অর্থগুলো বদলে যায়

 শব্দ যখন তৈরি হয়, তখন তার নিজস্ব একটা অর্থ থাকে। কালের গতিকে সেই অর্থের পরিবর্তন ঘটে যায়, তৈরি হয় শব্দটির নতুন অর্থ। ছাত্র শব্দটি যখন তৈরি বা গঠিত হয়, তখন তার অর্থ ছিল এক রকম। এখন অর্থ দাঁড়িয়েছে আরেক রকম। অর্থের পরিবর্তনের এই ব্যাপার যে শুধু বাংলা ভাষাতেই ঘটে তা নয়, অনেক ভাষাতেই ঘটে। ছাত্র শব্দটির মতো অর্থের পরিবর্তন ঘটে যাওয়া আরও কয়েকটি শব্দ নিয়ে পরিবেশিত হলো আজকের অভিধানের গল্প।

ধান

সুপরিচিত খাদ্যশস্য ধান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধান্য থেকে। যেসব শস্যের দ্বারা দেহ পুষ্ট হয়, সংস্কৃত ভাষায় তা সবই ধান্য। ধান্য পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত—শালি, ব্রীহি, শূক, শমী ও ক্ষুদ্র। ব্রীহি ধান্য হলো তিল; শূক ধান্য হলো যব, গম ইত্যাদি; ক্ষুদ্র ধান্য হলো কাউন; শমী ধান্য হলো কলাই আর শালি ধান্য হলো বাংলা ভাষার ধান, যা সতুষ অবস্থায় ধান, নিস্ত্তষ করলে চাল আর সেদ্ধ করলে ভাত।

ধান্য বা ধান শব্দের মূল অর্থ হলো, যা দেহ পোষণ করে।

শাক

শাক শব্দের প্রচলিত অর্থ হলো রেঁধে খাওয়ার যোগ্য একধরনের উদ্ভিদ বা লতাপাতা, যেমন পালংশাক, পঁুইশাক, ডাঁটাশাক, লালশাক, কলমিশাক ইত্যাদি। সংস্কৃত অভিধানে শুধু লতাপাতা নয়, সব প্রকার সবজিই শাকের মধ্যে পড়ে। সংস্কৃতে শাক ছয় রকমের—পত্রশাক, পুষ্পশাক, ফলশাক, নালশাক, কন্দশাক ও সংস্বেদজশাক।

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় এ রকম—পালংশাক, কলমিশাক, লালশাক ইত্যাদি হলো পত্রশাক; ফুলকপি, কলার মোচা, কুমড়োর ফুল ইত্যাদি হলো পুষ্পশাক; লাউ-কুমড়োর লতা, কচুর লতি ইত্যাদি নালশাক; লাউ, কুমড়া, পটোল ইত্যাদি ফলশাক; আলু, ওল, কচু, মুলা ইত্যাদি কন্দশাক এবং মাশরুমজাতীয় সবজি হলো সংস্বেদজশাক।

শাক শব্দের মূল অর্থ, মানুষ যা দ্বারা ভোজনে সমর্থ হয়।

অহংকার

অহংকারে অনেকের মাটিতে পা পড়ে না। অতিরিক্ত অহংকারে অনেকে আবার ধরাকে অর্থাৎ পৃথিবীকে সরা অর্থাৎ মাটির হাঁড়িও নয়, মাটির হাঁড়ির ঢাকনা মনে করে। অহংকার পতনের কারণ হয়। অহংকার থাকা ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত অহংকার ভালো নয়। অহংকার শব্দের প্রচলিত অর্থ অহমিকা, গর্ব, বড়াই ইত্যাদি।

তবে অহংকার শব্দের মূল অর্থ হলো আমির বোধ, সর্বক্ষণ আমি আমি করা, আমিই কর্তা, আমিই সব, এটা আমার, ওটা আমার—এই রকম ভাবা।

অঞ্জলি

শহীদ দিবসে আমরা শহীদ মিনারে এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্প ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। শ্রদ্ধাঞ্জলি বা গীতাঞ্জলির অঞ্জলি শব্দের মূল অর্থ হলো করপুট বা যুক্তকর।

অনেক সময়ে বিপদে পড়ে নদীর বা বালতির পানি দুহাত জড়ো করে তুলে খেতে হয়। এই সময়ে দুহাতের পাঞ্জা একটু বেঁকে আধারের মতো হয়ে পড়ে, আর এই অবস্থাই হলো অঞ্জলি। অঞ্জলির চলিত বাংলা হলো আঁজলা, যেমন আঁজলাভরা জল।

অঞ্জলি শব্দের মূল অর্থ, যা দ্বারা বিনয় প্রকাশিত হয়।

উৎকোচ

আমাদের মুখের কথার ঘুষ শব্দটি অনেক সময় লেখার ভাষায় উৎকোচ হয়ে যায়। এতে অবশ্য অর্থের কোনো হেরফের ঘটে না। দেওয়া বা নেওয়ার সময় ঘুষের অর্থ যা, উৎকোচের অর্থও তা-ই। অভিধানে ঘুষ শব্দের অর্থ দেওয়া থাকে উৎকোচ। দুটো শব্দেরই অর্থ হলো অবৈধ সহায়তার জন্য গোপনে প্রদত্ত টাকা বা জিনিসপত্র।

দেওয়া ও খাওয়ার অর্থে বর্তমানে দুটো শব্দ এক হলেও উৎকোচ শব্দের প্রকৃত অর্থ কিন্তু আলাদা।

উৎকোচ শব্দের মূল অর্থ হলো সৎ পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।

কলস

অভিধানের বিচারে কলস ও কলসি একই কথা। তবে ব্যবহারগত দিক থেকে কলস ও কলসিতে সামান্য তফাত রয়েছে, তফাতটা আকারের। কলসের আকার কলসির চেয়ে বড়। কলস বাড়িতে থাকে আর কলসি কাঁখে পল্লিবধূ জল আনতে যায়।

কলস শব্দটি মূলত চিত্রকল্পজাত শব্দ। শব্দটি তৈরির মূলে বিশেষ ধ্বনি ও চিত্র কাজ করেছে।

কলস শব্দের মূল অর্থ, যা জল পূরণকালে কল শব্দ করে।

কলহ

কলহ শব্দের প্রচলিত অর্থ হলো ঝগড়াবিবাদ, বচসা, বাগ্‌বিতণ্ডা ইত্যাদি। কলহ দুই পক্ষে হয়। নিরপেক্ষরা দাঁড়িয়ে মজা দেখে। কলহে প্রবল উচ্চ রোলের সৃষ্টি হয়। গালিগালাজ চলে। কারও মুখের কথার লাগাম থাকে না।

কলহ শব্দের মূল অর্থ, যা মধুর ধ্বনি হনন করে।

ছাত্র

ছাত্র শব্দের বর্তমান অর্থ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির পড়ুয়া। শিষ্যকেও ছাত্র বলা হয়। বাংলায় ছাত্র শব্দের নারীবাচক রূপ হলো ছাত্রী। সংস্কৃত ব্যাকরণমতে কিন্তু তা ভুল। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী ছাত্রের নারীবাচক রূপ হলো ছাত্রা। ছাত্রী শব্দটিও সংস্কৃত ভাষায় রয়েছে। ছাত্রী বলতে বোঝায় ছাত্রের পত্নী বা স্ত্রী।

ছাত্র শব্দের মূল অর্থ, যে গুরুর দোষ ঢেকে রাখে।