গগন চৌধুরীর অপমৃত্যু

অলোকেশ রয় ডিটেকটিভ, প্রাইভেট গোয়েন্দা যাকে বলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পেশায় পসার বেড়েছে তাঁর, বেড়েছে শত্রুও। নিজের নিরাপত্তার জন্য হলেও একটা পিস্তল বা রিভলবার এবার জোগাড় করতেই হয়, ভাবলেন অলোকেশ। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স তাঁর আছে, কিন্তু নতুন মেশিন কিনতে গেলে মেলা টাকার ধাক্কা। তাই পত্রিকার পাতায় পুেরানো পিস্তলের বিজ্ঞাপন খুঁজছেন অলোকেশ। মুফতে যদি জুতসই কিছু পাওয়া যায়।
বরাত তাঁর ভালোই বলতে হয়, আগ্নেয়াস্ত্রের খোঁজ পেয়ে গেলেন তিনি। পত্রিকার পাতার নিচে একেবারে কোণের দিকে ছোট্ট বিজ্ঞাপন। তাতে লেখা, ‘পিস্তল বিক্রি হইবে। পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবার সেমি–অটোমেটিক পিস্তল, মেড বাই স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, ইন গুড কন্ডিশন। সুলভ মূল্যে পাওয়া যাইবে।’ যোগাযোগের নম্বর দেওয়া আছে সঙ্গে, আগ্রহী ক্রেতারা যাতে সরাসরি পিস্তলের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বিক্রেতার নাম গগন চৌধুরী।
খবরটা দেখামাত্র পটাপট নম্বর টিপলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। কী জানি, আক্রার বাজারে হয়তো তাঁর আগেই পিস্তল খরিদ করার জন্য গগন চৌধুরীকে ফোন করে বসে আছে কেউ! হ্যাঁ, ওপাশে রিং হচ্ছে। তার মানে খবরটা জাল নয়। মনে মনে খুশিই হন অলোকেশ।
হ্যালো, গগন চৌধুরী বলছেন? আমি অলোকেশ, আপনার পিস্তলটা কিনতে চাই। আমি প্রকৃত ক্রেতা, তাই দামে আটকাবে না। বাড়তি কথা বলে নিজের আগ্রহের জানান দেন অলোকেশ।
কিন্তু ফোনের ওপারে ঘর্ঘরে কণ্ঠে কেউ একজন বললেন, গগন চৌধুরী তো নেই। তিনি কথা বলতে পারবেন না।
নেই মানে! কী হয়েছে? ফোনটা তো তাঁরই। বিস্ময় চাপেন অলোকেশ।
সব ঠিক আছে ভায়া, কিন্তু মিস্টার গগন তো কথা বলতে পারবেন না। কারণ, লাশ কখনো কথা বলে না। দুম করে বলে দিল ওপারের কণ্ঠস্বর। এমনভাবে বলছে যেন জাঁতাকলে ডাল পিষছে কেউ। আরও বলল, আপনি জলদি এবার আসুন তো অলোকেশ। ঠিকানাটা ঝটপট লিখে নিন। আমি ইন্সপেক্টর বোস বলছি। হারাধন বোস।
ও মাই গড! গগন চৌধুরী ডেড! হাউ কাম! কী করে? মিছে সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি পুলিশের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে হাজির অলোকেশ। তিনি যত দেরি করবেন, ইন্সপেক্টর বোস ততই সাসপেক্টের তালিকার ওপরে তুলে দেবেন তাঁর নামখানা।
ইন্দিরা রোডের শেষ সীমানায় বাগানবাড়ি টাইপ একটা দোতলা ভবনের নিচতলায় পড়ে ছিল লাশ। কাঁঠালের গন্ধ পেলে যেমন মাছি ভনভন করে, ঠিক তেমনি লাশের খবর পেয়ে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। এরা সবাই যে তাঁর শুভানুধ্যায়ী বা পূর্বপরিচিত এমন নয়। বরং রবাহুতই বেশি।
কাজটা কী করে হলো মিস্টার বোস? অলোক তাঁর কার্ডখানা ইন্সপেক্টরের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ভ্রু কোঁচকান ইন্সপেক্টর বোস। এই নাম তাঁর অজানা নয়, তবে খুনটুনের ব্যাপারে পুলিশ তার নিজের তরিকায় কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে।
হারাধন বোস কণ্ঠে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, খুন কী করে হলো তার উত্তর তো আপনি দেবেন অলোকেশ রয়। গোয়েন্দাগিরি করেন বলে যে খুন করতে পারবেন না এমন তো নয়!
মানে! আপনি কী বলতে চান মিস্টার বোস? ভিকটিম আই মিন গগন চৌধুরীকে তো আমি চিনিই না। যারপরনাই বিস্মিত ও বিরক্ত হন অলোকেশ। এ ব্যাটা তাকে ফাঁসাতে চাইছে নাকি! আজব ব্যাপার!


খুন করে ধরা খেলে সবাই অমন বলে মিস্টার রয়। আপনি যাকে চেনেন না, জানেন না সেই গগন চৌধুরীকে তাহলে ফোন করলেন কেন! নাকি মোবাইল হাতে নিয়ে বেহুদা টেপাটিপি করা আপনার অভ্যাস! তেরছা হেসে বললেন ইন্সপেক্টর হারাধন বোস।
অলোকেশ ভেবে দেখলেন বোসকে একটু ভড়কে না দিলে সে খেলতেই থাকবে তাঁকে নিয়ে। একটা ফোন করলেন তিনি। খানিক বাদে ফোন এল বোসের কাছে। ফোন করেছেন তাঁর সুপিরিয়র বস। ফোনে আচ্ছামতো ঝাড়লেন বোসকে। ব্যস, অমনি ঠিক হয়ে যান ইন্সপেক্টর বোস, যেন জোঁকের মুখে নুন।
আরে ভাই আগে বলবেন তো ডিআইজি স্যার আপনার আত্মীয়! আমি তো জাস্ট ইয়ার্কি করছিলাম। হে হে গোছের হাসি দেন ইন্সপেক্টর বোস।
কিছু বললেন না অলোক, তিনিও খানাতল্লাশিতে মন দেন বোসের সঙ্গে সঙ্গে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গগন চৌধুরী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, লোহালক্কড়ের ব্যবসা তাঁর। এই বাড়িতে একাই থাকতেন তিনি। যদিও দুবার বিয়ে করেছেন গগন, আপাতত তিনি একা। কারণ বউরা কেউ তাঁর সঙ্গে থাকতে রাজি নয়। বা তিনি নিজেই তাড়িয়ে দিয়েছেন বিবিদের। মেঝেতে পড়ে ছিল লাশটা। তখনো ক্ষতস্থান থেকে রক্ত চোয়াচ্ছে, তার মানে বেশিক্ষণ আগে হয়নি খুনটা। ভোরের দিকে হবে। গুলিটা সম্ভবত পেটের ভেতরেই রয়ে গেছে, পিঠ ফুটো হয়ে বেরোয়নি।
যে পিস্তল তিনি বিক্রি করবেন বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখেন, সেই পিস্তলটি গগন চৌধুরীর হাতে ধরা ছিল। পয়েন্ট থ্রি-টু বোর, স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন কোম্পানির সেমি-অটোমেটিক ফায়ারআর্মস।
অকুস্থলের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর বোস। আপাতচোখে কেসটা সুইসাইড বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য হাতে পিস্তল ধরা থাকলেই যে সুইসাইড কেস তা তো নয়। গুলিটা লেগেছে গগন চৌধুরীর পেটের ঠিক ডান পাশে। বুলেটের ব্যালিস্টিক টেস্ট না করে বলা যাবে না যে গগনের হাতে ধরা পিস্তলের গুলিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
পুরো ঘরখানা তন্নতন্ন করে খুঁজলেন অলোকেশ। কী খুঁজছেন কেবল তিনিই জানেন। লাশের ঠিক উল্টো দিকে যে দরজা, সেখান থেকে কিছু একটা তুলে পকেটে পুরলেন তিনি। মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজির পর হাল ছেড়ে দেন ইন্সপেক্টর বোস। মাথা দুলিয়ে বললেন, কী বুঝছেন ডিটেকটিভ, কেসটা কী? আমার তো সুইসাইড বলেই মনে হয়। কিলিং উইপন গগন চৌধুরীর হাতে ধরা।
উঁহু! সম্ভবত এটা সুইসাইড নয়। বললেন অলোকেশ।
কী করে বুঝলেন?
লাশের পিএম রিপোর্ট আর বুলেটের ব্যালিস্টিক রিপোর্ট পেলে আপনি নিজেই বুঝবেন কেন এ কথা বলছি। হেঁয়ালিমাখা হাসি ছুড়লেন অলোকেশ।
কথা না বাড়িয়ে বাগানের মালি আবুলকে ডাকলেন ইন্সপেক্টর বোস। এই বাড়ির মালি কাম কেয়ারটেকার সে। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করে আবুল। বাজারঘাট আর রান্নাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
‌বলো আবুল, তুমি গুলির শব্দ শুনেছিলে?
‘জি স্যার। আমি তখন বাগানে।’ আবুল মিয়া বলল। ‘ফুটুস একটা শব্দ শুনলাম, কিন্তু আমি গা করি নাই। কারণ ওটা বন্দুকের গুলি বুঝবার পারি নাই।’
অত সকালে তুমি বাগানে কেন! ভ্রু কোঁচকান ইন্সপেক্টর বোস। খুব কাজপাগল দেখছি!
সক্কালেই কাজ করা আমার আদত। তারপর গগনসাব উঠলে তারে চা-পানি দেই। নাশতা বানাই।
হুম, বুঝলাম। ঘাড় নাড়লেন বোস। তুমি কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেখেছ? গুলি ফোটার আগে?
না স্যার, দেখি নাই। তয় একজন রে বাইর হইতে দেখছি। ছুইটা বাইর হইল।
তাকে তুমি েচনো আবুল? ভালো করে ভেবে বলো। ইন্সপেক্টর বোস আদুরে সুরে বললেন। তিনি জানেন, অনেক সময় জোরাজুরির চেয়ে সমঝে কথা বললে সদুত্তর মেলে।
না সাব, চিনি না। তারে তো আমি দেখি নাই। মানে চোপা দেখবার পারি নাই। সে পালাইছিল।
আবুলকে নেহাতই সাদাসিধা বলে মনে হয় ডিটেকটিভ অলোকেশের কাছে। এই লোক মিথ্যা বলবে বলে মনে হয় না। আবুলের কথামতো কেউ একজন গগনের কাছে এসেছিল। কাকভোরে। আবুল তাকে দেখেনি, তবে গুলির শব্দ শুনেছে। গুলিটা কে করেছে তাও জানে না আবুল।
প্রশ্ন এখানে দুটো। গগন চৌধুরীর গায়ে যে গুলিটা লেগেছে, সেটা যদি তাঁর নিজের পিস্তলেরও হয়, তাতেই কি ধরে নেব যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন?
তা নয় তো কী? পিস্তল তাঁর, গুলি তাঁর, ডান হাতে পিস্তল ধরা, তার শ্বাস পড়ছে না। এটা সুইসাইড ছাড়া আর কী হতে পারে! অবাক বিস্ময়ে তাকান ইন্সপেক্টর বোস।
একটু ভাবুন মিস্টার বোস, কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে কোথায় গুলি করে! কানে কিংবা কপালে। যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়। গগন চৌধুরীর ডান হাতে পিস্তল, গুলিও লেগেছে তাঁর পেটের ঠিক ডান পাশে। কী করে সম্ভব?
ইন্সপেক্টর বোস একটু সময় নিয়ে অলোকেশের যুক্তিটা বোঝার চেষ্টা করলেন। আরে তাই তো! ডান হাতে পিস্তল ধরে পেটের ডান দিকে গুলি করাটা কষ্টকর! ব্যস, অমনি অলোকেশের শিষ্য বনে যান ইন্সপেক্টর বোস। আরে ভাই, আপনি তো জিনিয়াস। এই কেসে চরম ঘাপলা আছে। ব্যালিস্টিক রিপোর্ট না আসা অব্দি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না।
আবুলের কথাটাও মনে করিয়ে দেন অলোকেশ। আমি নিশ্চিত, গগনের ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল। তবে তিনি গগনকে মারতে এসেছেন এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি না। আরেকটু ভাবতে হবে।
ভাবুন, আপনি যত খুশি ভাবুন ডিটেকটিভ। ভেবে নতুন কিছু পেলেই আমাকে জানাবেন প্লিজ। লাশ তুলে নিয়ে চলে যান ইন্সপেক্টর বোস। গগনের ঘর থেকে দুটো ডায়েরি তুলে নিয়ে নিজের ডেরায় ফিরলেন অলোকেশ।

****
পরদিন বিকেলে ইন্সপেক্টর বোসের ফোন এল। অলোক ফোন ধরতেই তিনি হড়বড় করে বললেন, বুঝলেন ডিটেকটিভ, এই বোস কখনো ভুল বলে না। ভিকটিম গগন চৌধুরী আত্মহত্যাই করেছেন। তাঁর পেটের ভেতর যে বুলেট পাওয়া গেছে, তা তাঁর হাতে ধরা পিস্তলের সঙ্গে হুবহু একরকম।
কিন্তু ইন্সপেক্টর, এমনও তো হতে পারে কেউ তাকে গুলি করে তারপর পিস্তলটা গগনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে! তর্কের খাতিরে বললেন অলোকেশ। কারণ তিনি জানেন, ততক্ষণে লাশের ‘রিগ্যার মরটিস’ শুরু হয়ে গেছে। তাই চাইলেও কেউ গগনের হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিতে পারে না।
ইন্সপেক্টর বোস ফোনের ওপারে সম্ভবত মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, উঁহু মিস্টার ডিটেকটিভ, তা সম্ভব নয়। কারণ পিস্তলের গায়ে অন্য কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। গুলিটা গগন নিজেই ছুড়েছেন।
হুম। ফোন ছাড়ার আগে ইন্সপেক্টর বোসের কাছ থেকে ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট এনআই খানের নম্বরটা চেয়ে নিলেন অলোকেশ। তিনি জানতেন, এমন কিছুই হবে। অর্থাৎ গগন চৌধুরী নিজেই গুলিটা করেছেন। কিন্তু কাকে! কেনই বা! দুটো উত্তর ঠিক মিলছে না। যে ব্যক্তি টাকার জন্য পিস্তল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়, সে কেন হঠাৎ আত্মহত্যা করতে যাবে! মোটিভ কী! আর মোটিভ থাকলেও সে ডান হাত দিয়ে নিজেরই ডান পেটে গুলিটা করবে কেন!
অলোকেশের সামনে তাঁর সহযোগী টিকটিকি ক্রাইম রিপোর্টার শুভজিত বসে আছে। ইন্সপেক্টর বোস কী বললেন তা জানার জন্য উসখুস করছে সে। পটাপট নম্বর টিপলেন অলোকেশ। ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট এনআই খান। আচ্ছা মিস্টার খান, দয়া করে বলবেন, গগন চৌধুরী নিজের পিস্তল থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ মানে প্রায় ঠেকিয়ে গুলি করল, অথচ গুলিটা পেট ভেদ করে বেরোল না কেন! হোয়াই?
ইয়েস অলোকেশ, ইউ আর রাইট। খটকাটা আমারও লেগেছে। পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জে গুলি করলে গুলি পেটের ভেতরে নয়, বরং ফুটো হয়ে বেরিয়ে আসার কথা। বাট দেয়ার’জ নো পেনিট্রেশন। তাজ্জব বাত!
কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখেন অলোকেশ। দেেখা শুভ, দুটো জিনিস একদম মিলছে না। আমি নিশ্চিত, গগনের ঘরে আরও কেউ ছিল। তবে গুলিটা সে চালায়নি। গগন চৌধুরী আত্মহত্যা করতে চায়নি, কেননা গুলিটা তাহলে সে পেটে নয়, কপালে বা কানের নিচে করত। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে টার্গেট করে গুলি ছুড়লে পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত ওটা। কিন্তু গুলি পাওয়া গেছে তার স্টমাকে। ব্যাটা গুলিখোর নাকি!
অলোকেশের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না শুভ। সে একবার বলছে গগন নিজে গুলি করেনি, আবার বলছে দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও করেনি, গুলি তাহলে কে করল! গগন চৌধুরী মারা গেলেন কী করে! সুইসাইডের মোটিভ বাদ থাক, ডান হাত দিয়ে নিজের ডান পেটে গুলি করা কঠিন। এই কঠিন কাজটা গগন চৌধুরী কীভাবে করলেন বুঝে উঠতে পারেন না অলোকেশ।
ওদিকে ইন্সপেক্টর বোস একে আত্মহত্যা ধরে নিয়ে ইউডি মামলা নথিভুক্ত করার তোড়জোড় শুরু করছেন। অলোকেশ তাতে বাগড়া দিয়ে বলেন, আমাকে দুটো দিন সময় দিন ইন্সপেক্টর বোস। এই কেসে ঘাপলা আছে।
সময় নষ্ট না করে গগনের ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া কাচের চূর্ণ নিয়ে নিউমার্কেট ছোটেন অলোকেশ। দেখে মনে হয় এটা ঘড়ির ডায়াল। গফুর ওয়াচ অ্যান্ড কোং তাঁর পূর্বপরিচিত। মালিককে সেই কাচের টুকরো দেখাতেই হিসিয়ে ওঠেন তিনি। আরে ভাই, এই জিনিস আপনি কই পেলেন! এ তো বহুত দামি জিনিস। সুইচ-মেড হাবলট কোম্পানির ঘড়ি। এ দেশে খুব একটা আদমানি হয় না। খুব শক্ত কাচ। ভাঙল কী করে!
ভাঙাগড়া বাদ দেন, আপনি বলুন যার ঘড়ি সে ডায়াল সারাতে এখানে আসবে তো?
আলবাত আসবে। আসতেই হবে। আমার দোকান ছাড়া এই ঘড়ির পার্টস সে কোত্থাও পাবে না।
ভেরি গুড। আপনি একটা কাজ করবেন ভাই। সেই লোক এলে কিছু একটা বলে তাঁকে আটকাবেন। মে বি হি ইজ অা ক্রিমিনাল।
ঘড়ির কাচ পকেটে পুরে ডেরায় ফিরলেন অলোকেশ। ইন্সপেক্টর বোস বারবার তাগাদা দিচ্ছেন, কিছু হলো? নাকি এখনো আপনি গহিন জঙ্গলে বুনো হাঁস খুঁজে বেড়াচ্ছেন! বোসের কণ্ঠে স্পষ্ট শ্লেষ, কিন্তু অলোক তা গায়ে মাখলেন না। হু! হয়ে এসেছে প্রায়। আরেকটা দিন সময় দিন মিস্টার বোস। কথা দিচ্ছি চমকে দেব আপনাকে।
শুভ আর অলোকেশ মিলে বুলেট খুঁজতে বসে গেলেন। গুগলে সার্চ দিতেই অন্তত হাজার রকম বুলেট ও তার ফায়ারিং প্যাটার্ন উঠে এল ছবিসমেত। হাবলট ঘড়ির ভাঙা কাচ আর দ্বিতীয়জনের উপস্থিতি অলোকেশের মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দিল। ব্যালিস্টিক এক্সপার্টের কথাও তিনি ভোলেননি। তাঁর খটকা, ঠেকিয়ে গুলি করার পরও বুলেট পেট থেকে পিঠ অব্দি ভেদ করল না কেন! রহস্যটা কী!
টানা চার ঘণ্টা সার্চ করার পর উত্তর মিলল রহস্যের। চেঁচিয়ে উঠলেন অলোকেশ—ইউরেকা! ইউরেকা! এই দেখ শুভ, এর নাম ‘রিকোশে বুলেট’। মানে যে বুলেট বুমেরাংয়ের মতো, ট্রিগার টানার পর কাউকে হিট করে আবার নিজের গায়ে এসে লাগে। দ্য বুলেট টার্নস ব্যাক অ্যান্ড হিটস দ্য কিলার!
অমনি ফোনে ইন্সপেক্টর বোসকে ডেকে নেন অলোকেশ। বললেন, জলদি স্পটে চলে আসুন ইন্সপেক্টর বোস। গগন চৌধুরীর বাগানবাড়ি। উত্তেজনায় পপকর্নের মতো ফুটছেন তিনি।
ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট এনআই খানও আছেন সঙ্গে। তাহলে শুনুন—অর্থপূর্ণ গলা খাঁকরে শুরু করেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। গগন চৌধুরী মোটেও আত্মহত্যা করেননি বরং তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে মারতে চেয়েছিলেন, মালি আবুল যাকে সাতসকালে পালাতে দেখেছিল।
ক্লিয়ার করেন, কীভাবে! কে সে?
এর নাম রিকোশে বুলেট। টাকাকড়ি নিয়ে দুজনের মাঝে বাদানুবাদ, হাতাহাতিও হয়ে থাকবে। একপর্যায়ে গগন চৌধুরী নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করেন সেই লোকটিকে। সম্ভবত মামুন মিয়া তার নাম। এই দেখুন, ডায়েরিতে তার নাম লেখা আছে। মামুন মিয়া টাকা পেত গগনের কাছে।
ব্যস, গুলি না হয় করল। তারপর? প্রশ্নবোধক চোখে তাকান ইন্সপেক্টর বোস।
গুলিটা মামুনের গায়ে না লেগে লাগল ওর বাঁ হাতে থাকা ঘড়ির ডায়ালে। দামি সুইস ব্র্যান্ড হাবলট। অনেক শক্ত কাচ। সেই কাচে গুলি লেগে ওটা ‘রিকোশে’ মানে টার্ন ব্যাক করে, তারপর এসে লাগে গগনের পেটে। তাতেই তার মৃত্যু হয়। ফোর্সব্যাক করতে গিয়ে বুলেটের ভেলোসিটি কমে গিয়েছিল। তাই গগনের পেট ভেদ করে বেরোয়নি ওটা। পাকস্থলীতে থেকে গেছে গুলি। অলোকেশ এমনভাবে বললেন, যেন তিনি তখন ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন। তাঁর কথা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন এনআই খান। ভাই, ইউ আর সত্যি জিনিয়াস। এ রকম গুলির কেস আমিও জানতাম না।
তক্ষুনি ফোন বাজে অলোকেশের। নিউমার্কেটের গফুর ওয়াচ থেকে ফোন। সেই লোক নাকি ঘড়ির কাচ বদলাতে এসেছে। সুইসমেড হাবলট ওয়াচ। আটকান, তাকে আটকে রাখুন। ইন্সপেক্টর বোসকে নিয়ে এক্ষুনি আসছি আমরা। বললেন অলোকেশ।
তারপর আর কী! নিউমার্কেটে গিয়ে মামুনকে পাকড়াও করতেই সবকিছু হড়হড় করে উগরে দিল সে। অলোকেশ যা বলছেন তাই সত্যি। একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে মামুন মিয়া। বুলেটের মোচড়ে মারা পড়েছেন গগন চৌধুরী। অর্থাৎ তিনি একই সঙ্গে খুনি ও ভিকটিম।