দাবার চালে বাজিমাত

বাংলাদেশের দাবার বিস্ময় বালক ফাহাদ রহমান।
বাংলাদেশের দাবার বিস্ময় বালক ফাহাদ রহমান।

ঘটনাটা দিল্লির। ডিসেম্বর, ২০১২। এশিয়ান স্কুল দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গেছে ফাহাদ রহমান। রাশিয়ার দাবাড়ু ফমেনি আলেক্সান্ডারকে ঘিরে টুর্নামেন্টের মিলনায়তনের কফিশপে ছোটখাটো ভিড়। কফির টেবিলে বসে বাজিতে দাবা খেলছেন ফমেনি। বাজির পরিমাণটা বেশি নয়—এক কাপ কফি অথবা ১০ রুপি। ফমেনির টেবিলে জড়ো হয়েছে বাজিতে জেতা প্রায় ১০-১৫ কাপ কফি। ফাহাদের বাবা নজরুল ইসলাম কৌতূহল মেটাতে সেখানে গিয়ে পুরো ঘটনাটা শুনলেন। এরপর ফাহাদের সঙ্গে খেলার আমন্ত্রণ জানালেন বর্ষীয়ান ভদ্রলোককে।

পুঁচকে ফাহাদকে দেখে তাচ্ছিল্যই করলেন ফমেনি। দাবার সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভের বন্ধু দাবি করা ফামেনি বললেন, ‘ওর সঙ্গে কী খেলব?’ কিন্তু নজরুল ইসলামও নাছোড়বান্দা। খেলিয়েই ছাড়বেন ফাহাদকে। অনেক অনুনয়-বিনয় করে নজরুল ইসলাম বললেন, ‘ফাহাদ এই উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের ছাত্র। ও সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন। একবার খেলার সুযোগ দেন।’ অবশেষে ফাহাদের সঙ্গে খেললেন ফমেনি। এবং হেরে গেলেন! 

ফমেনি হয়তো ভাবতেও পারেননি ফাহাদের কাছে হারবেন। হোক না ফান গেম! কিন্তু হেরে যাওয়ার পর খুশি হয়ে নিজের ভিজিটিং কার্ড ও একটি অটোগ্রাফ উপহার দেন ফাহাদকে। খেলা শেষে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। অনেক খুদে দাবাড়ু দেখেছি। কিন্তু তোমার মধ্যে দেখেছি অসাধারণ কিছু।’

সত্যিই অসাধারণ এক প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে ফাহাদ রহমান।

তোমরা যখন কমিকসের বই পড়ে, কাটু‌র্ন দেখে আর ইন্টারনেটে গেম খেলতে ব্যস্ত, বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টার ব্যস্ত থাকে ববি ফিশারের লেখা বই  মাই সিক্সটি মেমোরেবল গেম  পড়তে। ইন্টারনেট ঘেঁটে ডাউনলোড করে চেজবেজ টুয়েলভ গেম।

২০০৮ সালে প্রথম জাতীয় শিশু একাডেমীর দাবায় সোনা জেতে ফাহাদ। এরপর ২০১১ সালে হয়েছে সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন। তখন তার বয়স মাত্র আট বছর দুই মাস ২৯ দিন।  আর ২০১২ সালে দিল্লিতে এশিয়ান স্কুল দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের অনূর্ধ্ব-৯ বছর বিভাগের স্ট্যান্ডার্ডে ও ব্লিৎজে জিতেছে ২টা সোনা। একই প্রতিযোগিতায় র‌্যাপিড দাবায় জেতে ব্রোঞ্জ। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডে আসিয়ান বয়সভিত্তিক দাবায় স্ট্যান্ডার্ড বিভাগে সোনা ও র‌্যাপিড বিভাগে জেতে রুপা। সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টারের নর্ম পেয়েছে তখনই। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশ্ব যুব দাবায় গত ডিসেম্বর ব্লিৎজ বিভাগে জিতেছে রুপা। স্ট্যান্ডার্ডে হয়েছে পঞ্চম।

অথচ এমন প্রতিভাবান দাবাড়ুকে ক্রিকেটার বানাবে বলেই ঠিক করেছিলেন বাবা নজরুল ইসলাম। ফরিদপুরের মধুখালীতে তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ফাহাদ। ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে আসে। প্রতিবেশীর দুষ্টু ছেলেরা ওকে নির্দয়ভাবে পেটায়, বেঁধে রাখে সুপারিগাছের সঙ্গে। তা দেখে মা হামিদা খান সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেন, ‘ক্রিকেট খেলা আর নয়, যদি খেলতেই হয় ফাহাদকে ইনডোরের গেমসে খেলাবেন।’ এরপর বাবাকে পাঠানো হলো দোকানে লুডুর কোর্ট কিনতে। কিন্তু ১০০ টাকা ভাঙতি ছিল না বলে পাশের দোকানে গেলেন সেটা ভাঙাতে। ওই দোকানেই দেখেন একটি ছেঁড়া পত্রিকার অংশ। সেখানেই দেখেন বিশ্বনাথন আনন্দ দাবা খেলে জিতেছেন কোটি টাকা। ভাবলেন, ছেলেকে দাবা খেলা শেখাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। লুডুর সঙ্গে একটি দাবার বোর্ডও কিনে আনলেন তিনি।

মধুখালীতে শীতকালে কলাইয়ের খেতে, হাটে-মাঠে, চায়ের দোকানে দাবা খেলার ধুম পড়ে যায়। সেখানেই মাঝেমধ্যে খেলাতেন ফাহাদকে। এলাকার সবাইকে হারিয়ে দিতে শুরু করলে হইচই পড়ে যায়। প্রতিবেশীরা তাকে ঢাকায় আসার পরামর্শ দেন। কিন্তু মধুখালী মডেল স্কুলের ইংরেজির শিক্ষকের সাহসে কুলায় না। শেষ পর্যন্ত জাতীয় শিশু একাডেমীর দাবা খেলার খোঁজ পেয়ে যান। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন ফাহাদ ঢাকায় এসে জিতে নেয় জাতীয় পর্যায়ের সোনা। কিন্তু ফরিদপুর আর ঢাকায় যাতায়াত করাটা তার জন্য হয়ে পড়ে কষ্টকর ব্যাপার। এলাকায় যতটুকু ভিটেমাটি ছিল সব বিক্রি করে ফাহাদকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান নজরুল ইসলাম। সেটা ২০১১ সালের ঘটনা। এরপর তাকে ভর্তি করে দেন গুলশান মডেল স্কুলে। ফাহাদের প্রতিভার কথা জানতে পারেন স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাকে বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ করে দেন। ফাহাদের বাবারও চাকরি দেওয়া হয় ওই স্কুলে। কিন্তু ছেলেকে সময় দিতে গিয়ে, বিদেশে টুর্নামেন্টে খেলাতে গেলে কখনো ছুটি মিলত না—এই ক্ষোভে চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন নজরুল ইসলাম।

বিদেশে ফাহাদের বয়সী দাবাড়ুদের আছে নামকরা কোচ। কিন্তু ফাহাদের যা কিছু পরামর্শ সবই দেন তার বাবা। মাঝেমধ্যে নিয়াজ মোরশেদের কাছ থেকেও কিছু পরামর্শ নেয় ফাহাদ। সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ফাহাদ তবুও এগিয়ে চলেছে নিজের সাফল্য নিয়ে।

ববি ফিশার, বিশ্বনাথন আনন্দ, ম্যাগনাস কার্লসেন, হিকারু নাকামুরা, ভ্লাদিমির ক্রামনিকদের মতো সেরা দাবাড়ুর বই পড়ে চাল মুখস্থ করে ফাহাদ। ইদানীং ইন্টারনেট থেকে নতুন নতুন সব ভার্সন নামিয়ে সেটা বিশ্লেষণ করে।

পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মাঝেমধ্যেই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় ফাহাদকে। এবার অবশ্য তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে কম্পিউটার সোর্স নামের প্রতিষ্ঠান। দেশের বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের খুবই ইচ্ছা ফাহাদের। সম্প্রতি বিশ্বনাথন আনন্দকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন নরওয়ের গ্র্যান্ডমাস্টার ম্যাগনাস কার্লসেন। সেই কার্লসেনকেই আদর্শ মানে ফাহাদ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্ব যুব দাবায় গিয়ে হারিয়েছে ভারতের খুদে কার্লসেন খ্যাত রাম অরবিন্দকে। কিন্তু কে জানে ভবিষ্যতের কার্লসেনই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফাহাদ। বয়স তো মাত্র দশ!

দ্রুতই আন্তর্জাতিক মাস্টার নর্ম অর্জন করার ইচ্ছা ফাহাদের। ইচ্ছা আছে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার। ফাহাদের সামনে আছে সেটার দারুণ সুযোগ, ‘আগামী এপ্রিলে বিশ্ব জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে চাই আমি। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে সরাসরি গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব দেওয়া হয়। আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েই গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই।’