্রফি হাতে নেন কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যেমন নিলেন কেবল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আসল ট্রফির বিশ্ব পরিভ্রমণ শুরুই হয়েছে ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে। সেবারের ভ্রমণ ছিল ২৮ দেশে, ২০১০-এ ৮৪ দেশে আর এবারের ভ্রমণের আওতায় ৮৮ দেশ। ১২ সেপ্টেম্বর, রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত ক্রাইস্ট ডি রিডিমার মূর্তির পাদদেশ থেকে শুরু এই ভ্রমণ এক লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। পৃথিবীর ব্যাসের তিন গুণ দূরত্ব! এর মানে কি তাহলে এই, ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীকে ভাসাবে তিন গুণ আনন্দে?

ব্রাজিলের সবুজ-হলুদে ভরা পতাকার মাঝখানে নীল গোলকটি কি ফুটবলেরই প্রতীক! মোটেই তা নয়, এটি হলো সাবেক রাজধানী রিও ডি জেনিরোর আকাশ, যেখানে খচিত ২৭টি রাজ্য নির্দেশক ২৭টি তারকা। সে যা-ই হোক, সর্বাধিক পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ফুটবলের দেশ বলতে আপত্তি নেই কারোরই। আয়তন ও জনসংখ্যায় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশটি ফুটবলে খায়, ফুটবলে ঘুমায়, নিঃশ্বাসই ফেলে ফুটবলে। এই দেশে ফুটবলের মহাযজ্ঞ তিন গুণ আনন্দেরই বার্তা দেয়। এর আগে ১৯৫০ বিশ্বকাপ ব্রাজিলকে ডুবিয়েছিল শোকে, আয়োজকদের উঠোন থেকে সদর্পে বিশ্বকাপ জিতে ফিরেছিল প্রতিবেশী উরুগুয়ে। পেলে, গারিঞ্চা, ভাভা, ডিডিরা ব্রাজিলের সেই দুঃখে পরে প্রলেপ বুলিয়েছেন তিনবার বিশ্বকাপ জিতে, জুলে রিমে ট্রফিকে নিজেদের করে নিয়ে। ফিফাকে তাই গড়তে হয়েছে আরেকটি নতুন ট্রফি। এই ট্রফিটাও দুবার জিতেছে রোমারিও-রোনালদো-রিভালদোর ব্রাজিল। এটাই সেদিন দর্শন দিয়ে গেল বাংলাদেশকে।

ব্রাজিলিয়ানরাই বিশ্বের সবচেয়ে বর্ণময় ফুটবল-সমর্থক। তাদের সাম্বা নাচের তালে মাতাল হয় স্টেডিয়াম। সমর্থকদের মতোই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা মাঠেও খেলেন ছন্দময় ফুটবল। এবার সাম্বার দেশেই বিশ্বকাপ। যার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ৬৩ বছর। ২০১৪ বিশ্বকাপ তাই স্বপ্নের বিশ্বকাপ। ফুটবলের পৃথিবীতে তাই আগেই বাজছে মাদল। ফিফার অতি আপন পৃষ্ঠপোষক কোকাকোলা কেন নয় মাস আগেই ট্রফি নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোল বুঝতে পেরেছেন?

একটির নটে গাছ মুড়োতেই ক্ষণগণনা শুরু হয় চার বছর পরের বিশ্বকাপের। প্রথম ধাপ অবশ্যই বাছাই প্রতিযোগিতা শুরু। একসময় আয়োজক বাদে বেছে নেওয়া হয় বাকি ৩১ দলকে। তারপর প্রতীক্ষা সেই ড্র নামের ভাগ্য পরীক্ষার। ড্র আর সূচি তৈরি হয়ে গেলেই ফুটবলানুরাগীর শরীরে ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপের উত্তেজনা।

৬ ডিসেম্বর, ব্রাজিলেই হলো ড্র। ‘এ’ থেকে ‘এইচ’—৪টি করে দলকে নিয়ে হলো আটটি গ্রুপ, যেমন করে হয়ে আসছে সেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে। অনিশ্চয়তার দোদুল দোলায় দলগুলোর নাম তুললেন বিশ্বকাপজয়ী আট দেশের আট প্রতিনিধি—আলসিডেস গিঘিয়া, জিওফ হার্স্ট, জিনেদিন জিদান, কাফু, ক্যানাভারো প্রমুখ। প্রতিটি বিশ্বকাপেই একটা করে কঠিন গ্রুপ হয়, যেটি ডেথ গ্রুপ বা মৃত্যুকূপ। মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে যেমন দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যেতে পারে যেকোনো দুটি দল, আবার সেই দুটিরই হতে পারে স্বখাতসলিল। একটি নয়, দুটি নয়, ২০১৪ বিশ্বকাপ মৃত্যুকূপ পেল তিনটি। এক নম্বর মৃত্যুকূপ অবশ্যই ‘ডি’ গ্রুপ, যেখানে তিন সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে, ইতালি ও ইংল্যান্ডের সঙ্গী কোস্টারিকা। জার্মানি, পতু‌র্গাল, ঘানা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ ‘জি’কেও ‘ডেথ গ্রুপ’ না বলে উপায় নেই। গত বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট স্পেন ও হল্যান্ডের দেখা হয়ে যাচ্ছে এবার প্রথম রাউন্ডেই, ‘বি’ গ্রুপে এদের সঙ্গী অন্য দুই দল চিলি ও অস্ট্রেলিয়া। ‘এ’ গ্রুপে ব্রাজিলের সঙ্গী ক্রোয়েশিয়া, মেক্সিকো ও ক্যামেরুন। বলা হচ্ছে সহজ গ্রুপ, আসলেই সহজ?

ড্রয়ের মধ্যে পুরোনো রাগ-অনুরাগের কেমন একটা পিছুটান যেন থাকে।  না হলে আর্জেন্টিনা কেন চতুর্থবারের মতো পাবে নাইজেরিয়াকে? ‘এফ’ গ্রুপে আর্জেন্টিনার অন্য দুই প্রতিপক্ষ বসনিয়া ও ইরান। গতবারের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্র ও ঘানাকে পেয়েছে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এই গ্রুপ দেখবে অনেক নাটক। দুই জার্মান কোচ দাঁড়াবেন মুখোমুখি। ২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিনসমান এবার যুক্তরাষ্ট্রের কোচ, আর তাঁরই সেই সময়কার সহকারী জোয়াকিম লো নামবেন জার্মানিকে নিয়ে। গত বিশ্বকাপের মতো এবারও দুই শত্রুশিবিরে দুই ভাই—জার্মানির পক্ষে জেরোম বোয়াটেং আর ঘানার কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং।

ড্রয়ের পরই কোনো গ্রুপ ছড়িয়ে দিয়েছে উত্তেজনার বারুদ। ইরানিদের প্রিয়তম আন্তর্জাতিক ফুটবলার মেসিকে তাদের শত্রু বানিয়েছে এই ড্র। আর্জেন্টিনার মেসির হাতে যে ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা আছে ইরানের! সেদিক দিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ভাগ্য খারাপ। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র বা ঘানা মেসির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে কিন্তু বেশি গোল পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না।

আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপের কেউই জিততে পারেনি বিশ্বকাপ। অথচ অন্য মহাদেশ থেকে শিরোপা জিতে এনেছে দক্ষিণ আমেরিকার একটিই দল। ব্রাজিল। নিজেদের মাঠে এবার তাহলে ব্রাজিলই? ১৩ জুলাই মারাকানার ফাইনালের আগেই মিলে যেতে পারে উত্তর। তবে এক বছর আগে যে ব্রাজিলকে শিরোপার অন্যতম দাবিদার বলতেও সংশয় জাগত, এখন সহস্রকণ্ঠ নাম বলছে তাদেরই। একটি বিষয় অবশ্য নিশ্চিত, ব্রাজিলের হাতে শিরোপা-ষষ্ঠক উঠুক না উঠুক, ২০১৪ বিশ্বকাপ ছুঁয়ে যাবে রোমাঞ্চের সবটুকু। সেই রোমাঞ্চ-নদীতে ডুব দেওয়ার শুরু আগামী ১২ জুন থেকে, যেদিন সাও পাওলোতে রাত দুইটায় মুখোমুখি হবে ব্রাজিল ও ক্রোয়েশিয়া।