হিসাবের শব্দ

কালে কালে বদলেছে বাঙালির হিসাব-নিকাশের পদ্ধতি। তাতে অবশ্য হিসাবের তেমন অসুবিধে হয়নি। তবে হেরফের ঘটেছে হিসাবসম্পর্কিত বেশ কিছু শব্দের অর্থের। কিছু শব্দ তাদের নিজস্ব অর্থ হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছে অভিধানের পাতায়। কিছু শব্দ মূল অর্থ পরিত্যাগ করে কালের রহস্যে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ ধারণ করে বসে আছে। আজকের অভিধানের গল্প হিসাব-নিকাশের ও মাপ-পরিমাপের বেশ কিছু শব্দ নিয়ে।

নিমেষ

নিমেষ হলো পলক; চোখের পাতার স্পন্দন; চোখের পাতা ফেলার মধ্যবর্তী সময়; মুহূর্তকাল; অতি অল্প সময়।

নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে থাকার অর্থ পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা। পলক শব্দটি ফারসি। বর্তমানের অর্থে পলক ও নিমেষের তেমন কোনো ফারাক নেই, তবে প্রয়োগের বেলায় খানিকটা আছে। চোখের নিমেষে এবং চোখের পলকে দুটোই চলে। কিন্তু চোখের নিমেষ পড়ছে না, চলে না। বলতে হয়, চোখের পলক পড়ছে না। চোখের পলক ফেলতে না-ফেলতে কাজটা শেষ হয়ে গেল—এখানে পলকের বদলে নিমেষ অচল।

নির্নিমেষ নয়নে মানুষ কতটা সময় চেয়ে থাকে, কেউ তার হিসাব করে না। নির্নিমেষ নয়নে কেবলি চেয়ে থাকে তখন, যখন চেয়ে থাকার মতো কিছু সামনে থাকে।

সময়ের আভিধানিক হিসাবে ১৬ মিনিটের এক নিমেষ।

ক্ষণ

ক্ষণ হলো কালের ক্ষুদ্র অংশ বা অতি অল্প সময়। তবে তা কতটা সময়, তার খবর রাখার প্রয়োজন আমাদের হয় না। ক্ষণস্থায়ী—কতটা সময় ধরে স্থায়ী; ক্ষণভঙ্গুর—কতক্ষণ পরে জিনিসটা ভাঙবে, আমরা কি তার জন্য বসে থাকি? এতক্ষণ, কতক্ষণ—কতটা সময়, আমরা তার হিসাব আর করি না।

তবে ক্ষণেরও নির্দিষ্ট হিসাব আছে। ক্ষণ হলো নিমেষের এক-চতুর্থাংশ সময় অর্থাৎ চার মিনিট। তবে জ্যোতিষশাস্ত্রে ক্ষণের কালসীমা হলো ৪৮ মিনিট।

দণ্ড

দণ্ড শব্দটি এখন অনেক অর্থ বহন করে। দণ্ড শব্দের সাধারণ অর্থ হলো দমনসাধন বস্ত্ত—অর্থাৎ যার দ্বারা দমন করা যায়। দণ্ডের আঘাতে প্রাণীমাত্রই সহজে দমিত হয়। সোজা কথায়, দণ্ড শব্দের অর্থ হলো লাঠি। অন্যদিকে দণ্ড বলতে জরিমানাও বোঝায়। দাঁড়ানো অবস্থা বোঝাতে দণ্ডায়মান বলে যে শব্দটা রয়েছে, সেটাও এসেছে দণ্ড থেকে।

তবে দণ্ডের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়কালও বোঝানো হয়ে থাকে। প্রাচীন ভারতে খাড়াভাবে স্থাপিত দণ্ডের ছায়া মেপে সময় নির্ণয় করা হতো। দণ্ডের ছায়া পরিমাপ করে হিসাব হতো—এক দণ্ড, দুই দণ্ড ইত্যাদি। মানুষ এখনো বলে, একদণ্ড ফুরসত নেই কিংবা দু দণ্ড অপেক্ষার কথা।

আভিধানিক হিসাবে দণ্ডের সময়ের মাপ হলো ২৪ মিনিট।

মুহূর্ত

যখন বলি মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল, তখন মুহূর্ত কতটা সময়, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। ভাবি না, সবকিছু শেষ হয়ে যেতে কতটা সময় লাগে। মুহূর্তকে যতই হ্রস্ব করে দেখার চেষ্টা করি না কেন, মুহূর্তের সীমাটা বেশ খানিকটা দীর্ঘ।

বারো ক্ষণ বা দুই দণ্ড অর্থাৎ এখনকার ৪৮ মিনিটে এক মুহূর্ত।

প্রহর

দিনরাতের ভাগকে আমরা প্রহর বলে জানি। কিন্তু প্রহরও যে নির্দিষ্ট সময়সীমায় আবদ্ধ, সে ব্যাপারটা আমরা ভুলে যাই। এক প্রহর হলো তিন ঘণ্টা।

আমরা আটপৌরে পোশাকের কথা বলি। আটপৌরে কথাটার অর্থ হলো অষ্ট বা আট প্রহর, যা পরে থাকা হয়। অষ্ট বা আট প্রহর হলো এক দিন ও এক রাত—অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা।

পল

সময়ের অংশ হিসেবে পল শব্দটা বাংলায় এখন অচল। তবে হিন্দিতে বেশ সচল। হিন্দি সিনেমার গানে পল শব্দটার বেশ ব্যবহার রয়েছে। পল হলো দণ্ডের ৬০ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ এক পল হলো ২৪ সেকেন্ড।

ক্রোশ

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে—

বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে

বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে

দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা

দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।...

রবীন্দ্রনাথের আমলের এই ক্রোশ শব্দটা এখন অচল ইংরেজি মাইল আর হাল আমলের কিলোমিটারের দাপটে। তবে গ্রামবাংলায় কোথাও কোথাও এখনো ক্রোশ শব্দটা চলে। কতটা দূরত্বে এক ক্রোশ হয়, তার বেশ বিচিত্র হিসাব রয়েছে। ক্রোশ হলো রৈখিক মাপের হিসাব। সে হিসাবে তিন আঙুলে হয় এক মুষ্টি; তিন মুষ্টিতে এক বিঘত; দুই বিঘতে এক হাত, চার হাতে এক ধনু, কুড়ি ধনুকে এক রশি আর দুই হাজার ধনুতে এক ক্রোশ। এখনকার সময়ের হিসাবে প্রায় আড়াই কিলোমিটারে এক ক্রোশ।

যোজন

বাঙালির রৈখিক মাপের যোজন শব্দটি এখন কবিতার শব্দ। কবিতায় যোজন যোজন পথ অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যায়। যোজন শুনলেই মনে হয়, না জানি কী বিশাল দূরত্ব। তবে যোজনের দূরত্বটা অত বিশাল নয়। আভিধানিক হিসাবে চার ক্রোশে হয় এক যোজন।