চড়ুই পাখির জন্য ভালোবাসা

একঝাঁক চড়ুই যখন কিচিরমিচির রবে সকালের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে, তখন দেখবে কত আনন্দ হয়।
একঝাঁক চড়ুই যখন কিচিরমিচির রবে সকালের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে, তখন দেখবে কত আনন্দ হয়।

চড়ুই পাখি দেখলেই আমি অপরাধবোধে ভুগি। মনে হয়, প্রতিটা চড়ুই আমার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে পাশের চড়ুইকে বলছে, এই যে দেখ ছেলেটা, এই ছেলেটা খুব খারাপ। সাবধান, এর ধারেকাছেও যাবি না! এ খুনি! তাই চড়ুই পাখি দেখলেই আমি আস্তে করে তাদের সামনে থেকে সরে যাই। কারণ, ছোটবেলায় একটা চড়ুই পাখি হত্যা করেছিলাম আমি। এয়ানগান দিয়ে গুলি করে।

তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার এক কাজিন একদিন এক ফুপার বাসা থেকে এয়ারগান নিয়ে এসে তোলপাড় ফেলে দিলেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তাঁর পাখি শিকার উৎসব। বাসার লোকজন এ নিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। বাসার দাদু, বড় চাচি, আম্মা—এঁরা সবাই ঘোষণা দিলেন, শিকার করা পাখি তাঁরা রান্না করবেন না। কাজিন অন্য একজনকে রাজি করালেন পাখি রান্না করে দেওয়ার জন্য। আর আমরা যারা ছোট, তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে দিনমান তাঁর পিছে পিছে ঘুরি একবার এয়ারগানটি হাতে তুলে নেওয়ার জন্য। কাজিনের স্পষ্ট নির্দেশ, কেউ তাঁর অনুমতি ছাড়া এয়ারগানে হাত দিলে খুন করে ফেলবেন। উনি যেভাবে টপাটপ গুলি করে পাখি মেরে ফেলছিলেন, তাতে ওনার হুমকিকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ ছিল না। তো, এক সপ্তাহ পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, কাজিনের মায়া হলো খুব, তিনি ছোটদের একটা করে গুলি করার অনুমতি দিলেন। সময় এক মিনিট। আমাকেই দেওয়া হলো প্রথমে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে এয়ানগান হাতে নিয়ে ডানে তাকিয়ে দেখি, বাঁশের কঞ্চিতে একটা চড়ুই পাখি বুক ফুলিয়ে বসে আছে। তাক করে গুলি ছুড়লাম, আর কী আশ্চর্য, টুপ করে চড়ুইটা নিচে পড়ে গেল! তারপরের ঘটনা আমি সারা জীবন ভোলার চেষ্টা করেছি...পারিনি। পাখির সেই রক্ত দেখে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম সেদিন। রাতেই স্বপ্নে দেখলাম সেই চড়ুইটাকে। ওটা ছিল একটা ছেলে চড়ুই। কেন আমি তাকে মেরে ফেললাম, সেই কৈফিয়ত চাইছে আর তাকে ঘিরে চুপচাপ বসে আছে আরও অনেক চড়ুই পাখি। সকালে উঠেই সিসার গুলিগুলো কাজিনের অগোচরে পুকুরে ফেলে দিলাম। গোপন স্টকের গুলি নিয়ে উনি শিকারে বের হলে দূর থেকে ঢিল ছুড়ে ঘুঘু, সাদা বক ইত্যাদি তাড়িয়ে দিতে লাগলাম। নানা ঘটনার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই বিদায় নিল সেই এয়ারগান। আমিও আর কখনো এয়ারগানে হাত তো দিইনি-ই এবং আমাদের এলাকায় আর কোনো লোককে পাখি শিকারের জন্য বন্দুক নিয়েও ঢুকতে দিইনি। পাখি শিকার জিনিটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করলাম সেসময় থেকেই।

খাবারের লোভে হাজির হবে চড়ুই ছাড়াও নানা ধরনের পাখি
খাবারের লোভে হাজির হবে চড়ুই ছাড়াও নানা ধরনের পাখি

কলেজে ভর্তি হয়ে যোগ দিলাম নেচার স্টাডি ক্লাবে। ক্লাবের বড় ভাই শেখরদার সঙ্গে ছুটির দিনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যাই ডাক শুনে পাখি চেনার জন্য। একদিন সন্ধান পাই ঢাকার এক বার্ড ক্লাবের। সেই ক্লাবের মিটিংয়ে পাখি নিয়ে আলোচনায় প্রতি মাসে যোগ দিই। সে সময়ই চড়ুই পাখি নিয়ে বেশ কয়েকটা গল্পও লিখে ফেলি। ছাপাও হলো সেগুলো বিভিন্ন পত্রিকায়। সেসময় যে মেয়েটাকে মনে মনে ভালোবাসতাম, তাকে চিঠি লিখতে শুরু করি ‘ছোট্ট চড়ুই’ সম্বোধনে। অপরাধবোধ থেকে জন্ম নেওয়া চড়ুই পাখি প্রতি সেই ভালোবাসা আছে আমার এখনো।

যা-ই হোক, যে কারণে এত কথা, সেটা হলো, কয়েক দিন আগে গুগল সার্চে সন্ধান পেলাম পাখিদের খাবারের পাত্র বানানোর নানা পদ্ধতি। দেখে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে খালি কোকের বোতল দিয়ে বানিয়েও ফেললাম একটা। ভেতরে চাল ঢুকিয়ে বারান্দায় ঝুলিয়ে দিয়ে দেখলাম আস্তে আস্তে চড়ুই আসতে শুরু করেছে। প্রথমে একটু ভয় পেলেও একসময় আমার বারান্দা ভরে গেল চড়ুই পাখিতে। প্রতি দুদিনে ৫০০ মিলির এক বোতল চাল লাগে তাদের জন্য। বারান্দা একটু নোংরা হয় বলে নিচে খবরের কাগজ বিছিয়ে দিই। তাদের কিচিরমিচিরে যখন সকালে ঘুম ভাঙে, কী যে ভালো লাগে।

চামচের বদলে পেন্সিলও ব্যবহার করতে পারো
চামচের বদলে পেন্সিলও ব্যবহার করতে পারো

তুমি চাইলে তোমার বাসা, উঠোন বা বাগানেও বানাতে পারো এ জিনিস। কোমল পানীয় বা পানির বোতলের নিচের দিকে ফুটো করে দুদিক দিয়ে দুটি চামচ ঢুকিয়ে দাও। এবার ভেতরে চাল বা দোকানে পাখির যেসব খাবার পাওয়া যায়, সেগুলো ভরে মুখ লাগিয়ে ঝুলিয়ে দাও বারান্দায় বা অন্য কোথাও। প্রথম প্রথম পাখিরা একটু ভয় পেলেও একসময় দেখবে পাখি আসতে শুরু করছে। তখন কী আনন্দ হয়, দেখবে! চাইলে তখন একটা ছবি তুলে পাঠিতে দিতে পারো আমাদের ঠিকানায়। আমরা ছেপে দেব পাখিদের প্রতি তোমার সেই ভালোবাসার ছবি।