বাটুল শাহ

গ্রামের সবাই বাটুল শাহকে এক নামে চেনে। এটা নকল নাম। আসল নাম কেউ জানে না। উচ্চতা তিন ফুট দুই ইঞ্চি হওয়ায় কেউ একজন তাকে বাটুল শাহ বলে ডাকতে শুরু করে। একান-ওকান হয়ে শেষে জাতীয় পরিচয়পত্রেও চলে গেছে নামটা। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত লোকে লম্বা হয়। এরপর আরও বত্রিশ বছর কেটেছে। এক ইঞ্চিও বাড়েনি বাটুল শাহ।

লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে কাজ করে বাটুল শাহ। উচ্চতা কম বলে কেউ কাজ দিতে চায় না। মিষ্টির দোকানদার কাজ দিয়েছে, কারণ বাটুল শাহর ডায়াবেটিস আছে। চুরি করে মিষ্টি খাবে না।

বাটুল শাহর মনে বেজায় দুঃখ। সুযোগ পেলে পাড়ার ছেলে থেকে শুরু করে বুড়োরাও খেপায়। স্কুলের হেডমাস্টার সেদিন বললেন, ‘আহা বাটুল, তুমি তো কলেজ পর্যন্ত পড়েছ। প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারিও তো করতে পারো। ওহ না! তুমি তো ব্ল্যাকবোর্ডের নাগালই পাবে না। হো হো হো।’ বাটুল শাহও হাসে। রাগে কিড়মিড় করে হাসে। দোকানে ডিউটি করা অবস্থায় কারও সঙ্গে রাগ করলেই চাকরি নট। চাকরি ছাড়া এই দুনিয়ায় বাটুল শাহর কেউ নেই।

বাটুল শাহ নিয়মিত পত্রিকা পড়ে। বিজ্ঞানের খবরগুলোই পড়ে আগে। মনে সুপ্ত আশা, নিশ্চয়ই বিজ্ঞানীরা এমন কিছু আবিষ্কার করবে, যেটা খেলে দুই দিনে বাটুল শাহ লম্বা হয়ে যাবে। কিন্তু অলস আর বোকা বিজ্ঞানীগুলো এমন কিছুই বানাতে পারল না। ‘ক্যানসারের বাড় পর্যন্ত বাইর অইয়া গেল, অথচ লম্বা অওনের কোনো বড়ি নাই।’ প্রতিদিন পত্রিকা পড়া শেষে এ কথা বলে আক্ষেপ করে বাটুল শাহ। আজকেও বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নজরে পড়ল বিজ্ঞাপনটা।

 বেঁটেত্বের অভিশাপ আর নয়বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মানুষের কল্যাণে গুণগত মান নিশ্চিত করে আমি তৈয়ারি করেছি আশ্চর্য সুধাসেবনে লম্বা নিশ্চিতপ্রতি ফাইল ১৫৫১ টাকাডাকযোগে প্রাপ্তি নিশ্চিতে কল করুন

নম্বরটা টুকে নিয়েই বের হলো বাটুল শাহ। ডিউটি পরে, আগে লম্বা। কল দিতেই এক মেয়ের কণ্ঠ। ‘কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ ‘জি, আমি বাটুল শাহ। আমার তিন বোতল আশ্চর্য সুধা লাগব।’ এরপর মেয়েটা বাটুল শাহকে একটা ব্যাংক একাউন্ট নম্বর দিল। ওই একাউন্টে টাকা জমা দিলেই তিন দিনের মধ্যে ডাকযোগে পৌঁছে যাবে ওষুধ।

দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের সব টাকা খরচ করে তিন দিন দম আটকে পড়ে রইল বাটুল শাহ। আজ ডিউটিতে যায়নি। আজ একটা বিশেষ দিন।

দরজায় কড়া নাড়তেই বাটুল শাহর বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। সাইকেলের টুংটাং শব্দটা বুকের মধ্যে বেজে উঠল। আহা! পিয়নের মতো ভালো মানুষ আর নেই!

প্রথম বোতল এক চুমুকেই শেষ। দ্বিতীয় বোতলটা ধীরে-সুস্থে। পেটে জায়গা নেই। ধীরে ধীরে চুমুক দিল। ঝাঁজালো স্বাদ। একটু তেতো। কিন্তু বাটুল শাহর কাছে এখন এসব নস্যি। পেট ফুলে ঢোল। তৃতীয় বোতলে শেষ চুমুক দিয়েই বিশাল ঢেকুর তুলল। বোতলটা টেবিলের ওপর রাখতেই নজরে পড়ল প্যাকেটের সঙ্গে থাকা চিরকুটের মতো কাগজটা। ‘আট ঘণ্টা পর পর চার চা-চামচ করে বোতল শেষ না হওয়া পর্যন্ত খাবেন। পরবর্তী ডোজের জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করিবেন।’ বাটুল শাহর পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। ‘কী মুশকিল, অহন কী করি!’ তিনবার পড়ল লেখাটা। পর পর তিন বোতল খেলে কী হবে, তা লেখা নেই। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠতেই দুম করে বিছানায় পড়ে গেল। ঘরর ঘরর করে নাক ডেকে বুঝিয়ে দিল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।

ঘুম ভাঙে পরদিন ভোরে। অভ্যাসবশত আড়মোড়া ভাঙলো। ধুড়ুম ঠন ঠন ক্যাঁচ ক্যাঁচ পটাশ! আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে মিটসেফে রাখা একটা কাচের বাটি থেকে শুরু করে ঘরের বেড়াটাও ভেঙে ফেলল বাটুল শাহ। শরীর টান টান করতে গিয়ে টের পেল পায়ের ওপর কড়া রোদ। উফ্ফ পুড়ে গেল রে বলে যেই উঠে বসল, অমনি ঠং করে বাড়ি খেল টিনের চালে। সব এমন ছোট ছোট কেন! দুই হাত দুপাশের দেয়াল ভেদ করে বাইরেই বা যাবে কেন? এ কার ঘর! মেঝেতে রাখা বিশ বছরের পুরোনো পানির কলসটা তো বাটুল শাহরই। নাহ, নিজের ঘরেই আছে। মাথা নিচু করে লম্বা করে হাই তুলল বাটুল শাহ। কিন্তু ঘর থেকে বের হতে গেলে ছাদ ফুটো করতেই হবে। উপায় না দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। টিনের চাল মাথায় নিয়ে অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল। তাকে ঘিরে আছে সমগ্র গ্রামবাসী। সবাই এত ছোট কেন! এদিক-সেদিক তাকাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। কেউ ছোট হয়নি, বাটুল শাহই লম্বা হয়ে গেছে।

কত লম্বা? নিজে নিজে মাপার চেষ্টা করল। বুঝতে পারল না। অনেক লম্বা। বাড়ির সামনের আমগাছটা বুকসমান। দোকানপাট, বাড়িঘর সব খেলনা খেলনা। গ্রামের লোকজন ভয়ে এক শ হাত দূরে। বাটুল শাহ কিছু বলতে গেলেই সবাই ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিচ্ছে। সাহসী দু-একজন চিৎকার করে জানিয়ে দিল, বাটুল শাহ যদি কারও ক্ষতি না করে, তবে তাকে নাশতা হিসেবে এক শ পরোটা খেতে দেওয়া হবে। বাটুল শাহ জীবনে একটা মাছিরও ক্ষতি করেনি (মিষ্টি খেতে দেখলেও তাড়িয়ে দেয় না)। সেই বাটুল শাহ গ্রামবাসীর কী ক্ষতি করবে!

এক শটা পরোটা দিয়ে নাশতা সেরে গ্রামের ঈদগাহ মাঠে চুপচাপ বসে আছে বাটুল শাহ। তার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে অনেকে। ভাবতেই কষ্টে বুকটা চিঁ চিঁ করে উঠল। ডুকরে কেঁদে উঠল। এতটা লম্বা সে হতে চায়নি। এখন আর কী করবে। লম্বা হওয়ার ওষুধ আছে, বেঁটে হওয়ার তো নেই! আজীবন এভাবে থাকতে হবে ভেবে চোখ উপচে পানি বেরিয়ে এল বাটুল শাহর। এমন সময় পায়ের কাছে কে যেন খোঁচা দিল। একটা ছেলে! বয়স আট-দশ হবে। একটুও ভয় পেল না!

‘ওই লম্বু মিয়া, তোমার নাম তো বাটুল শাহ। তোমারে আমি চিনসি।’

‘হে হে। ঠিক কইসো। আমার নাম বাটুল শাহ। তালগাছের সমান লম্বা হইলেও আমার নাম বাটুল শাহ।’

‘কতা পরে হইব। আগে আমার কাম কইরা দেও।’

‘কী কাম?’

‘কালিপাড়ার তালগাছের ডগায় কিরকেট বল আটকাইয়া গেছে। পাইড়া দেও।

অন্যের উপকারে সদা প্রস্ত্তত বাটুল শাহ। সুযোগ পেয়ে ধুড়ুম করে দাঁড়িয়ে গেল।

‘একখন দিতাসি। চলো!’

তালগাছের আগা থেকে ক্রিকেট বল পেড়ে দিতেই দ্বিতীয় অনুরোধটা করল আরেক শিশু। তার রাবারের বলটা পুকুরের ওই মাথায় চলে গেছে। বাটুল শাহ পুকুরের এ মাথায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়েই দুই আঙুলের মাথায় বলটা তুলে আনল। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল বল্টুর, বাটুল শাহ কোলে নিয়ে এক দৌড়ে স্কুলে নামিয়ে দিল। দশ সেকেন্ডও লাগল না। হারু মাঝির বউ এসে বলল, ডালে দেওয়ার জন্য আম লাগবে। কিন্তু আম পেড়ে দেওয়ার কেউ নেই। গাছ থেকে টমেটো তোলার মতো করে আমগাছ থেকে টপাটপ আম ছিঁড়ে নিল বাটুল শাহ। এ কান-ও কান হয়ে শেষে বাটুল শাহর গল্প পৌঁছে গেল সবার কানে। এখন গ্রামবাসীর উপকার করেই দিন কাটে তার। তাকে নিয়ে গ্রামে মঞ্চনাটকও হয়েছে। নাটকের নাম  বাটুল শাহজ ট্রাভেলস

এভাবে কেটে গেল ছয় মাস। একদিন যথারীতি ঘুম থেকে উঠে মোড়ের দোকানে গেল পরোটা খেতে। এক শটা পরোটার অর্ডার দিতেই দেখল, দোকানি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা ধরতে পারল না বাটুল শাহ। গুনে গুনে তিনটে পরোটা খেতেই দেখল খিদে চলে গেছে। পেটে হাত দিতেই চমকে উঠল। আরে! পেট এত ছোট কেন! আরে! সব এত বড় হয়ে গেল কী করে! দোকানদার বাটুল শাহর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাটুল শাহ না তুমি! এত দিন কই ছিলা?’

বাটুল শাহ আবার বেঁটে হয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল ওষুধের সঙ্গে আসা সেই চিরকুটের কথা। ছয় মাস পর দ্বিতীয় ডোজ খাওয়ার কথা। উল্টোপাল্টা খাওয়ার কারণে ওষুধের প্রভাব কেটে গেছে মনে হয়। সারা দিন এদিক-ওদিক ঘুরল। সবাই পুরোনো বাটুল শাহকে আবার খেপাতে লাগল। কেউ বুঝতেই পারল না যে এই বাটুল শাহই কদিন আগে সবার উপকার করে বেড়াত। রাগে দুঃখে বাটুল শাহ প্রথম কয়েক ঘণ্টা কারও সঙ্গে কথাই বলল না। নিজের পুরোনো ঘরে ফিরে বিছানায় গোমড়া মুখে বসে রইল।

ঘণ্টা খানেক পর দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। সেই ছোট্ট ছেলেটা।

‘কী চাই বাবু!’

‘কালিপাড়ার তালগাছে কিরকেট বল আটকাইসে।’

বাটুল শাহ মনে মনে কী যেন ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়াল। বাটুল শাহ যে আবার বেঁটে হয়ে গেছে, এটা বোধহয় বুঝতে পারেনি ছেলেটা। তালগাছের ডগায় এখন আর হাত পৌঁছাবে না। তাই তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে গেল আগায়। ক্রিকেট বলটা পেড়ে দিতেই আরেকটা বাচ্চা এসে ধরল, ‘আমার পেলাস্টিকের হাঁসটা পুকুরের হেই পাড়ে গেসেগা। আইনা দাও।’ বাটুল শাহ ঝাঁপ দিল পানিতে। তরতর করে সাঁতরে গিয়ে নিয়ে এল খেলনা হাঁস। ছেলেটা খুশি, বাটুল শাহও খুশি। এভাবেই আবার এ-কান ও-কান হয়ে বাটুল শাহর কথা সবাই জেনে গেল। বাটুল শাহ লম্বা না বেঁটে, এখন আর এ নিয়ে কারও চিন্তা নেই। যেকোনো কাজে বাটুল শাহর ডাক পড়বেই। বাটুল শাহও বুঝে গেছে, জীবনে লম্বা হওয়াটাই বড় কথা নয়।

 অলংকরণ: তুলি