মহাকাশ মহাবিস্ময়

মহাকাশ আমাদের সব সময় টানে। কত রহস্য লুকিয়ে আছে এখানে। কোথা থেকে কীভাবে এর উদ্ভব? রাতের আকাশে কীভাবে উল্কাবৃষ্টি হয়, কেন হ্যালির ধূমকেতু প্রতি ৭৬ বছর পর একবার করে সূর্যকে ঘুরে যায়। সুপারনোভার মধ্যে লুকিয়ে আছে কত অজানা রহস্য। এসব জানার আগ্রহ আমাদের সবার।

পৃথিবী থেকে ৫০ আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহে আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান কোনো সমাজের সদস্যরা হয়তো এই মুহূর্তে বিশেষ ধরনের অ্যান্টেনা লাগিয়ে সুচিত্রা-উত্তমের  হারানো সুর  ছবিতে ‘তুমি যে আমার...’ গানটি শুনছে! ভাবতে অবাক লাগে, কিন্তু এটা সম্ভব। কারণ, ১৯৬৪ সালে রূপমহল সিনেমা হলে ঠিক যে গানের দৃশ্যটি দেখে আমরা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, তা আলোকতরঙ্গরূপে মহাকাশে অবিরাম চলতে চলতে ৫০ বছরে সেখানে পৌঁছেছে।

এক আলোকবর্ষ কত দূর? আলোকতরঙ্গ কোনো শূন্য মাধ্যমে এক বছরে যত দূর যায়, সেটাই এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। আলো প্রতি সেকেন্ডে যায় প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার। অর্থাৎ এক সেকেন্ডে আলো বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীকে সাড়ে সাতবার চক্কর দিয়ে আসতে পারে। এই গতিতে আলো এক বছরে সাড়ে নয় ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। ৯৫-এর পর ১১টি শূন্য বসালে এই সংখ্যাটি পাওয়া যাবে। এটাই এক আলোকবর্ষ।

এই বিশাল দূরত্ব সম্পর্কে ধারণা করার জন্য আমরা সূর্যের দূরত্বের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পারি। পৃথিবী থেকে সূর্য প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে। সূর্যের আলো আসতে লাগে প্রায় আট মিনিট। মহাজাগতিক এককে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মাত্র আট আলোক মিনিট। এর ৩২ হাজার গুণ দূরত্বকে আমরা বলতে পারি এক আলোকবর্ষ। এ রকম প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে সূর্যের পর আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেনটওরি। গ্রহ-তারা-নীহারিকাগুলো এত দূরে দূরে যে আলোকবর্ষ দিয়ে মহাজাগতিক দূরত্ব প্রকাশ করতে হয়।

সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌছাতে লাগে প্রায় আট মিনিট।
সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌছাতে লাগে প্রায় আট মিনিট।

মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রায় পৌনে চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে আমাদের এই মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছিল। এর পর থেকে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। বিগ ব্যাং নিয়ে রয়েছে আমাদের অনেক প্রশ্ন। এই মহাবিস্ফোরণ কি মহাশূন্যেই ঘটেছিল? আমরা যখন বলি মহাশূন্য সম্প্রসারিত হচ্ছে, সেটা কোথায় হচ্ছে? তার মানে, মহাশূন্যের বাইরে আরও কিছু শূন্য জায়গা আছে নাকি? না হলে সম্প্রসারিত হবে কোথায়?

বিগ ব্যাংয়ের শুরুতে কী ছিল তা জানার জন্য মহাজাগতিক বিকাশপ্রক্রিয়া রি-ওয়াইন্ড করে পৌনে চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে ফিরে গেলে আমরা একটি বিন্দুতে পৌঁছাব। দেখা যাবে সেখানে মহাশূন্য বলে কিছু নেই। যেমন, একটি বেলুন ফোলানোর আগে তার গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে কালির কয়েকটি ফোঁটা দিলে একটি বিন্দুর মতো দেখাবে। এবার বেলুনটি ফোলাতে শুরু করলে সেই বিন্দুগুলো ক্রমে বড় ও একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। মহাশূন্যে নীহারিকা, ছায়াপথ, তারা প্রভৃতির সৃষ্টি ও বিকাশ এভাবেই ঘটে চলেছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন।

এসব জটিল প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে পুরস্কারপ্রাপ্ত সল পার্লমুটার, ব্রায়ান স্মিড ও অ্যাডাম রিয়েস সুপারনোভা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁরা লক্ষ করলেন, দূরে বিস্ফোরিত কোনো সুপারনোভা থেকে আলোর ঝলক আসতে আগের হিসাব অনুযায়ী যত সময় লাগার কথা, এখন তার চেয়ে বেশি সময় লাগছে আর আলোও অনেকটা হালকা হয়ে আসছে। এ থেকেই তাঁরা বললেন, মহাবিশ্ব শুধু সম্প্রসারিতই হচ্ছে না, এই সম্প্রসারণ ঘটছে ত্বরণ গতিতে।

মহাবিশ্বের কোথাও বিশাল আকারের তারার প্রচণ্ড বিস্ফোরণকে বলে সুপারনোভা। এর ফলে এমনকি এক হাজারটি সূর্যের সমান আলোর বিকিরণ হতে পারে। এই সুপারনোভা নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের অনেক রহস্যের সমাধান বের করছেন।

সুপারনোভা
সুপারনোভা

এই মহাশূন্যে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন তারা, আবার অন্যদিকে কিছু তারার মৃত্যুও ঘটছে। মহাশূন্যের কোথাও সঞ্চিত মহাজাগতিক বস্ত্তকণা ও গ্যাসের মেঘ থেকে তারার জন্ম। প্রথমে এই মেঘমালা তার ভেতরের বস্ত্তকণার মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সংকুচিত হতে থাকে। এতে প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি হয়। কয়েক কোটি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এর ফলে একটি অণু থেকে অন্য অণু জন্ম নেয়। এই প্রক্রিয়ায় শক্তি বেরোয়। এ সময় একদিকে শক্তির প্রভাবে মহাজাগতিক মেঘের প্রসারণ ঘটে ও অন্যদিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাকে টেনে একটি সীমার মধ্যে রাখতে চায়। একসময় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই তারা। তারার ভেতর হাইড্রোজেন অণু পুড়ে হিলিয়ামে পরিণত হয়। একসময় সব জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে তারার মৃত্যু ঘটে।

মহাকাশ এক মহাবিস্ময়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণায় অনেক নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব জানা খুব দরকার। কারণ আমরা তো নিজেদের একটু এগিয়ে রাখতে চাই।