গণিতের জগতে আমার পথচলা

আমার ছেলেবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এই ব্যস্ত শহরটাতে বড় হয়েছি খুব আনন্দে। ছোটবেলা থেকেই যে অঙ্ক নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল তা কিন্তু নয়; সব বিষয় সম্পর্কেই সমানভাবে জানতে চেষ্টা করেছি আমি। প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন বেশি আগ্রহ ছিল এনসাইক্লোপিডিয়া নিয়ে। কত বিষয়ই না থাকত সেখানে। সব মিলিয়ে অসাধারণ দিন কেটেছে আমার। বাইরের পরিবেশে যা দেখতাম, সবকিছু আমার এনসাইক্লোপিডিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম। পরিবারের উৎসাহটাও ছিল।
২০১০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিই আমি। সে বছর ডিসেম্বরে আমাদের চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের গণিতের শিক্ষক ইউনুস স্যার কয়েকজন িশক্ষার্থীর সঙ্গে আমাকেও ডেকে পাঠান। ভেবেছিলাম বিজয় দিবস উপলক্ষে হয়তো কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ডেকেছেনি। স্কুলে যাওয়ার পর সবাইকে একটা কক্ষে বসতে দেন তিনি। তারপর কিছু অঙ্ক করতে দেন। আমি দেখলাম এগুলো ক্লাসের অঙ্ক নয়। তবে বেশ মজার। বেশ সহজেই সেগুলো সমাধান করতে পারছিলাম। পরে স্যার জানালেন, গণিত উৎসবের অঙ্ক এগুলো। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আমাদের ডেকে এ ধরনের সমস্যা সমাধানের অনুশীলন করাতেন স্যার। আমিও বাসায় গিয়ে ইন্টারনেট থেকে এসব প্রশ্ন দেখতাম, চেষ্টা করতাম সমাধানের।
পরের বছর খুব কাজে আসে এই অনুশীলনগুলো। জাতীয় গণিত উৎসবে প্রাইমারি ক্যাটেগরির ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ হই আমি। সেবারই প্রথম প্রাইমারি ক্যাটেগরির সেরাদের নিয়ে ক্যাম্পের আয়োজন করা হয় ঢাকায়। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
আমি যে সারা দিন অঙ্কই করতাম, তা নয়। দেশ-বিদেশের নানা রকম ফিকশনও পড়তাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সদস্য ছিলাম। তিনটি করে বই বাসায় আনা যেত প্রতি সপ্তাহে। সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই পড়ে ফেলতাম সেগুলো।
২০১৩ সালে আবার জাতীয় পর্যায়ে বেশ ভালো করি আমি। প্রথমবারের মতো জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পাই সেবার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে গণিত অলিম্পিয়াড হয় বা গণিত নিয়ে যে সারা বিশ্বে এত মজার কিছু হচ্ছে, সেটা জানতাম না তখন। ক্যাম্পের শিক্ষক এবং আগের ব্যাচের ভাইয়াদের সঙ্গে কথা হয় আমার। তাঁদের মাধ্যমে জেনেছি এই আয়োজনগুলোর কথা। ওই ক্যাম্পে গণিত অলিম্পিয়াডের ভাইয়াদের সাথে পরিচয়ের পরই আমি একটু একটু করে গণিতে আগ্রহী হয়ে উঠি।
তখনো তেমন গুরুত্ব দিয়ে গণিত শুরু করিনি। ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু বইয়ের কথা বলা হয়েছিল। ওই বইগুলো থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতাম আমি। মনে আছে, জাতীয় উৎসবের ২–৩ মাস আগে হয়তো শুরু করতাম অনুশীলন। কারণ গণিত করেছি আনন্দ নিয়ে। আমি চাইনি অন্যদের মতো আমার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করুক বিষয়টা।
২০১৬ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর প্রস্তুতি শুরু করি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য। কলেজে উঠে বিভিন্ন জাতীয় বিতর্ক উৎসবে অংশ নিয়েছি। ছোটবেলায় শিখেছি আবৃত্তিও। তবে গণিতই হয়ে উঠল ভালোবাসা।
তবে পড়াশোনা আর গণিত অনুশীলনের বাইরে অনলাইন কমিউনিটিগুলোতেও সময় দিয়েছি। অনলাইনে একই রকম বিষয় পছন্দ করছে এ রকম নানা রকম কমিউনিটিতে পরিচিত আছে আমার। কাজ করেিছ কয়েকটার মডারেটর হিসেবেও। যেমন, আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডেরও একটা অনলাইন কমিউনিটি আছে। সেখানেও সাধ্যমতো সময় দেওয়ার চেষ্টা করি ভালো লাগার জায়গা থেকেই। হ্যারি পটারের ভক্ত আমি। এখনো হ্যারি পটারের একটি ওয়েব নির্ভর কমিউনিটি চালাই। কিছু গেমিং ফোরামে লেখালেখি করি, কাজ করি মডারেটর হিসেবেও।
অনলাইনের বাইরে কাজ করতে গিয়েও চট্টগ্রাম ম্যাথ সার্কেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার এই কমিউনিটি পরিচালনার দক্ষতাগুলো কাজে এসেছে সেখানে। কমিউনিটিগুলোতে যখন একই ধরনের মানুষ একই বিষয় নিয়ে কাজের চেষ্টা করে, তখন সেখান থেকে ভালো ফল আসবেই। কিশোর আলো চট্টগ্রাম বুক ক্লাবে গিয়েও এই বিষয়টা দেখেছি। সবাই বই পড়তে ভালোবাসে সেখানে। লক্ষ রাখে একে অন্যের প্রতি। তাই কমিউনিটি আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এ বছর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের দলীয় অবস্থান ভালো। এর কারণও কিন্তু আমাদের সংঘবদ্ধ কমিউনিটি। আমাদের কোচ, ক্যাম্প ইন্সট্রাক্টর থেকে শুরু করে দলের সবাই একে অন্যকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি সব সময়।
তোমরা যারা এখন থেকেই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করার উদ্দেশ্যে এগোতে চাইছ, তাদের জন্য বলব, আগেই এভাবে না শুরু করতে। তোমার আগ্রহের বিষয়টা খুঁজে বের করো আগে। সেটা জানাও কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আগে আগ্রহের বিষয় খোঁজো। যদি সেটা তুমি ভালো পারো, তাহলে তার পেছনে লেগে থাকো। বাইরের কারও কথা শুনে কাজ করার প্রয়োজন নেই। তুমি নিজে যে কাজটায় তোমার সেরাটা দিতে পারবে লেগে থাকো তার পিছে। সফলতা সহজে হয়তো আসবে না। খারাপ করবে বারবার। অনেকে নানা কথা বলবে। কিন্তু নিজের কাজের পেছনে সময় দাও। চেষ্টা চালিয়ে গেলে সফল তুমি হবেই।
আমি যখন ২০১৬ সালে রৌপ্য আর ২০১৭ তে এক পয়েন্টের জন্য স্বর্ণ পদক পেলাম না, হতাশ হইনি। কারণ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম।। জানতাম, যে কাজটা ভালোবাসি, লেগে থাকলে অবশ্যই সফল হব একদিন।
আর একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে। ক্লাসের নম্বরের চেয়ে বাইরের কাজে তুমি কতটা চৌকস, সেটাই বেশি দেখা হয় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তবে সে জন্য পরিবারের অনুমতি নেবে। বোঝাবে তাদের। তাদের সঙ্গে জোর করে কিছু করতে যাবে না।  
সবশেষে বলতে পারি, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড কিন্তু শুধু গণিত নিয়ে আয়োজন তা নয়। গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী একসঙ্গে হই আমরা। সুযোগ হয় বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেশার। এগুলো কিন্তু আরও বড় কিছু নিয়ে ভাবতে শেখাবে তোমাকে। তাই তোমার সেরাটা নিয়ে প্রস্তুত হও। তোমার ভালো লাগার কাজই সেরাদের তালিকার শীর্ষে পৌঁছে দেবে তোমাকে।


অনুলিখন: আলিমুজ্জামান