বোসন কণার ঈশ্বর সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সত্যেন্দ্রনাথ বসু
সত্যেন্দ্রনাথ বসু

 সত্যেন্দ্রনাথ বসু। একজন ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী, যাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিদ্যা। কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী শুধু বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, সারা জীবন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন। তাঁর মতে, যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।

১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু এবং মাতা আমোদিনী দেবী। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়।

তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার সাধারণ একটি বিদ্যালয়ে। তাঁর ছাত্রজীবন নিয়ে অনেক বিস্ময়কর উপকথা প্রচলিত আছে। স্কুলে পড়ার সময় একবার গণিত পরীক্ষায় তিনি ১০০-তে ১১০ পেয়েছিলেন। এই অসম্ভব ব্যাপারটি কীভাবে ঘটল, সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি প্রতিটি সমাধান সঠিক তো করেছেনই, আবার একটার সমাধান করেছেন দুইভাবে। তা দেখে শিক্ষক খুশি হয়ে ১০ নম্বর বেশি দিয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন এবং ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই কলেজে তিনি সান্নিধ্যে আসেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বসুর। ১৯১৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে ১৯১৫ সালে তিনি সেখানে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নীতি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্রতিপাদন করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন এবং সদৃশ কণার ( Particle) সাহাযে্য দশার ( Phase) সংখ্যা গণনার একটি চমৎকার উপায় উদ্ভাবন করেন। এটি ছিল মৌলিক নিবন্ধ এবং কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ভিত্তি রচনাকারী। নিবন্ধটি প্রকাশ করার প্রাথমিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বসু তা সরাসরি আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠান। তিনি এটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং  Zeitschriftfür Physik সাময়িকীতে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ভারতের বাইরে গবেষণার সুযোগ পান এবং দুই বছর লুই ডি ব্রগলি, মেরি কুরি এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে কাজ করেন।

বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স অব থার্মোডিনামিক্স  এবং মহামতি আইনস্টাইনের সঙ্গে এস এন বসু
বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স অব থার্মোডিনামিক্স এবং মহামতি আইনস্টাইনের সঙ্গে এস এন বসু

১৯২৭ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন এবং দেশ বিভাগ আসন্ন হলে তিনি কলকাতায় ফিরে যান।

১৯২১ থেকে ১৯৪৫, ২৪ বছর তাঁর গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টিই তিনি বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন। ক্লাসে একদিন আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও অতিবেগুনি বিপর্যয় পড়ানোর সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বর্তমান তত্ত্বের দুর্বলতা বোঝাতে এই তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ব্যত্যয় তুলে ধরেন। সে সময় তিনি ওই তত্ত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে একটি ভুল করেন। পরে দেখা যায় তাঁর ওই ভুলের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অনুমান মিলে যাচ্ছে! (বসু পরে তাঁর ওই দিনের লেকচারটি একটি ছোট নিবন্ধ আকারে  Planck's Law and the Hypothesis of Light Quanta নামে প্রকাশ করেন।)

আইনস্টাইনকে লেখা পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই চিঠি
আইনস্টাইনকে লেখা পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই চিঠি

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে ‘ Boson’  Particle-এর নামকরণ করা হয়। ইংরেজ তত্ত্বীয় পদার্থবিদ  Paul Dirac এস এন বসুর স্মৃতি রক্ষার্থে এবং তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক এই নামটি সুপারিশ করেন। কারণ, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে এস এন বসু যে  Bose-Einstein statistics ডেভেলপ করেন, তার ওপর ভিত্তি করে  elementary particles-এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত থিওরি প্রদান করা হয়েছিল। তাই দুই প্রকার  elementary particles-এর মধ্যে এক প্রকারের নাম রাখা হয়েছে  Boson ( Bose থেকে) (আরেক প্রকারের নাম হলো  Fermion)।

বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন, বোসনের ওপর গবেষণা করে ১৯৮৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন  Carlo Rubbia এবং  Simon van der Meer, ১৯৯৬ সালে  David M. Lee, Douglas D. Osheroff, Robert C. Richardson, ১৯৯৯ সালে  Martinus J.  G.  VeltmanI Gerardus 't Hooft, ২০০১ সালে  Eric Allin Cornell, Carl Edwin WiemanGes Wolfgang Ketterle) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোসকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। ‘হিগস-বোসন’ কণার অস্তিত্বের ধারণা দেওয়ায় পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কোইস অ্যাংলার্ট। নোবেল কমিটি জানায়, অতিপারমাণবিক কণার ভর উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে ‘হিগস-বোসন’ বা ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের তাত্ত্বিক ধারণা দেওয়ায় তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হলো। তত্ত্বের সেই হিগস-বোসন কণা যে বাস্তবেও আছে, ২০১২ সালে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইউরোপের সার্ন গবেষণাগারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে সত্যেন বসু অধ্যাপক ( Bose Professor) পদ রয়েছে। তাঁর মতো এই মাপের একজন বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য শুধু এই ব্যাপারটিই কী যথেষ্ট? ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে বাংলার এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়।