বড়দের কাঁধে চড়ে

যেন মনে হলো, মাত্র গতকাল মারা গেছি। না, এটা অবশ্যই কয়েক শতাব্দী আগে ঘটে থাকবে। আমি চাইছি, ধুত্তুরি ছাই, কম্পিউটার স্রেফ জানিয়ে দিক আমাকে! কিন্তু না, চাইলেই তো হবে না, কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। প্রথমে সেনসরগুলো কম্পিউটারকে  রিপোর্ট করবে আমি পুরোপুরি সচেতন হয়েছি কি না, এবং আমার শরীর আর মন যথেষ্ট সুস্থ-সবল আছে কি না। প্রহসনই বলতে হবে যে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করায় আমার পালস প্রচণ্ড তড়পাচ্ছে, আর সেটা ধরতে পেরে কম্পিউটার মুখ খুলছে না। এটা যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয়, আমাকে তার জানানোর কথা।

অবশেষে মুখ খুলল মেশিন। মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠস্বর। ‘হ্যালো, প্রয়াস। জীবিতদের দুনিয়ায় তোমাকে স্বাগত জানাই।’

‘আমরা...’ ভাবলাম বটে শব্দটা উচ্চারণ করেছি, কিন্তু আসলে আমার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি। আমাকে আবার চেষ্টা করতে হলো। ‘আমরা কোথায়?’

‘ঠিক যেখানে থাকার কথা...গতি কমিয়ে ছুটছি, টার্গেট সারর।’

বিরাট স্বস্তি অনুভব করলাম। ‘নওমি কেমন আছে?’

‘সেও তোমার মতো এইমাত্র জাগছে।’

‘বাকি সবাই?’

‘বাকি আটচল্লিশটা ক্রাইয়োজেনিক চেম্বার ঠিকঠাক কাজ করছে,’ জানাল কম্পিউটার। ‘যতদূর বুঝতে পারছি, সবাই ভালো আছে।’

শুনে খুশি হলাম, তবে এটা অবাক করার মতো কিছু না। চারটে অতিরিক্ত ক্রাইয়োচেম্বার আছে আমাদের, কারও চেম্বার অকেজো হয়ে পড়লে আমাকে আর নওমিকে আগেই জাগানো হতো তাকে সেগুলোর একটায় সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ‘তারিখ বলো।’

‘১৬ জুন ৩২৯৬।’

এ রকম উত্তরই আশা করছিলাম, তার পরও একটু ধাক্কা খেলাম। আমার শরীর থেকে রক্ত বের করে, তার জায়গায় অক্সিজেনেটেড অ্যান্টিফ্রিজ ঢোকানোর পর ১২০০ বছর পার হয়ে গেছে। ওই ১২০০-এর প্রথম ১০০ বছর আমরা শুধু গতি বাড়িয়েছি, এবং সম্ভবত শেষ শতকে পৌঁছে কমাতে শুরু করেছি, আর বাকি...

বাকি মাঝখানের সময় আমাদের গতি ছিল ৩০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড, আলোর গতির চেয়ে অনেক অনেক কম। আমার বাবা খুলনা, বাংলাদেশের; আর মা কেন্ট, ব্রিটেনের মেয়ে। ওরা দুজনই এই কৌতুকটা উপভোগ করে: এশিয়া আর ইউরোপের মধ্যে পার্থক্য হলো, একজন এশিয়ান মনে করে ১০০ বছর বিরাট একটা সময়, আর একজন ইউরোপিয়ান মনে করে ১০০ মাইল বিরাট একটা জার্নি।

ওরা দুজনই অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করবে যে ১২০০ বছর আর ১১.৯ আলোকবর্ষ মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার। যাই হোক, আমরা এখন এখানে, গতি কমিয়ে তাও কেটির দিকে ছুটছি। তাও কেটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আমাদের সূর্যের মতো দেখতে একটা নক্ষত্র, যেটা একাধিক নক্ষত্র সিস্টেমের অংশ নয়। আর সে জন্যই এই নক্ষত্রটির ওপর সতর্ক নজর রাখা হয়েছিল। নজর রাখছিল একটা অনুসন্ধানী টিম, ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কি না, জানার জন্যে পৃথিবীর এই টিম মহাকাশে তল্লাশি চালাচ্ছিল। কিন্তু কখনোই কিছু ধরা পড়েনি। না চোখে কিছু দেখা গেছে, না কোনো সংকেত পাওয়া গেছে।

প্রতি মিনিটে আরও ভালো বোধ করছি। আমার নিজের রক্ত, বোতলে সংরক্ষিত, শরীরে ফিরে পেয়েছি, এই মুহূর্তে শিরা-উপশিরা বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার গোটা সিস্টেমে, নতুন করে জীবিত বা স্বাভাবিক করছে আমাকে।

আমরা মনে হচ্ছে পৌঁছাতে পারব।

ঘটনাচক্র বা বাস্তবতা হলো আমাদের সৌরজগতের দিকে মুখ করা অবস্থায় ছিল তাও কেটি নক্ষত্রের উত্তরমেরু; এর মানে, বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে গ্রহ-নক্ষত্র সিস্টেম খোঁজার জন্য যে টেকনিক উদ্ভাবন করা হয়েছিল—একটা তারার সূক্ষ্ম ব্লুশিফট আর রেডশিফটের ওপর ভিত্তি করে, এই কাছে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে—সেটা কোনো কাজে আসেনি। তাও কেটির সচলতার মধ্যে যেকোনো কম্পন বা ঝাঁকি, পৃথিবী থেকে তাকালে, সোজা বা খাড়া দেখতে লাগবে, কোনো ডপলার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। তবে একসময় পৃথিবীকে ঘিরে চক্কর দিতে পারা টেলিস্কোপ বানানো হলো, সেগুলো এতই শক্তিশালী যে দূর নক্ষত্রের যেকোনো কম্পন বা ঝাঁকি সরাসরি দেখতে পায়, এবং...

স্যাটেলাইটে বসানো টেলিস্কোপে আমাদের খুব কাছাকাছি একটা সোলার সিস্টেম ধরা পড়েছে, প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর সবখানে এই খবর তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছিল। নাক্ষত্রিক কম্পন বা বর্ণালিসংক্রান্ত বিভ্রম থেকে জানা বা আন্দাজ করার ব্যাপার নয়, ক্যামেরার চোখ সত্যি সত্যি দেখতে পেয়েছে। শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে অন্তত চারটে গ্রহ, যেগুলো নক্ষত্র তাও কেটির চারদিকে যার যার কক্ষপথে ঘুরছে। আর ওগুলোর একটা...

দশকের পর দশক কেটেছে জল্পনাকল্পনা করে আর ফর্মুলা দিয়ে। প্রথমে জনপ্রিয়তা পায় নাসার একটা পাঠ ও গবেষণা:  মানুষের জন্যে বাসযোগ্য গ্রহসমূহ 

অ্যাস্ট্রবায়োলজিস্ট আর কল্পগল্পের লেখকেরা এই পাঠ ও গবেষণা থেকে রসদ সংগ্রহ করে নির্ণয় করতে চেয়েছেন  লাইফ জোন—  টার্গেট করা নক্ষত্র থেকে কত দূরে আছে সেই কাঙ্ক্ষিত গ্রহ, যে গ্রহ পৃথিবীর মতো সারফেস টেম্পারেচার নিয়ে নিজ কক্ষপথে ঘুরছে, না খুব গরম, না খুব ঠান্ডা।

একসময় জানা গেল চারটের মধ্যে দ্বিতীয় গ্রহ, যেটাকে তাও কেটির চারদিকে পরিষ্কার চক্কর মারতে দেখা যায়, সেটা ওই নক্ষত্রটির লাইফ জোনের ঠিক মধ্যখানে রয়েছে। পুরো এক বছর গ্রহটাকে খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা হলো—ওই গ্রহের হিসেবে এক বছর, পৃথিবীর ১৯৩ দিন। তাতে দুটো চমৎকার বিষয় স্পষ্ট হলো। এক, গ্রহটার কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার—এর মানে, পুরোটা সময় নিরাপদ তাপমাত্রা থাকার আভাস দিচ্ছে; এর জন্য দায়ী সম্ভবত বৃহস্পতিতুল্য দানবিক আকার নিয়ে চতুর্থ গ্রহের মহাকর্ষ, অর্ধ বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে তাও কেটিকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে।

দুই, ২৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট লম্বা দিনে ওই গ্রহের উজ্জ্বলতা সব সময় একরকম থাকে না, কখনো কমে, কখনো বাড়ে। কারণটা বোঝা মোটেও কঠিন নয়, একটা গোলার্ধের বেশির ভাগটাই শক্ত জমিন, তাতে তাও কেটির হলুদ আলো প্রতিফলিত হচ্ছে; দ্বিতীয় গোলার্ধ থেকে প্রতিফলিত আলো সাদাটে, সেটাকে সম্ভবত সমুদ্র ঢেকে রেখেছে—ভিনগ্রহের প্রশান্ত মহাসাগর।

দূরত্বটা যেহেতু ১১.৯ আলোকবর্ষ, এটা খুবই সম্ভব যে তাও কেটির হয়তো আরও গ্রহ আছে, হতে পারে খুব বেশি ছোট বা খুব বেশি অন্ধকার হওয়ায় আমরা সেগুলোকে দেখতে পাই না। কাজেই পৃথিবীসদৃশ গোলককে তাও কেটি-২ বলাটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ যদি জানা যায় অতিরিক্ত একটা দুনিয়া বা একাধিক দুনিয়া কাছাকাছি কক্ষপথে ঘুরছে, ওই সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা নিয়ে তখন বিভ্রান্তি দেখা দেবে, যেমনটা একসময় শনির বলয় নিয়ে দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু একটা নাম তো না দিলে নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিয়ানকার্লো ডাইমাইয়ো, যিনি ওই গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, ওটার নামকরণ করলেন সারর। সারর ল্যাটিন শব্দ, অর্থ বোন। পৃথিবীর বোন আর কী। এবং সাররকে দেখে সত্যি সত্যি মনেও হয়, পৃথিবী থেকে যতটা বোঝা সম্ভব, মানবতাকে নিরাপদ একটা আশ্রয় দেয়ার ভগ্নীসুলভ কোমলতা এই গ্রহের আছে।

শিগগিরই আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব বোন হিসেবে সারর ঠিক কতটা নিখুঁত। ভালো কথা, বোন প্রসঙ্গে যখন কথা উঠলই —ঠিক আছে, নওমি ইয়াং আমার বায়োলজিক্যাল বোন নয়, তবে রওনা হওয়ার আগে চার বছর একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা, একসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছি, এবং ওকে আমি নিজের বোন বলেই ভাবতে শিখেছি, প্রচারমাধ্যম বিরতিহীন আমাদের নতুন অ্যাডাম আর ঈভ বলে উল্লেখ করা সত্ত্বেও। না, ঠিক আছে, নতুন একটা পৃথিবীকে মানুষে মানুষে ভরে দিতে অবশ্যই সাহায্য করব আমরা, তবে সেটা আমরা দুজন একসঙ্গে নয়। আমার বান্ধবী শিল্পা রয়েছে এই স্টারশিপে, বাকি আটচল্লিশটা নিরেট বরফ মূর্তির একটা হয়ে। আনকোরা নতুন পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর জনসংখ্যা বাড়ানোর কাজ শুরুর আগে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে।

আমি সৈয়দ সৎ প্রয়াস, বয়স ১৮, নাসার টোকিও শাখা থেকে  দুরন্ত পথিকৃৎ  নামে একটা স্টারশিপ নিয়ে বাকি ৪৯ জন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে রওনা হয়েছি আজ থেকে ১২০০ বছর আগে, উদ্দেশ্য পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়া মানব প্রজাতিকে সীমাহীন মহাশূন্যের কোথাও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আমাদের কলোনিস্ট বলা হয়েছে, যেহেতু মহাশূন্যে আমরা কলোনি স্থাপন করব। স্টারশিপের নাম দুরন্ত পথিকৃৎ হওয়ার কারণ, পৃথিবীর বুকে ধ্বংস-১ এবং ধ্বংস-২ নামে দু-দুটো পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ গা বাঁচিয়ে চলতে সফল হয়েছে, ফলে অর্থনীতিতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করি আমরা। নাসার জাপানি শাখার খরচ একা চাঁদার মাধ্যমে জুগিয়ে আসতে বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা হয়নি। দুরন্ত পথিকৃৎ নামটা আমাদের সরকার প্রস্তাব করলে বিনা আপত্তিতে তা পাস হয়ে যায়।

বাকি কলোনিস্ট কারও সঙ্গেই নওমি নিজেকে সেভাবে জড়ায়নি। তবে মেয়ে হিসেবে সে আশ্চর্য সুন্দর, ঘটে ক্ষুরধার বুদ্ধি রাখে, সরল  এবং মিশুক; তা ছাড়া, ক্রাইয়োঘুমে থাকা ২৪ জন তরুণের মধ্যে ২১ জনেরই বাছাই করা কোনো সঙ্গিনী নেই।

ছেলে বা মেয়ে, আমাদের সবার বয়স সমান, ১৭ থেকে ১৮-এর মধ্যে, শুধু নওমি বাদে—ওর বয়স ২৫।

আমি আর নওমি দুরন্ত পথিকৃৎ স্টারশিপের কো-ক্যাপটেন। ওর ক্রাইয়োকফিন আমারটার মতো, বাকি সবগুলোর চেয়ে আলাদা: এ দুটোর ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে বারবার ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এই দীর্ঘ ভ্রমণের সময় নওমি আর আমাকে বারবার জাগানো যাবে, জরুরি অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য। বাকি সবাই যে ধরনের কফিনে শুয়ে আছে সেগুলোর একটা তৈরি করতে খরচ পড়েছে সাত লাখ মার্কিন ডলার, প্রতিটি মাত্র একবার ব্যবহার করা যাবে, আমাদের স্টারশিপ চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর পর শেষ হয়ে যাবে ওগুলোর কর্মক্ষমতা। বাকি দুটো, আমাদের, কফিন বানাতে খরচ পড়েছে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

‘সৎ প্রয়াস,’ কম্পিউটার বলল, ‘তোমার সিস্টেম এখন পুরো ঠিকঠাক। এবার তুমি কফিন থেকে বেরিয়ে আসতে পারো।’

আমার কফিনের ওপর মোটা কাচের আবরণ রয়েছে, একপাশে সরে গেল সেটা; প্যাড লাগানো হাতল ধরে কালো চিনামাটির ফ্রেম থেকে বেরোলাম আমি। ভ্রমণের প্রায় সবটুকু সময় আমাদের শিপ জিরো গ্র্যাভিটিতে চলেছে, তবে এখনকার কম গতির কারণে নিচের দিকে অল্প একটু টান আছে। তার পরও পুরো মাত্রার মাধ্যাকর্ষণের ধারেকাছেও নয় তা, এবং সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। নিজের পায়ের ওপর ১০০ ভাগ স্থির হয়ে দাঁড়াতে এক কি দুদিন সময় লাগবে আমার।

একটা পার্টিশন বাকি সবার কাছ থেকে আমার মডিউলকে আড়াল করে রেখেছে, তাতে আমি পৃথিবীতে ফেলে আসা প্রিয় আর আপন মানুষদের ফটো লাগিয়ে রেখেছি। আমার মা-বাবা, শিল্পার মা-বাবা, আমার আপন বোন, ওর দুই ছেলেমেয়ে। এক প্রস্থ কাপড়চোপড় আমার জন্য ১২০০ বছর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে; তবে প্রবল সন্দেহে ভুগছি—অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে এই ডিজাইন বা স্টাইল। তবু পরলাম। ক্রাইয়োচেম্বারে বিবস্ত্র থাকাই নিয়ম, কিন্তু ঘুম ভাঙার পর অবশ্যই আমাকে সভ্য-ভব্য হতে হবে। কাপড় পরার পর পার্টিশনের পেছন থেকে বেরোচ্ছি, এই সময় দেখলাম একটা সাদা দেয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে নওমি, ওর ক্রাইয়োকফিনকে  আড়াল করে রেখেছে ওটা।

‘মর্নিং,’ বললাম, এমন সুরে, আমি যেন একঘেয়েমির শিকার।

নওমির পরনে নীল ও ধূসর জাম্পসুট, মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং।’

কামরার মাঝখানে সরে এসে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম, বন্ধু হিসেবে একটা অ্যাডভেঞ্চার শেয়ার করতে পারায় দুজনেই আনন্দিত। তারপর দুজন একসঙ্গে ব্রিজের দিকে এগোলাম—মাধ্যাকর্ষণ কম হওয়ায় খানিকটা হেঁটে এগোচ্ছি, খানিকটা ভেসে।

‘তোমার ঘুম কেমন হলো?’ জিজ্ঞেস করল নওমি।

প্রশ্নটা বোকার মতো, তা নয়। আমাদের এই মিশনের আগে কেউ কখনো ক্রাইয়োকফিনে পাঁচ বছরের বেশি থাকেনি। সেটা ছিল শনিগ্রহে পৌঁছানোর অভিযান, অ্যাস্ট্রনমারদের মাত্র পাঁচ বছর বরফ হয়ে থাকতে হয়েছিল। দুরন্ত পথিকৃৎ পৃথিবীর প্রথম স্টারশিপ।

‘ভালো,’ উত্তর দিলাম। ‘তুমি?’

‘ঠিকঠাক,’ বলল নওমি, কিন্তু তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল, চট করে একবার আমার হাত ছুঁলো। ‘আচ্ছা, তুমি কী স্বপ্ন দেখেছ?’

ক্রাইয়োফ্রিজে মস্তিষ্কের কাজ কমতে কমতে এক অর্থে প্রায় থেমে যায়। তবে, শনি মিশনের কয়েকজন সদস্য স্বপ্ন দেখার দাবি করেছিলেন, যদিও পাঁচ বছর সময়সীমার ভেতর সেগুলো দুই কি তিন মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। সে হিসেবে, দুরন্ত পথিকৃৎ যে দীর্ঘ সময় ধরে অভিযানে রয়েছে, বেশ অনেক ঘণ্টা স্বপ্ন দেখে কাটানোর কথা।

মাথা নাড়লাম। ‘কই, দেখলেও মনে নেই। তুমি কিছু দেখেছ কি না, মনে করতে পারো?’

মাথা ঝাঁকাল নওমি। ‘হ্যাঁ। আমি স্বপ্ন দেখেছি জিব্রালটার প্রণালির। ওখানে কখনো গেছ তুমি?’

‘না।’

‘ওটা স্পেনে। স্পেনের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত বলতে পারো। ওই প্রণালির কিনারায় দাঁড়িয়ে ইউরোপ থেকে তুমি আফ্রিকা দেখতে পাবে, এবং স্পেনের দিকটায় নিয়্যানডারথালদের বসতি ছিল।’ নৃ-বিজ্ঞানে নওমি একজন পিএইচডি। ‘কিন্তু ওই প্রণালি কখনোই তারা পেরোতে পারেনি। ওখান থেকে পরিষ্কারই দেখতে পেত যে ওদিকে আরও ভূমি আছে—আরেকটা মহাদেশ!—মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে। সবল একজন সাঁতারু খুব সহজেই পার হতে পারত। আর নৌকা বা ভেলা থাকলে তো কথাই নেই, ভাসতে ভাসতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, নিয়্যানডারথালরা কখনোই ওপারে যায়নি—এমনকি যাবার কোনো চেষ্টাও করেনি।’

‘কিন্তু এত থাকতে জিব্রাল্টার প্রণালির স্বপ্ন দেখলে কেন তুমি?’

‘আগে বলি কি দেখেছি। আমি যেন ওখানকার নিয়্যানডারথাল সমাজের অংশ, সম্ভবত কিশোরী একটি মেয়ে। ওদের সবাইকে আমি বোঝাবার চেষ্টা করছি যে আমাদের উচিত পানির ওপারে যাওয়া, নতুন ভূখণ্ডের দখল নেওয়া। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না, আমার কথা শুনছে না কেউ। আমরা যেখানে রয়েছি সেখানে খাবারদাবার আর আশ্রয়ের কোনো অভাব নেই। ওদের রাজি করতে ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একাই সাঁতরে পার হব। পানি দেখলাম খুব ঠান্ডা, আর ঢেউ ভীষণ উঁচু, বেশির ভাগ সময় ঠিকমতো দম নিতে পারছি না, কিন্তু তাই বলে হাল ছাড়িনি—এক মনে সাঁতরাচ্ছি, সাঁতরাচ্ছি, আর তারপর...’

‘তারপর?’

সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে নওমি বলল, ‘তারপর আমার ঘুম ভেঙে গেল।’

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ‘এবার আমরা পারব। আমি জানি আমরা পারব।’

সামনে পৌঁছাতে ব্রিজের দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল। কামরাটা চৌকো, দুই সারি কনসোল দেখা যাচ্ছে, বড় একটা পর্দার দিকে মুখ করা, এই মুহূর্তে সেটা আলোকিত নয়।

‘সারর থেকে এখন আমরা কত দূরে?’ বাতাসে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।

কম্পিউটার জবাব দিল, ‘১.২ মিলিয়ন কিলোমিটার।’

মাথা ঝাঁকালাম। ‘পর্দায় সামনের দৃশ্য দেখাও।’

‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছে,’ বলল কম্পিউটার।

আমার দিকে ফিরে হাসল নওমি। ‘বাঁশি না বাজতেই ছুটতে চাইছ তুমি, পার্টনার।’

একটু বিব্রত বোধ করলাম। দুরন্ত পথিকৃৎ সাররের দিকে নামছে, যেদিকে ছুটছি আমরা সেদিকে মুখ করে আছে স্টারশিপের ফিউসন এগজস্ট। এগজস্ট থেকে বেরোনো তীব্র তাপ আর শিখায় অপটিক্যাল স্ক্যানার পুড়ে যাবে, ওগুলোর শাটার যদি খোলা হয়।

‘কম্পিউটার, ফিউসন মোটর বন্ধ করে দাও।’

‘পাওয়ার প্রত্যাহার করা হচ্ছে,’ কৃত্রিম কণ্ঠস্বর বলল।

‘যত তাড়াতাড়ি পারো সামনের দৃশ্য দেখাও,’ বললাম আমি।

শিপের ইঞ্জিনগুলো থামতে শুরু করায় মাধ্যাকর্ষণ শূন্য ডিগ্রিতে পৌঁছাচ্ছে। কাছাকাছি কনসোলের গায়ে বসানো একটা হাতল ধরল নওমি। আমি স্রেফ কামরার চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছি। মিনিট দুয়েক পর আলোকিত হলো পর্দা। নক্ষত্র তাও কেটি ঠিক মাঝখানে রয়েছে, বেসবল আকৃতির হলুদ একটা চাকতি। গ্রহ চারটেকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে—মটরশুঁটির দানা থেকে শুরু করে আঙুর আকৃতির।

‘সাররকে বড় করে দেখাও,’ বললাম।

একটা মটরশুঁটির দানা বিলিয়ার্ড বল হয়ে গেল, যদিও তাও কেটি যেমন ছিল প্রায় তেমনই থাকল।

‘আরও,’ বলল নওমি।

গ্রহটা এবার টেনিস বলের দ্বিগুণ। চওড়া একটা কাস্তের মতো দেখাচ্ছে, এদিকের কোন থেকে সম্ভবত চাকতির এক-তৃতীয়াংশ আলোকিত। ভাগ্যকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না—আমাদের দেখা রংচঙে স্বপ্নের সবটুকুর সঙ্গেই সারর একদম মিলে যাচ্ছে। পালিশ করা একটা মার্বেল, সাদা মেঘ দিয়ে ঢাকা, আছে বিশাল এক নীল সমুদ্র, আর...

একটা মহাদেশের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে অন্ধকার থেকে। রংটা সবুজ, তার মানে ধরে নিতে হয় গাছপালায় ঢাকা।

পরস্পরকে আবার আমরা শক্ত করে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলাম। পৃথিবী ছাড়ার সময় কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু জানতাম না, সারর সম্পূর্ণ অনুর্বরও হতে পারত। তবে সেটা মাথায় রেখে প্রস্ত্তত হয়েই এসেছি আমরা: দুরন্ত পথিকৃতের কার্গো হোল্ডে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে, এমনকি বাতাসবিহীন একটা দুনিয়াতেও আমরা টিকে থাকতে পারব। তবে আশা করেছি, এবং প্রার্থনা করেছি, সারর যেন...‌ি‌র্ঠক যেন এ রকম হয়—সত্যিকার একটা বোনের মতো—আরেকটা পৃথিবী, মানবজাতির আরেকটা বাড়ি।

‘কী সুন্দর, তাই না?’ বলল নওমি।

অনুভব করলাম চোখে পানি চলে আসছে। সুন্দর, পাগল করার মতো বিস্ময়কর, এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর। বিরাট সাগর, তুলোর মতো মেঘ, উর্বরা জমিন, আর...

‘ও খোদা,’ বললাম আমি, ‘ও খোদা।’

‘কী?’

‘তুমি দেখতে পাচ্ছ না?’ নরম সুরে বললাম। ‘দেখো!’

 চোখ সরু করল নওমি, পর্দার আরও কাছে সরে গেল। ‘কই? কী?’

‘অন্ধকার দিকটায় তাকাও।’

আবার তাকাল নওমি। ‘ওহ্‌...’ প্রায় আঁতকে ওঠার মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। সাররের গোটা অন্ধকার অংশ জুড়ে আলোর অস্পষ্ট ঝিলিক দেখা যাচ্ছে, দেখা যায় কি যায় না, তবে অবশ্যই আছে ওখানে। ‘আগ্নেয়গিরি হতে পারে?’ বিড় বিড় করল নওমি। মনে হচ্ছে সারর তাহলে অতটা নিখুঁত হয়তো নয়।

‘কম্পিউটার,’ বললাম, ‘গ্রহের অন্ধকার দিকে আলো দেখা যাচ্ছে, বিশ্লেষণ করে ওগুলোর উৎস জানাও।’

‘ওগুলো নিয়ন্ত্রিত আলো, উত্তপ্ত ফিলামেন্ট থেকে আসছে, কালার টেম্পারেচার ৫৬০০ কেলভিন।’

আটকে রাখা দম ছেড়ে নওমির দিকে ফিরলাম। আগ্নেয়গিরি নয়। ওগুলো শহর।

সারর, যে দুনিয়ায় পৌঁছানোর জন্য ১২ শতাব্দী একটানা অবিরাম ছুটেছি আমরা, যে দুনিয়াটাকে আমরা কলোনি বানাতে চেয়েছি, রেডিও টেলিস্কোপের সাহাযে্য পরীক্ষা করার সময় যে দুনিয়া মড়ার মতো চুপ করে ছিল, দেখা যাচ্ছে আগেই সেখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর মাথা কুটতে লাগল কয়েকটা প্রশ্ন: কেমন ওরা? কী ধরনের প্রাণী? হিংস্র? হাত-পা আছে, নাকি সরীসৃপ? কতটা বুদ্ধিমান?

স্টারশিপ দুরন্ত পথিকৃৎ উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম ও প্রস্ত্তত। এই শিপ কোনো কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপযোগী নয়। রওনা হওয়ার সময় যেটাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল তাহলো, পৃথিবী থেকে অন্তত কিছু মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হোক, যাতে যুদ্ধ করতে করতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও মানুষের নমুনা অন্য কোথাও টিকে থাকবে, সেখানে আবার বংশবিস্তার করতে পারবে তারা। স্বল্পমাত্রার দুদুটো পারমাণবিক যুদ্ধ, মিডিয়া যেগুলোর নামকরণ করেছিল ধ্বংস-১ আর ধ্বংস-২, ইতিমধ্যে লড়া হয়ে গেছে— একটা এশিয়ায়, অপরটা দক্ষিণ আমেরিকায়। ধ্বংস-৩ শুরু হওয়াটা মনে হচ্ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মার্কিন প্রতিষ্ঠান সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেসট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইনস্টিটিউট  সংক্ষেপে সেটি, তাও কেটি পর্যবেক্ষণ করে কিছুই জানতে পারেনি, অন্তত ২০৫১ সাল পর্যন্ত নয়। তবে পৃথিবী নিজেও ওই পর্যায়ে মাত্র দেড় শতাব্দী ধরে নিজ অস্তিত্বের কথা প্রচার করছিল, এবং তখন হয়তো নক্ষত্র তাও কেটি তার একটা গ্রহে সভ্যতার বিকাশ ঘটতে দেখছে, যদিও সেই সভ্যতা তখনো রেডিওর ব্যবহার শুরু করেনি। কিন্তু ১২০০ বছর পরের একটা সময় এখন। ইতিমধ্যে তাও কেটিয়ানরা কতটুকু এগিয়েছে কে জানে!

নওমিকে একবার দেখে নিয়ে পর্দার ওপর চোখ রাখলাম। ‘এখন আমাদের কী করা উচিত?’

মাথাটা একদিকে কাত করল নওমি। ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে ওদের সঙ্গে অবশ্যই দেখা করা উচিত, যা-ই হোক ওরা। কিন্তু...’

‘কিন্তু ওরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে নাও চাইতে পারে,’ আমি আমার সন্দেহের কথাটা বললাম। ‘ওরা হয়তো মনে করবে আমরা হামলা করছি, আর...’

‘তা ছাড়া, আরও ৪৮ জন কলোনিস্টের কথা ভাবতে হবে আমাদের,’ বলল নওমি। ‘কারণ, যতটুকু আমরা জানি, মানুষ বলতে মহাবিশ্বে এই কজনই শুধু বেঁচে আছি।’

ভ্রু কোঁচকালাম। ‘ঠিক আছে, নিশ্চিত হওয়া কঠিন কিছু নয়। কম্পিউটার, রেডিও টেলিস্কোপটা আমাদের সৌরজগতের দিকে তাক করো, দেখো কৃত্রিম কোনো কিছু পাও কি না।’

‘এক সেকেন্ড,’ নারীকণ্ঠ সাড়া দিল। কয়েক সেকেন্ড পর একটা হট্টগোল বা হইচইয়ের আওয়াজে ভরে উঠল কামরা, যেন বহু মানুষ একসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে মিশে আছে যান্ত্রিক শব্দজট, মিউজিক, যানবাহনের ব্রেক কষার বিকট আওয়াজ, একটাকে চাপা দিচ্ছে আরেকটা, কখনো কমছে বা বাড়ছে। আমার কানে ইংরেজি ঢুকল, ঢুকল বাংলা, ম্যান্ডারিন আর আরবি...

‘শুধু আমরা এই কটা মানুষ বেঁচে আছি, তা নয়,’ বললাম আমি, ‘আরও বহু মানুষ বেঁচে আছে। পৃথিবী এখনো ধ্বংস হয়ে যায়নি, এখনো ওখানে প্রাণ আছে—কিংবা ১১.৯ বছর আগে ছিল, ওই সংকেতগুলো যখন তৈরি হয়।’

দম ফেলল নওমি। ‘নিজেদের আমরা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিইনি, সে জন্য সত্যি আমি কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত। এবার, এখানকার সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। আমাদের জন্য তাও কেটিতে কি অপেক্ষা করছে আমরা জানি না। কম্পিউটার, সাররের দিকে ডিশ ঘোরাও, কৃত্রিম সংকেতগুলো স্ক্যান করো আবার।’

‘করছি।’ প্রায় এক মিনিট নীরবতা, তারপর যান্ত্রিক শব্দজট শোনা গেল, অস্পষ্ট কিছু মিউজিক, বিপ্-বিপ্, ক্লিক-ক্লিক, তারপর গলার আওয়াজ, কথা বলছে ম্যান্ডারিন, বাংলা, আরবি আর ইংরেজিতে...

‘না, না,’ তাড়াতাড়ি বলল নওমি, ‘পৃথিবীর দিকে নয়, তার উল্টো দিকে ডিশ তাক করতে বলেছি তোমাকে। আমি সারর থেকে কী শব্দ আসে শুনতে চেয়েছি।’

উত্তর শুনে মনে হলো কম্পিউটার যেন সত্যি সত্যি অপমানিত বোধ করছে। ‘ডিশ সাররের দিকেই তাক করা আছে,’ বলল ওটা।

নওমির দিকে তাকালাম আমি, উপলব্ধিতে এতক্ষণে ধরা দিচ্ছে ব্যাপারটা। আমরা যখন পৃথিবী ছেড়ে রওনা হই, মানবজাতি নিজেই নিজের বিলুপ্তি ঘটাতে যাচ্ছে ভেবে এত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে মাথা একটু ঠান্ডা করে কেউ একবার ভেবে দেখিনি সে রকম কিছু না ঘটলে তার পরিণতি কী হবে। মানবজাতি নিজেকে ধ্বংস না করায় যা ঘটেছে, আমরা এখন তার মুখোমুখি। হাতে কয়েক শ বছর সময় পেয়ে পৃথিবীর মানুষ আরও দ্রুতগতি স্পেসশিপ তৈরি করতে পেরেছে। দুরন্ত পথিকৃতের কলোনিস্টরা যখন ক্রাইয়োকফিনে গভীর ঘুমে  আচ্ছন্ন, পৃথিবী থেকে রওনা হওয়া অন্যান্য স্টারশিপ তখন তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছে, পৌঁছে গেছে তাও কেটির সৌরজগতে—কয়েক শতাব্দী যদি নাও হয়, কয়েক দশেক আগে তো বটেই—অন্তত সাররে মানুষের শহর গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট আগে।

‘দূর ছাই, দূর,’ বললাম আমি। ‘সব একদম বৃথা মনে হচ্ছে।’ পর্দার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছি। জেতার কথা তো কচ্ছপের, অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে খরগোশ জিতে বসে আছে।

‘এখন কী করব আমরা?’ জানতে চাইল নওমি।

বড় করে শ্বাস নিলাম। ‘ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।’

‘আমরা...ওরা আমাদের প্রতিপক্ষ ভাবতে পারে।’

হাসি পেল। ‘আমরা দুজনেই প্রতিপক্ষ হতে পারি না। রেডিওতে আমরা ম্যান্ডারিন আর বাংলা শুনিনি? হাজার বছর বা আরও দূর  অতীতে যে যুদ্ধ হয়েছে, তা নিয়ে কে এখন মাথা ঘামাবে, বলো? তা ছাড়া...’

‘মাফ করো,’ কম্পিউটার বলল, ‘অডিও মেসেজ আসছে।’

নওমির দিকে তাকালাম। ভ্রু কোঁচকাল ও, বিস্মিত দেখাচ্ছে।

‘শোনাও দেখি,’ বললাম আমি।

‘দুরন্ত  পথিকৃৎ,স্বাগতম!  আমি মির করিমভ, নীল আর্মস্ট্রং স্পেস স্টেশনের ম্যানেজার, সাররের চারদিকে নিজস্ব কক্ষপথে রয়েছি। তোমাদের স্টারশিপে কেউ কী জেগে আছ তোমরা?’ এটা একটা পুরুষকণ্ঠ, বাচনভঙ্গি এমন যে আগে কখনো শুনেছি বলে  মনে করতে পারছি না।

আমার দিকে তাকাল নওমি, যেন বুঝতে চাইছে আমি কোনো আপত্তি জানাই কি না, তারপর মুখ খুলল, ‘কম্পিউটার, একটা উত্তর পাঠাও।’ আলো মিটমিট করে কম্পিউটার জানাল চ্যানেল খোলা আছে। ‘আমি দুরন্ত পথিকৃতের কো-ক্যাপটেন, ডক্টর নওমি ইয়াং বলছি। এখানে আমরা দুজন ক্রাইয়োচেম্বার থেকে বেরিয়েছি, আরও ৪৮ জন এখনো ঘুমাচ্ছে।’

‘শুনুন, শুনুন,’ ভেসে এল মির করিমভের কণ্ঠস্বর। ‘আপনারা যে গতিতে আসছেন তাতে এখানে পৌঁছাতে কয়েক দিন লেগে যাবে। কেমন হয় আমরা যদি একটা শিপ পাঠিয়ে আপনাদের এই এন এ স্পেস স্টেশনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি? আপনাদের তুলে আনার জন্য এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে আমাদের লোক।’

‘চাঁছাছোলা ভাষা, মাতব্বরি ভাব, খেয়াল করছ?’ বিড় বিড় করলাম আমি।

‘কী বললেন?’ জিজ্ঞেস করলেন করিমভ। ‘আমরা ঠিক শুনতে পাচ্ছি না।’

মুখভঙ্গির সাহাযে্য আমার সঙ্গে ভাব বিনিময় করল নওমি, তারপর মির করিমভের প্রস্তাবে রাজি হয়ে বলল, ‘শিওর। আমরা অপেক্ষা করছি।’

‘অল্প একটু,’ বললেন করিমভ, তারপর স্পিকার ডেড হয়ে গেল।

আমাদের নিতে মির করিমভ নিজেই চলে এলেন। তাঁর গোলাকার শিপকে আমাদের শিপের তুলনায় খুদেই বলতে হবে, কিন্তু ভেতরের  বাসযোগ্য পরিসর প্রায় একই মাপের মনে হলো। পদে পদে অধম মনে হচ্ছে নিজেদের। হাজার বছরে ডকিং অ্যাডাপ্টার কম বদলায়নি, এয়ারটাইট সিল না থাকায় তাঁর শিপে স্থানান্তর হওয়ার জন্য স্পেস সুট ব্যবহার করতে হলো আমাদের। নতুন শিপে আসার পর যখন দেখলাম এখানেও অনায়াসে ভেসে থাকতে পারছি, মনটা খুশি হয়ে উঠল—ওদের কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ থাকাটা অতিরিক্ত বলে মনে হতো।

মির করিমভকে প্রথমে আমি একটু ভুল বুঝেছিলাম; এখন দেখছি তিনি অত্যন্ত ভদ্র, বুদ্ধিমান এবং অমায়িক। আমার প্রশ্নের উত্তরে বয়স মাত্র ৩০ বললেন। সাংঘাতিক প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ। তবে তাঁর আসল বয়স সম্পর্কে আমার সত্যি কোনো ধারণা নেই! মানুষ এখন শত শত বছর তরুণ থাকার কৌশল জেনে ফেলেছে। তিনি নিজের জাতীয়তা, জন্মস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু বললেন না। আমরা ধরে নিলাম তিনি একজন চেচেন, রুশ এলাকায় জন্ম। তবে একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ল, নওমিকে তিনি বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছেন। নওমি হেলমেট খোলার সময়, ওর হৃদ্পিণ্ড আকৃতির মুখ আর কোমর পর্যন্ত লম্বা ঘন কালো চুল যখন উন্মোচিত হচ্ছে, তাঁর চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।

‘হ্যালো,’ বললেন তিনি, মুখ জুড়ে মস্ত হাসি।

হাসল নওমিও। ‘হ্যালো। আমি নওমি ইয়াং। আর এ সৎ প্রয়াস, আমার কো-ক্যাপটেন।’

‘অভিনন্দন,’ বললাম আমি, ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম তাঁর দিকে।

ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন করিমভ, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কী করতে হবে, জানা নেই তাঁর। আমার ভঙ্গি নকল করে তিনিও নিজের হাতটা বাড়ালেন, তবে আমাকে স্পর্শ করলেন না। দূরত্ব কমিয়ে আমি তাঁর হাত ধরে চাপ দিলাম। তাঁকে বিস্মিত দেখাল, তবে খুশি হয়েছেন।

‘প্রথমে আপনাদের স্টেশনে নিয়ে যাব,’ বললেন তিনি। ‘মাফ করবেন...ইয়ে, মানে...আমাদের গ্রহতে এখনই আপনারা যেতে পারবেন না, তার আগে কিছু সময় কোয়ারানটিনে থাকতে হবে। আমরা অনেক রোগই নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছি আপনাদের সময়কার, কাজেই সেগুলো ঠেকাতে এখন আর টিকা-ইনজেকশন দিতে হয় না। আমার নিজের ঝুঁকি নিতে আপত্তি নেই, কিন্তু...’

মাথা ঝাঁকালাম। ‘সেটা ঠিক আছে।

মাথায় হালকা টোকা দিলেন করিমভ, মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক দেখাল তাঁকে, তারপর বললেন, ‘শিপকে বললাম আমাদের স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। ওটা মেরু থেকে মেরু কক্ষপথে ঘুরছে, সারর থেকে ২০০ কিলোমিটার ওপরে। স্টেশন থেকে আমাদের দুনিয়ার ভারি সুন্দর সব দৃশ্য দেখতে পাবেন আপনারা।’ তাঁর হাসি কান পর্যন্ত লম্বা হলো। ‘আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে অসম্ভব ভালো লাগছে আমার,’ আবার বললেন। ‘চোখের সামনে যেন ইতিহাসের একটা পাতা খুলে গেল।’

‘আমাদের সম্পর্কে যদি জানতেনই,’ প্রশ্ন করলাম আমি, স্পেস স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু হওয়ার পর, ‘তাহলে আরও আগে কেন তুলে আনলেন না আমাদের ?’

খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করলেন করিমভ। ‘আপনাদের সম্পর্কে আমরা কিছু জানতাম না।’

‘জানতেন না? কিন্তু আপনি আমাদের সম্বোধন করেছেন  দুরন্ত পথিকৃৎ  বলে।’

‘ও, আচ্ছা। নামটা তো আপনাদের খোলে লেখা আছে, একেকটা হরফ তিন ফুটের কম না। আমাদের গ্রহাণু-তল্লাশি সিস্টেম শনাক্ত করে ওই শিপকে। আপনাদের সময়কার প্রচুর তথ্য হারিয়ে গেছে—ধারণা করি, ওই সময় মারাত্মক রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, তাই না? তবে আমরা জানতাম একুশ শতাব্দীতে স্লিপার শিপ নিয়ে পৃথিবীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল।’

 স্পেস স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি আমরা। প্রকাণ্ড একটা রিং বা বলয়, গ্র্যাভিটিকে এড়াবার জন্য সারাক্ষণ পাক খাচ্ছে। এটা অর্জন করতে আমাদের হয়তো হাজার বছর সময় লেগে গেছে, তবে শেষ পর্যন্ত মানবজাতি এমন স্পেস স্টেশন বানাতে পেরেছে ঠিক যেমনটি মানুষ পারুক বলে আশা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা।

এন এ স্পেস স্টেশনের পাশে একটা স্পেসশিপ স্থির ভেসে রয়েছে, টাকু আকৃতির রুপালি খোল, দুপাশে দুপ্রস্থ পান্নাসবুজ ডানা।

‘ভারি সুন্দর তো,’ বললাম আমি।

এক মুখ হাসি নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন করিমভ।

‘তবে, ওটা ল্যান্ড করে কীভাবে? লেজের ওপর?’

‘ল্যান্ড করে না, ওটা একটা স্টারশিপ।’

‘কিন্তু যদি ল্যান্ড করতে না পারে, ওটা তাহলে এত মসৃণ কেন? শুধুই সুন্দর দেখাবার জন্য?’

করিমভ হাসলেন, তবে সেটা ভদ্রোচিত নরম হাসি। ‘প্রয়োজন, তাই ওটা মসৃণ। প্রায় আলোর গতিতে ছোটার সময় শিপের দৈর্ঘে্য বাস্তব সংকোচন সৃষ্টি হয়, এর মানে হলো নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রের মাঝখানের মিডিয়াম অনেক বেশি ঘন। যদিও সেটা প্রতি কিউবিক  সেন্টিমিটারে মাত্র এক ব্যারিয়ন, তবু আপনি যথেষ্ট দ্রুতবেগে ছুটলে...’

‘বলতে চাইছেন আপনারা অত দ্রুতবেগে ছুটতে পারেন?’ প্রশ্ন করল নওমি।

‘হ্যাঁ,’ হাসিমুখে জানালেন করিমভ। ‘আমাদের স্টারশিপ পারে।’

মাথা নাড়ল নওমি। ‘আমরা আসলে পাগল,’ বলল ও। ‘এই অভিযান শুরু করাটা স্রেফ একটা পাগলামি ছিল।’ করিমভের দিকে একবার তাকালেও, সরাসরি তাঁর চোখে তাকাতে পারল না। মাথা নিচু করে মেঝের ওপর স্থির রাখল দৃষ্টি। ‘জানি আপনি আমাদের গাধা ভাবছেন...’

করিমভ চোখ বড় করলেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আমার দিকে ফিরে হাত দুটো দুপাশে মেলে ধরলেন, যেন সমর্থন পাওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। তবে আমি শুধু নিঃশ্বাস ফেলছি, চেষ্টা করছি বাতাসের সঙ্গে হতাশাও যাতে বেরিয়ে যায়।

‘আপনি ভুল করছেন,’ অবশেষে মুখ খুললেন করিমভ। ‘এর চেয়ে বেশি ভুল আর কিছু হতে পারে না। আপনাদের আমরা সম্মান করি।’ থামলেন, অপেক্ষায় আছেন কখন নওমি মুখ তুলে তাকাবে। মুখ তুলল নওমি, ভ্রু জোড়া প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে। ‘আমরা যদি আপনাদের চেয়ে বেশি দূরে এসে থাকি,’ বললেন করিমভ, ‘কিংবা আমরা যদি আপনাদের চেয়ে দ্রুতবেগে এসে থাকি, তার কারণ আপনাদের করে রেখে আসা কাজগুলো দেখে, ওগুলোর সাহায্য নিয়ে  নতুন কলাকৌশল আবিষ্কার করতে পেরেছি আমরা। মানুষ আজ এখানে, কারণ এখানে আসা আমাদের জন্য সহজ ছিল, কারণ আপনারা এবং আপনাদের আগে অন্যরা এই পথ তৈরি করে রেখেছিলেন।’ আমার দিকে তাকালেন তিনি। ‘আমরা যদি আরও দূর দেখতে পাই,’ বললেন, ‘তার কারণ আমরা বড়দের কাঁধে চড়ে আছি।’

সেদিন আরও পরে আমি, নওমি আর করিমভ স্পেস স্টেশনের মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করছি। আমি আর নওমি একটা সেকশনের সীমিত অংশে বন্দী। আরও ১০ দিন পর সাররে নামার অনুমতি পাব আমরা।

‘এখানে আমাদের জন্য ঘোড়ার ডিম কিছুই নেই,’ বলল নওমি, হাত দুটো পকেটের গভীরে। ‘আমরা স্রেফ উটকো ঝামেলা। যেন কেউ ত্যাং সাম্রাজ্য থেকে আমাদের দুনিয়ায় উঠে এসেছে।’

‘সারর ধনী গ্রহ,’ বললেন করিমভ। ‘আমরা আপনাদের এবং প্যাসেঞ্জারদের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে সবরকম চাহিদা মেটাতে পারব।’

‘প্যাসেঞ্জার নয়,’ গলা চড়িয়ে বললাম আমি, ‘ওরা কলোনিস্ট। ওরা এক্সপ্লোরার।’

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন মির করিমভ। ‘আমি দুঃখিত। অবশ্যই আপনার কথা ঠিক। কিন্তু শুনুন—আপনারা এখানে আসায় সত্যি আমরা দারুণ খুশি। মিডিয়াকে আমি দূরে সরিয়ে রেখেছি, কোয়ারানটিন আমাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু আপনারা সাররে নামার পর ওরা স্রেফ পাগলা কুকুর হয়ে উঠবে। ব্যাপারটা হবে আপনার দরজায় নিল আর্মস্ট্রং বা কৃষ্ণা আচারিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার মতো।’

‘কৃষ্ণা...কে?’ জিজ্ঞেস করল নওমি।

‘দুঃখিত। আপনাদের পরের সময়কার। ওই মহিলা প্রথম আলফা সেঞ্চুরিতে পৌঁছাতে পেরেছেন।’

‘প্রথম,’ শব্দটা পুনরাবৃত্তি করলাম, জানি নিজের তিক্ততা গোপন রাখতে পারছি না। ‘ওটাই তো সম্মান—ওখানেই তো অর্জন। প্রথম হওয়া। চাঁদে দ্বিতীয় যে ব্যক্তি গিয়েছিলেন তাঁর কথা কেউ মনে রাখেনি।’

‘এডউইন ইউজিন অলড্রিন,’ বললেন করিমভ। ‘পরিচিত ছিলেন ‘‘বাজ’’ নামে।’

‘চমৎকার। ঠিক আছে,’ বললাম আমি।  ‘আপনি  মনে রেখেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ মনে রাখে না।’

‘আমিও মনে রাখিনি, তথ্যটা এইমাত্র সংগ্রহ করলাম।’ মির করিমভ তাঁর মাথায় টোকা মারলেন। ‘প্ল্যানেটরি ওয়েবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, সবারই একটা করে আছে।’

সশব্দে দম ফেলল নওমি, আমার মতো ও-ও বুঝতে পারছে দুই প্রজন্মের মাঝখানের ফাঁকটা বিশাল। ‘সে যাই হোক, তা সত্ত্বেও,’ বলল নওমি, ‘আমরা পাইওনিয়ার বা পথিকৃৎ নই, আমরা কলোনিস্টও নই। আমরা স্রেফ...এই আছি আর কী। আমরা আপনাদের চেয়ে আগে হয়তো রওনা হয়েছি, কিন্তু আপনারা এখানে আমাদের চেয়ে অনেক আগে পৌঁছেছেন।’

‘ঠিক আমরা না, আমাদের পূর্বপুরুষেরা,’ বললেন করিমভ। ‘আমি একজন ষষ্ঠ প্রজন্মের সাররবাসী।’

 ‘ষষ্ঠ প্রজন্ম?’  বললাম আমি। ‘এই কলোনি তাহলে এখানে কত দিন ধরে আছে?’

‘আমরা এখন আর কলোনি না, আমরা এখন স্বাধীন একটা দুনিয়া। তবে যে স্টারশিপ প্রথম এখানে পৌঁছেছিল সেটা পৃথিবী থেকে রওনা হয়েছিল ২১০৭ সালে। আমার পূর্বপুরুষেরা সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে এসেছিলেন, তা কিন্তু নয়। তাঁরা আরও অনেক পরে এসেছেন।’

‘২১০৭ খ্িরস্টাব্দ,’ পুনরাবৃত্তি করলাম। তার মাত্র ৫৬ বছর আগে  দুরন্ত পথিকৃৎ  আমাদের নিয়ে রওনা হয়েছিল। রওনা হওয়ার সময় আমার বয়স ছিল ১৮। যদি পৃথিবীতে থেকে যেতাম, সত্যিকার পথিকেরা রওনা হচ্ছেন এটা দেখার জন্য হয়তো বেঁচে থাকতাম আমি। পৃথিবী ত্যাগ করার সময় আসলে ঠিক কী ভাবছিলাম আমরা? আমরা কি পালাচ্ছিলাম, নিজেদের জান নিয়ে, চূড়ান্ত বোমাটা পড়তে আর বেশি দেরি নেই বুঝতে পেরে? আমরা কি সত্যি পথিকৃৎ ছিলাম, নাকি কাপুরুষ?

না  না, এসব একজন পাগলের চিন্তা। আমরা রওনা হই ওই একই কারণে, যে কারণে হোমো সেপিয়ানরা জিব্রাল্টার প্রণালি পার হয়েছিল। কাজটা আমরা একটা প্রজাতি হিসেবে করেছি। এর জন্যই আমরা বিজয়ী হয়েছি, আর পরাজিত হয়েছে নিয়্যানডারথালরা। আমাদের দেখার দরকার ছিল অপর দিকে কী আছে, পরবর্তী পাহাড়ের ওপারে কী আছে, আর সব নক্ষত্রকে ঘিরে কী ঘুরছে। অজানাকে জানার এই আকাঙ্ক্ষাই গ্রহবাড়ির ওপর কতৃ‌র্ত্ব স্থাপনে সাহায্য করেছে আমাদের, আর এটাই আমাদের ভবিষ্যতে অনন্ত-অসীম মহাশূন্যের রাজা-মহারাজা বানাতে যাচ্ছে।

নওমির দিকে ফিরলাম, বললাম, ‘আমরা এখানে থাকতে পারি না।’

খানিক চিন্তা করল নওমি, তারপর মাথা ঝাঁকাল। করিমভের দিকে তাকাল ও, বলল, ‘আমরা সংবর্ধনা, প্যারেড, শোভাযাত্রা, পদক —এসব কিছুই চাই না।’ ভ্রু জোড়া উঁচু করল, যেন যে জিনিসটা চায় সেটার মাহাত্ম বোঝাবার চেষ্টায়। ‘আমরা একটা নতুন শিপ চাই, অত্যন্ত দ্রুতগতি হতে হবে সেটাকে।’ আমার দিকে তাকাল, ওর সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালাম আমি। হাত তুলে জানালার বাইরেটা দেখাল ও। ‘একটা মসৃণ স্টারশিপ।’

‘ওটা নিয়ে কী করবেন আপনারা?’ জানতে চাইলেন করিমভ।  ‘কোথায় যাবেন?’

আমাকে একবার দেখে নিয়ে তাঁর দিকে ফিরল নওমি। ‘অ্যান্ড্রমেডা।’

‘অ্যান্ড্রমেডা? আপনি বলতে চাইছেন অ্যান্ড্রমেডা গ্যালাক্সি? কিন্তু সেটা তো...’ এক পল বিরতি, সন্দেহ নেই তাঁর ওয়েব লিঙ্ক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। ‘...২.২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে।’

‘ঠিক তাই।’

‘কিন্তু...কিন্তু ওখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে দুই মিলিয়ন বছরেরও বেশি।’

‘সেটা শুধু পৃথিবীর...মাফ করবেন, সাররের...দৃষ্টিভঙ্গিতে,’ বলল নওমি। ‘আমরা এখনকার চেয়ে কম সাবজেক্টিভ সময়ে কাজটা করতে পারব, এবং, অবশ্যই, পুরোটা সময় আমরা ক্রাইয়োজেনিক ফ্রিজে থাকব।’

‘আমাদের কোনো শিপে ক্রাইয়োজেনিক চেম্বার নেই,’ করিমভ জানালেন। ‘তার কোনো প্রয়োজনও নেই।’

‘দুরন্ত পথিকৃৎ থেকে চেম্বারগুলো খুলে নেওয়া যায়।’

 মাথা নাড়লেন করিমভ। ‘ওটা ওয়ান-ওয়ে জার্নি হবে, আপনারা আর কখনো ফিরতে পারবেন না।’

‘কথাটা সত্যি নয়,’ আমি বললাম। ‘অন্য সব গ্যালাক্সি  দূরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু অ্যান্ড্রমেডা গ্যালাক্সি তা যাচ্ছে না—ওটা সরে আসছে মিল্কি ওয়ে, অর্থাৎ আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের দিকে। একসময় এই দুটো গ্যালাক্সি এক হবে, আমাদের ফিরিয়ে আনবে বাড়িতে।’

‘সেটা ঘটবে কয়েক শত কোটি বছর ভবিষ্যতে।’

‘ছোটখাটো চিন্তাভাবনা এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য ভালো কিছু দিতে পারেনি,’ বলল নওমি।

করিমভ ভ্রু কোঁচকালেন। ‘আমি বলেছি, আপনাদের এবং বাকি সব কলোনিস্টদের ভরণপোষণ করার সামর্থ্য সাররের আছে, এ-কথা সত্যি। কিন্তু স্টারশিপ অসম্ভব দামি। আপনাদের আমরা এমনি একটা দিয়ে দিতে পারি না।’

‘আমাদের পেছনে যে খরচ হবে, ধারণা করি তার চেয়ে সস্তাই পড়বে।’

‘না, তা সত্যি নয়।’

‘আমাদের সম্মান করার কথা বলেছেন আপনি। বলেছেন আপনারা আমাদের কাঁধের ওপর চড়ে আছেন। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে উপকারের বিনিময়ে উপকার করুন। আমাদের একটা সুযোগ দিন, এবার যাতে আপনাদের কাঁধে চড়তে পারি আমরা। নতুন একটা স্টারশিপ আমাদের সত্যি দরকার।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন করিমভ, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তিনি ভাবছেন নওমির অনুরোধ রক্ষা করা কতটা কঠিন তা আমরা বুঝতে চাইছি না। ‘দেখি কতটুকু কি করা যায়,’ বললেন তিনি।

সন্ধ্যাটা আমি আর নওমি নিজেদের মধ্যে আলাপ করে কাটালাম, আমাদের নিচে সারাক্ষণ রাজকীয় ভঙ্গিতে চক্কর দিচ্ছে নীল-সবুজ সারর। আমাদের কাজ হলো দুজন একমত হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শুধু নিজেদের কথা ভেবে নয়, দুরন্ত পথিকৃতের আরও ৪৮ জন সদস্যের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথাও মাথায় রাখতে হবে। ওদের ভালো-মন্দ সব আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, কাজেই কোনো রকম ভুল করা চলবে না। ওরা কি এখানে ঘুম থেকে জাগতে চাইত?

না। অবশ্যই না। ওরা পৃথিবী ছেড়ে এসেছে একটা কলোনি পাওয়ার জন্য। ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্নই দেখুক, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে নিজেদের সিদ্ধান্ত ওরা বদলেছে। তাও কেটির সঙ্গে ওদের কারোরই আবেগপ্রবণ কোনো সম্পর্ক বা বন্ধন ছিল না, থাকার  কথাও নয়। ওটা ছিল স্রেফ অঙ্ক আর যুক্তি দিয়ে লক্ষ্যবস্ত্ত করার উপযোগী একটা নক্ষত্র।

‘আমরা বলতে পারি, পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও,’ বললাম আমি।

‘তা তুমি চাও না,’ বলল নওমি। ‘তা, আমি নিশ্চিত, বাকি কেউও চাইবে না।’

‘না, তোমার কথাই ঠিক,’ আমি বললাম। ‘ওরা চাইবে আমরা এগোতে থাকি।’

মাথা ঝাঁকাল নওমি। ‘আমার তাই ধারণা।’

‘অ্যান্ড্রমেডা,’ বললাম আমি, হাসছি। ‘কোত্থেকে এল ওটা?’

কাঁধ ঝাঁকাল নওমি। ‘ফট করে ওটাই প্রথম ঢুকল মাথায়।’

‘অ্যান্ড্রমেডা,’ আবার উচ্চারণ করলাম, শব্দটা পরীক্ষা করছি। আরেকটা গ্যালাক্সি, আরেকটা দ্বীপ বিশ্ব। ‘কেন যাব না?’ চুপ করে আছি আমি, তবে খানিক পর অন্য একটা প্রসঙ্গ তুললাম। ‘মির ভাই মনে হচ্ছে তোমাকে বেশ পছন্দ করেন।’

নওমি হাসল। ‘ওকে আমার ভালো লাগে।’

‘সময়টা তাহলে তোমরা একসঙ্গে উপভোগ করতে পারো।’

‘কী?’ গলার আওয়াজ শুনে মনে হলো নওমি খুব অবাক হয়েছে।

‘সময়টা তোমরা একসঙ্গে কাটাতে পারো, তাঁকে যদি ভালো লাগে তোমার। চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে শিল্পার ঘুম না ভাঙানো পর্যন্ত আমাকে হয়তো একা থাকতে হবে, কিন্তু তোমার নিঃসঙ্গ থাকার কোনো দরকার নেই। এমনকি ওরা যদি একটা নতুন শিপ দেয় আমাদের, ক্রাইয়োচেম্বার স্থানান্তর করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।’

কোটরের ভেতর চোখ ঘোরাল নওমি। ‘তোমরা ছেলেরা না!’ মুখে যাই বলুক, আমি জানি আইডিয়াটা ওর ভালো লেগেছে।

করিমভ ঠিকই বলেছিলেন, সাররের মিডিয়া নওমি আর আমাকে নিয়ে মহা শোরগোল বাধিয়ে দিল। সেটা শুধু আমাদের উত্তেজক চেহারা-সুরতের জন্যে নয়—আমার শ্যামলা রং, কালো চোখ; নওমির  হলুদ ত্বক, চোখের ওপরে ভাঁজ খাওয়া চামড়া; আমাদের কথার মধ্যে অদ্ভুত টান, দুটোই তেত্রিশ শতাব্দীর মানুষ যে বাচনভঙ্গিতে কথা বলে তার সঙ্গে একদমই মেলে না। তারা এমনকি আমাদের মধ্যে পথিকৃৎ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখেও মুগ্ধ।

কোয়ারানটিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর ওদের গ্রহে নামলাম আমরা। তাপমাত্রা যতটা ঠান্ডা হলে আমার ভালো লাগত তার চেয়ে একটু বেশি, বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প আছে—তবে মানুষ আসলে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। ওদের রাজধানী ওয়ারীর স্থাপত্যরীতিতে অলংকরণের দারুণ দাপট, প্রচুর ছাদ গম্বুজ আকৃতির এবং যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই জটিল সব খোদাইকর্ম চোখে পড়ছে। বিশ লাখ স্থানীয় সরকার মিলে দেশ চালায়। গোটা গ্রহ একটা দেশ। যেকোনো বিতর্কিত বিষয়ে স্থানীয় সরকার ভোটাভুটির ব্যবস্থা করতে পারে। ২০ লাখ নির্বাচিত প্রতিনিধি যে যাঁর ঘরে বসে ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেমের সাহাযে্য ভোট দিয়ে এক ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন। আমাদের একটা স্টারশিপ দেওয়া হবে কি হবে না, সেটাও ভোটাভুটিতে দেওয়া হলো, এতে অংশগ্রহণ করছে স্বেচ্ছায় উপস্থিত হওয়া সাধারণ ও গণ্যমান্য কিছু মানুষ, সবাই তাঁরা রাজধানীর বাসিন্দা।

ওয়ারীর প্রধান চৌরাস্তায় রয়েছি আমরা; আমি, নওমি আর করিমভ। খানিক পর একাই একটা খুদে মোটর কার উড়িয়ে হাজির হলেন সাররের প্রেসিডেন্ট দুর্জয় কাপাডিয়া, সঙ্গে না আছে এসকর্ট, না আছে দেহরক্ষী, এমনকি দলীয় চাটুকার বাহিনীও অনুপস্থিত। সবাই আমরা দৈত্যাকার টিভি পর্দার সামনে ভোটের ফলাফল জানার অপেক্ষায় বসে আছি। তাও কেটি সিস্টেমের সবখান থেকে প্রতিনিধিত্ব করছে মিডিয়া, তাদের সঙ্গে পৃথিবীর একজনও আছে, তার প্রতিবেদন সব সময় পড়া যাবে সে ওটা ফাইল করার ১১.৯ বছর পর। এখানে সশরীরে উপস্থিত রয়েছে হাজার খানেক কৌতূহলী দর্শক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

‘বন্ধুরা,’ উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বললেন দুর্জয় কাপাডিয়া, হাত দুটো দুপাশে মেলে ধরলেন ভদ্রমহিলা। ‘আপনারা সবাই ভোট দিয়েছেন, এবার আসুন রেজাল্ট শেয়ার করা যাক।’ মাথায় ছোট একটা টোকা দিলেন তিনি, একমুহূর্ত পর উল্লাসধ্বনির সঙ্গে হাততালি দিতে শুরু করল উপস্থিত জনতা।

আমি আর নওমি ঘাড় ফিরিয়ে করিমভের দিকে তাকালাম, দেখলাম আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে তাঁর চোখ-মুখ। ‘কী ব্যাপার?’ জানতে চাইল নওমি। ‘রেজাল্ট বলছেন না কেন?’

বিস্মিত দেখাল করিমভকে। ‘ও হো হো, দুঃখিত। আপনাদের সঙ্গে যে ওয়েব ইমপ্ল্যান্ট নেই সেটা একদম ভুলে বসে আছি। শিপ আপনারা পাচ্ছেন—কংগ্রাচুলেসন্স!’

চোখ বুজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নওমি। বুকের ভেতর ধক ধক করছে আমার হদ্পিণ্ড।

প্রেসিডেন্ট কাপাডিয়া আমাদের দিকে তাকালেন। ‘মিস্টার সৎ প্রয়াস, এবং মিস নওমি ইয়াং—আপনারা কিছু বলবেন নাকি?’

পরস্পরের দিকে তাকালাম আমরা, তারপর দাঁড়ালাম। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ,’ এই শব্দ দুটো ছাড়া আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, ট্রাউজারের ভেতর আমার হাঁটু দুটো ঠক ঠক করে কাঁপছে।

তবে নওমি রীতিমতো ছোটখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল, শেষ করল সাররবাসীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।

একজন রিপোর্টার গলা চড়িয়ে জানতে চাইলেন, ‘শিপ তো পেয়ে গেছেন, ওটার নাম কী রাখবেন?’

ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করছে নওমি, আমি ঠোঁট জোড়া চেপে রেখেছি। তারপর আমিই বললাম, ‘কী আবার, দুরন্ত পথিকৃৎ ২।’

আবার শুরু হলো হাসি আর হাততালি।

অবশেষে সেই বিস্ময়কর দিন উপস্থিত হলো, আজ আমরা নিজেদের নিয়তি বেছে নিতে যাচ্ছি। নতুন স্টারশিপে আমাদের আনুষ্ঠানিক সওয়ার হতে এখনো ঘণ্টা চারেক দেরি আছে,  কিন্তু তবু আমি আর নওমি এয়ারলক অভিমুখে রওনা হয়ে গেছি। ওই এয়ারলক স্পেস স্টেশনের বাইরের কিনারার সঙ্গে আমাদের শিপটাকে জুড়ে রেখেছে। নওমি আরেকবার সব দেখে নিতে চাইছে, আর আমি চাইছি শিল্পার ক্রাইয়োচেম্বারের পাশে বসে থেকে কিছুটা সময় কাটাব, মনের সাহাযে্য ওকে কিছু বলব, ওর কিছু কথা শুনব।

আমরা হাঁটছি, বাঁকা করিডর ধরে ছুটতে ছুটতে আমাদের পাশে চলে এলেন করিমভ, রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন।

‘প্রয়াস,’ বললেন তিনি, দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘নওমি।’

‘জি?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি।

নওমিকে দেখে মনে হলো কি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। গত কয়েক সপ্তায় ওরা দুজন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, তবে আমি যতটুকু জানি কাল রাতে ওরা দুজন নিভৃতে একা হয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। নওমি সম্ভবত আশা করেনি আমরা যাত্রা শুরুর আগে করিমভের সঙ্গে আবার ওর দেখা হবে।

‘তোমাদের দুজনকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত,’ বললেন তিনি। ‘জানি, দুজনেই খুব ব্যস্ত, কিন্তু...’ রীতিমতো নার্ভাস দেখাচ্ছে ভদ্রলোককে।

‘জি, বলুন?’ অপেক্ষা করছি আমি।

আমার দিকে তাকালেন করিমভ, তারপর নওমির দিকে। ‘জায়গা হবে? একজন প্যসেঞ্জারকে জায়গা দিতে পারবে তোমরা?’

হাসল নওমি। ‘আমাদের প্যাসেঞ্জার নেই। আমরা কলোনিস্ট।’

‘দুঃখিত,’ বললেন করিমভ, নওমির দেখাদেখি তিনিও হাসছেন এখন। ‘তোমাদের ওখানে আরেকজন কলোনিস্টের জায়গা হবে?’

 নওমি আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিচ্ছে। ‘শোনো, মির, আমাদের চারটে অতিরিক্ত ক্রাইয়োচেম্বার আছে ঠিকই, কিন্তু...’ এবার আমার দিকে তাকাল ও।

‘অসুবিধে কী?’ বলে কাঁধ ঝাঁকালাম। ‘আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না।’

‘জানো তো, এই অভিযানে প্রচণ্ড খাটাখাটনি আছে,’ বলল নওমি, করিমভের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। ‘যেখানেই আমরা থামি, সেটা হবে কঠিন একটা পরিস্থিতি।’

মাথা ঝাঁকালেন করিমভ। ‘সব জানি, তার পরও আমি এটার অংশ হতে চাই।’

নওমি জানে আমার সামনে ওর লজ্জিত বা বিব্রত হওয়ার দরকার নেই। ‘সেটা ভারি চমৎকার হবে,’ বলল ও। ‘কিন্তু...কিন্তু কেন?’

আলতো ভঙ্গিতে নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলেন করিমভ, নওমির একটা কবজি খুঁজে নিল তাঁর হাত। কবজিতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, ‘একটা কারণ তুমি,’ বললেন তিনি।

‘এক অর্থে আমার বয়স ১২ বছর, আমার তুলনায় তুমি একটা দুগ্ধপোষ্য শিশু,’ বলল নওমি। ‘অ্যান্ড্রমেডা অভিযানে তোমাকে নিলে তুমি আমার সব হুকুম ঠিকমতো মেনে চলবে তো?’

হেসে ফেললেন করিমভ। ‘সব মেনে চলব।’

‘তুমি বললে, একটা কারণ আমি,’ স্মরণ করিয়ে দিল নওমি।

মাথা ঝাঁকালেন করিমভ। ‘অপর কারণটা...ঠিক আছে, সেটা হলো: আমি বড়দের কাঁধে অনেক চড়েছি, তাই আর চড়ে থাকতে চাই না।’ বিরতি নিলেন, নিজের কাঁধ দুটো উঁচু করলেন একটু, যেন স্বীকার করছেন তিনি তাঁর মনের যে ভাব প্রকাশ করতে যাচ্ছেন সেটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা বিরল ঘটনা। ‘আমি নিজে বড় হতে চাই।’

স্পেস স্টেশনের লম্বা করিডর ধরে আবার যখন আমরা হাঁটছি, নওমির একটা হাত ধরে থাকলেন করিমভ। আমাদের সামনে রয়েছে মসৃণ, চকচকে, রাজকীয় আকৃতি নিয়ে একটা স্টারশিপ। ওটায় চড়ে আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে যাব।

বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে

অলংকরণ: পলাশ