ফকিরের কেরামতি

এক

গোটা তল্লাটে বিষম উত্তেজনা, অপার কৌতূহল আর বিমূঢ় বিস্ময় ছড়িয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার? না, মিয়াবাড়ির ছোট ছেলে মনিরুজ্জামান মিয়া সাতাশ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর হঠাৎ করে আজ বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর ফেরত আসার মধ্যে নাটকীয়তার প্রচুর উপাদান রয়েছে। সাতাশ বছর বয়সে নিখোঁজ, আরও সাতাশ বছর অন্য কোথাও কাটিয়ে ফেরা, চুয়ান্ন বছরের মনিরকে দেখে বাড়ির লোকজন প্রথমে তাঁকে চিনতে পারল না।

অমন ছেড়ে দেওয়া কাঁচা-পাকা দাড়ি, মেয়েদের মতো লম্বা চুল, গেরুয়া বসন, কবজিতে মোটা মোটা তামার বালা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধে আটকানো পেটমোটা ক্যানভাসের ঝোলা, চর্বিবিহীন হাড্ডিসার কাঠামো, গলায় আর হাতে পাকানো রশির মতো ফুলে থাকা শিরা, রোদে পুড়ে তামাটে গায়ের রং আর তেল-চকচকে কপাল দেখে তাঁকে চিনতে পারার কথাও নয়।

জীবিত আপনজন বলতে এখন ভাই, ভাবি আর তাঁদের একটি মাত্র ছেলে; তাঁরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন বাড়ির ছোট ছেলে মনির মিয়া মারা গেছেন। তাঁর ফিরে আসাটা ওঁদের কাছে খুশির খবর তো নয়ই, বরং তাঁদের স্বার্থের ওপর বিরাট একটা আঘাত।

বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বড় ভাই একাই ভোগ-দখল করছেন। ছোট ভাই ফিরে আসায় এখন ওই সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাবে। এ রকম ক্ষেত্রে অনেকে ফিরে আসা ব্যক্তিকে চিনতে পারলেও ভান করে চিনতে পারছে না। তবে এখানে সে রকম কিছু ঘটছে কি না, এখনই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

‘এখানে কী চান আপনি, বাবা?’ স্কুলশিক্ষক বড় ভাই নুরুজ্জামান মিয়া বললেন। ‘কোনো আওয়াজ না দিয়ে সোজা একেবারে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন...’

‘আমি ফকির হয়েছি গো বড় ভাই! আমি তোমার ছোট ভাই, মনিরুজ্জামান মিয়া...এত দিন পর ফিরে এলাম। কেমন আছো তোমরা সবাই? আমার কলিজার টুকরা কোথায়? আমার রক্ত? শহীদুজ্জামান উত্তম...ওকে দেখছি না যে?’

‘কে? কী নাম বললেন?’

‘আমি মনির, বড় ভাই!’ ফকির হাসছেন। ‘মনিরুজ্জামান মিয়া। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?’

ভ্যাবাচেকা খেয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন নুরু মাস্টার, তাঁর মাথা ভনভন করে ঘুরছে। ‘আপনি নিশ্চয় একটা পাগল, প্রলাপ বকছেন! আমার ছোট ভাই আজ প্রায় ত্রিশ বছর হতে চলল নিখোঁজ হয়েছে...’

‘না, ত্রিশ বছর না, সাতাশ বছর এক মাস সাত দিন। তোমার সেই ভাই-ই আমি ফিরে এলাম আজ।’ ফকিরের মুখে অমলিন হাসি। ‘আপন ভাইকে কাছে টেনে নাও।’

বড় ভাই বোবা হয়ে গেলেন। তবে ভাষা ফিরে পেতেও বেশি সময় নিলেন না। ‘কে না কে, বললেই হলো কাছে টেনে নাও! যান, যান, ভাগেন এখান থেকে...’

‘আসার পথে শুনলাম অনেক বছর হয়ে গেল মা-বাবা মারা গেছে,’ কাতর গলায় বলল ফকির, ‘তুমি কাছে টানবে না তো কে টানবে, বড় ভাই?’

আবার বোবা হয়ে গেলেন নুরু মাস্টার।

‘আমার ছেলে?’ ফকির জিজ্ঞেস করলেন। ‘আমার রক্ত?’

‘না, তা হতে পারে না,’ প্রশ্নটা এড়াতে গিয়ে বড় ভাই নুরুজ্জামানের গলা চড়ে গেল। ‘আমরা মুসলমান, কাজেই আমার যে ভাই নিখোঁজ অবস্থায় মারা গেছে সেও মুসলমান ছিল। কিন্তু আপনাকে তো আমার হিন্দু মনে হচ্ছে। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনার আসল নাম বলেন।’

ফকির বাবাজি অমায়িক হেসে বললেন, ‘নাম আমাকে বেশ কয়েকটাই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো তো সাধন-বোধন-ফকিরি-আশিকি বিষয়ক। এখানে আমি শুধু বাবার দেওয়া নামটাই ব্যবহার করব—মনির, মনিরুজ্জামান মিয়া।’

‘যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিন,’ রেগে উঠছেন বড় ভাই। ‘নাম কী? মতলব কী?’ তাঁর চড়া গলা শুনে ঘরের ভেতর থেকে স্ত্রী সারিকা এবং ছেলে শামসুজ্জামান বেরিয়ে এল বারান্দায়। ‘আমি কিন্তু লোকজন ডাকব, তারপর গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটাব। তখন বাপ বাপ করে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন আপনি হিন্দু...’

শামসু, বয়স পঁচিশ, জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? এখানে এত চেঁচামেচি কিসের?’

‘ও কি উত্তম, আমার রক্ত?’ আকুল প্রত্যাশা নিয়ে শামসুজ্জামানের দিকে তাকালেন ফকির। ‘আয় বাপ, কাছে আয়, তোকে একটু ভালো করে দেখি...’

‘না, ও আমাদের ছেলে,’ নুরুজ্জামানের স্ত্রী সারিকা বললেন। ‘শামসু, শামসুজ্জামান মিয়া।’

‘ও। বাহ্‌, বেশ বড়টি হয়েছে, ভারি সুন্দর দেখতে! হে মাবুদ, ওকে তুমি হায়াত দরাজ কোরো। কিন্তু আমার ছেলেটা? শামসু, তোমার চাচাতো ভাই উত্তম কোথায়? শহীদুজ্জামান? আমার রক্ত? তোমার চেয়ে তো মাত্র এক বছরের ছোট, সেও কি তোমার মতো তালগাছ হয়েছে?’

 ‘উত্তম তো...’ শামসু উত্তর দিতে যাচ্ছিল, বাবা কড়া এক ধমক দিলেন তাকে।

‘এই, তুই একদম চুপ থাক!’

‘তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?’ স্বামীকে তিরস্কার করলেন বাড়ির বউ সারিকা। ‘এটা মাথা ঠান্ডা করে বিবেচনার বিষয় না? উনি দাবি করলেই তো হবে না, প্রমাণ করতে হবে যে তিনি তোমার ভাই...’

‘কী করে মাথা ঠান্ডা রাখি! হঠাৎ এক সন্ন্যাসী এসে বলবেন তিনি মনির...’

‘বড় ভাই, আমি হিন্দু না। সে অর্থে আমি মুসলমানও না। আমি সব ধর্ম মানি, কিন্তু কোনো ধর্মের পক্ষে ক্যানভাস করি না। আমার আসল পরিচয় আমি ফকির। সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়ার খুব লোভ থেকে আজ আমি এই একটা স্তরে পৌঁছেছি। বড় ভাই, আমার আরেকটা পরিচয় আছে। কিছু অলৌকিক কার্য সাধন আমার দ্বারা সম্ভব হয়। আমি কিছু জাদু জানি।’

‘গুল মারছেন, ধাপ্পাবাজি শুরু করেছেন! অসম্ভব, আপনি আমার ভাই হতে পারেন না...’

‘কয়েকটা ঘটনা বলি, তাহলে বিশ্বাস না করে পারবে না যে আমি তোমার ভাই। তোমার বিয়ের ঠিক সাত দিন আগে আমাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি এক জায়গায় গিয়েছিলে। বলো তো কোথায়?’

‘আমার ওসব ছাইপাঁশ মনে নেই।’ বড় ভাইয়ের মুখের ভাব অবশ্য অন্য কথা বলছে। ‘আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, আপনি নকল মনিরুজ্জামান। আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে চিনতেন, এসব আপনি তার মুখ থেকে শুনেছেন, সে মারা যাওয়ার পর এসেছেন আমাদের সম্পত্তি দখল করতে।’

‘দাঁড়াও তোমার ফকিরি ছুটাচ্ছি!’ একছুটে ঘরে ঢুকল শামসু, বেরিয়েও এল সঙ্গে সঙ্গে, হাতে মোটা লাঠি নিয়ে। লাঠিটা ফকিরের মাথার ওপর তুলল।

‘শামসু, থামো!’ বাধা দিলেন তার মা সারিকা।

‘তুমি আমাকে নিয়ে বিয়ের বাজার করতে গিয়েছিলে,’ খল খল করে হেসে উঠে বললেন ফকির বাবাজি। ‘ভাবির জন্য কী কী কিনেছিলে, সব আমি মুখস্থ বলে দিতে পারব। বেনারসির পাড় ছিল নীল, সোনালি ডোরা কাটা। কানের দুল আর নেকলেসে স্যাকরার নাম ছিল না, তার বদলে তোমার নাম খোদাই করানো হয়েছিল—নুরু।’

নুরুজ্জামান কাঠের থাম ধরে ফেললেন, তা না হলে মাথা ঘুরে উঁচু বারান্দা থেকে উঠানে পড়ে যেতেন।

ডুকরে কেঁদে উঠে ঘুরলেন শামসুর মা সারিকা, একছুটে ফিরে গেলেন ঘরের ভেতর। স্বামী-স্ত্রীর এই আচরণ কি বলে দিল ভাই ভাইকে চিনতে পেরেছেন, দেবরকে চিনতে পেরেছেন ভাবি? তাই যদি হয়, তাহলে দেবরের সামনে থেকে পালালেন কেন ভাবি? নাকি সত্য উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো প্রসঙ্গ সামনে চলে এল, যে প্রসঙ্গে এখন তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে?

‘আমার ছেলে উত্তমের কথা তোমরা এড়িয়ে যাচ্ছো, বড় ভাই,’ আশ্চর্য শান্ত ও ঠান্ডা গলায় বললেন মনিরুজ্জামান। ‘আমি হ্যাঁ বা না শুনতে চাই। আমার ছেলে বেঁচে আছে তো?’

ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন সারিকা।

কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই তাঁর স্বামী নুরু কড়া সুরে বললেন, ‘বেগানা পুরুষের সামনে তুমি আবার বেরোলে কী মনে করে, শামসুর মা?’

স্বামীর প্রশ্ন শুনতে পাননি সারিকা, তিনি ফকিরের প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছেন। ‘না, সে নেই! তোমার ছেলে উত্তম নেই।’

‘নেই! নেই মানে?’

‘কেমন বাপ তুমি, একটানা সাতাশ বছর একমাত্র ছেলের একটা খবর পর্যন্ত নাও না!’ বাড়ির বড় বউয়ের গলায় তিরস্কার। ‘তোমার বউ মরল, সেই দুঃখে এক মাস পর বিবাগি হলে তুমি, তার পাঁচ বছর পর তোমার ছেলে উত্তম মেঘনায় ডুবে মরল।’

‘আমার ছেলে ডুবে মরল,’ আকাশের দিকে মুখ করে ফকির মনির যেন কাউকে রিপোর্ট করছেন। ‘আমার ছেলে মেঘনায় ডুবে মরল।’

তারপর উঠান, বারান্দা আর ঘর একদম নীরব হয়ে গেল।

ফকিরের মাথার ওপর তোলা লাঠি আগেই নামিয়ে নিয়েছে শামসু। তার মা সারিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, কী কারণে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। বারান্দায় বসে পড়েছেন নুরু মাস্টার, বজ্রাহত চেহারা নিয়ে একদৃষ্টে ফকিরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

সময় গড়াচ্ছে। প্রথমে নড়ে উঠলেন ফকিরই। সবাই শুধু তাঁর ঠোঁট নড়তে দেখল। ‘ঠিক আছে, তোমরা আমাকে তার কবরটা দেখিয়ে দাও।’

‘কবর? কবরও তো নেই.’ বললেন সারিকা। ‘লাশ পেলে তো। পানির তোড়ে কেউ জানে না কোথায় ভেসে গেছে।’

‘লাশ পানির তোড়ে কেউ জানে না কোথায় ভেসে গেছে,’ আবার আকাশে মুখ তুলে রিপোর্ট করলেন ফকির। কঁুজো দেখাচ্ছে তাঁকে, হঠাৎ করে বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে ঘুরলেন, উঠান ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

‘আবার কোথায় যাও?’ জিজ্ঞেস করলেন নুরু মাস্টার। ভাইকে চিনতে পেরেছেন আগেই, এতক্ষণে কিছুটা দরদও অনুভব করছেন।

‘আসছি,’ বলে গেট খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ফকির মনির।

‘পিছু নিয়ে দেখ কোথায় যায়, কী করে,’ ছেলেকে নির্দেশ দিলেন নুরু মাস্টার।

‘জে,’ বলে ফকির চাচার পিছু নিল শামসু।

বারান্দায় মুখোমুখি হলেন স্বামী-স্ত্রী। দুই জোড়া চোখের মধ্যে নীরবে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, ভয় আর শঙ্কা বিনিময় হলো।

‘মনির গাঁয়ের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে গেল।’

‘ওর ছেলে সত্যি ডুবে মরেছে কি না।’ দেয়াল ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করলেন সারিকা। ‘কীভাবে ডুবল।’

‘কেউ কি কিছু জানে?’ নিজে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিচ্ছেন নুরু মাস্টার। ‘কেউ কিছু জানে না।’

দুই

প্রায় তিন ঘণ্টা পর আবার ফিরলেন মনির ফকির, সঙ্গে রীতিমতো একটা মিছিল। গাঁয়ের কৌতূহলী ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ অনেকেই এসেছেন তাঁর নিরুদ্দেশের রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনতে। হাজারটা প্রশ্ন তাঁদের—কোথায় গেলেন, কী দেখলেন, কী শিখলেন, আগে কেন ফিরলেন না, আবার নিরুদ্দেশ হবেন কি না ইত্যাদি। শান্ত ও বিনয়ী ফকির সবার সঙ্গেই আলাপ করলেন, সংক্ষেপে তাঁদের প্রশ্নের জবাবও দিলেন এবং জানালেন সম্ভব হলে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি তাঁর আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে আসবেন। শুধু আজকের দিনটা তাঁকে ক্ষমা করতে হবে, কারণ আজ তিনি খুব ক্লান্ত।

এবার আর উঠানে থামা নয়, সরাসরি বারান্দায় উঠে পড়লেন তিনি। বড় ভাই আর ভাবিকে কাছে ডেকে তাঁদের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলেন। বললেন, ‘গাঁয়ের বয়স্ক মুরব্বিরাও বলছেন, আপনাদের কথাই ঠিক—আমার উত্তম মেঘনায় ডুবে মারা গেছে।’ আকাশের দিকে তাকালেন। ‘তিনি ওকে ভালো রাখুন, এই আবেদন জানাই। সারিকা ভাবি, আমাকে তোমরা যে ঘরে থাকতে দেবে সেটা দেখিয়ে দাও। কাপড় ছেড়ে গোসল করি, দুই কাপ চা খাই, দুই টান ধোঁয়া গিলি আর তার ফাঁকে ফাঁকে তোমাদের সঙ্গে গল্প করি।’

ফকির এখানে কী কারণে বলা মুশকিল একটা মিথ্যে কথা বললেন। গাঁয়ের বয়স্ক মুরব্বিরা কেউ তাঁকে এ কথা বলেননি যে তাঁরা জানেন উত্তম নদীতে ডুবে মারা গেছে। গ্রামের যেসব বাড়িতে প্রবীণ ব্যক্তি আছেন, সব বাড়িতেই গেছেন তিনি, নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চেয়েছেন তাঁর উত্তম কীভাবে মারা গেছে তা তাঁরা কেউ স্মরণ করতে পারেন কি না। কিন্তু কেউ তাঁরা তাঁর এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। প্রায় সবাই বলেছেন, তাঁদের মনে নেই। কয়েকজন বলেছেন, নুরু মাস্টার যা বলেছে তা-ই বিশ্বাস করেছি, আমরা নিজেরা কিছু দেখিনি।

অথচ ভাই-ভাবিকে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছেন তিনি।

‘আজ তুমি শামসুর ঘরে থাকো,’ দেবরকে বললেন সারিকা। ‘ও আমাদের সঙ্গে দোতলায় ঘুমাবে। কাল তুমি তোমার পছন্দমতো একটা কামরা বেছে নিয়ো।’

‘কাল,’ জনান্তিকে ফিসফিস করলেন ফকির।

বড় ভাই নুরু মাস্টার বললেন, ‘কদিন যাক, বিশ্রাম নাও, তারপর একটা উকিল ডেকে জমিজমা সব ভাগ করা যাবে...’

ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন ফকির। বললেন, ‘যেখানে আমি থাকতেই আসিনি, সেখানকার সম্পত্তি নিয়ে কী করব? ছেলেটার কথা ভেবে মন খুব কাঁদছিল বলে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে চলে এলাম। তাকেই যখন পেলাম না, দু-এক দিন থেকে আবার বেরিয়ে পড়ব। সম্পত্তি, বড় ভাই...আমি তো গোটা মহাবিশ্বকে আমার সম্পত্তি জ্ঞান করি! তোমার এইটুকু আমার কী কাজে লাগবে, বলো?’

স্বামী-স্ত্রী চট করে একবার দৃষ্টি বিনিময় করার সময় গোপনে একটু সন্তুষ্টির হাসি হাসলেন।

‘কিন্তু ওসব তো ভাবের কথা, মনির,’ বললেন সারিকা। ‘ভবের কথা কও দেখি, দেওরজি! আমি চাই তুমি আবার বিয়ে করো, সংসারী হও...’

হে হে করে হেসে ফেলল ফকির। ‘দেওরজি? ও, বুঝেছি, তার মানে খুব হিন্দি সিরিয়াল দেখা হয়। কিন্তু গ্রামে কি বিদ্যুৎ এসেছে?’

‘না। ব্যাটারিতে কাজ চলছে। তুমি যে আমার কথার উত্তর দিলে না?’ চাপ দিলেন সারিকা।

ফকির জবাব দিলেন, ‘আমি যে বিশ্বসংসার চষে বেড়ানোর  দায়িত্ব পেয়েছি ভাবি, সংসার করা তো আমার সাজে না। তুমি এক বদনা পানি দাও, আমি কাপড় ছেড়ে আসি,’ বলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন।

সন্ধ্যার পর মেঘ করল আকাশে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জলা আর ফাঁকা মাঠের ধারে বাড়ি, ঝোড়ো হাওয়া বাড়িটাকে যেন উড়িয়ে নিতে চাইছে। বিকেলে প্রচুর পিঠা খাওয়া হয়েছে, রাতে তাই আজ একটু দেরি করে খেতে বসা হবে। বাড়ির নিচতলা, বৈঠকখানায় বসে গল্প করছে পুরো পরিবার।

সকালের দিকে বাড়ির পরিবেশে যে আড়ষ্ট ভাব ছিল তা এখন আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই, ফকিরি বেশে ফিরে আসা মনিরুজ্জামান মিয়াকে অকুণ্ঠচিত্তে আপনজন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনিও শান্ত, বিনয়ী ভাব বজায় রেখে ভাই-ভাবি-ভাইপোর সঙ্গে নির্দ্বিধায় মিশতে পারছেন। তবে দুই পক্ষই শহীদুজ্জামান উত্তম প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে থাকছে।

‘জানি এই ঝোড়ো রাতে তোমরা আমাকে ছাড়বে না,’ ভাবির দিকে ফিরে বললেন ফকির। ‘সাতাশ বছরের ফিরিস্তি অন্তত কিছুটা না শুনলে কারও চোখে ঘুম আসবে না। কিন্তু বেশি কথা বললে গলা ভেঙে যাবে, তাই আদা আর লবঙ্গ দিয়ে আগুনের মতো এক কাপ চা খাওয়াতে হবে...’

পাশেই রান্নাঘর, খোলা দরজা দিয়ে প্রায় নিভে যাওয়া চুলোর লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। বেতের চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময় মুখ টিপে হাসলেন সারিকা, ‘এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি, ভাই...’

‘এক কাপ আমাকেও,’ নুরু মাস্টার মিনমিন করে বললেন।

সারিকা সবার জন্যই চা বানিয়ে আনলেন।

কাপে চুমুক দিয়ে হাসলেন ফকির। ‘আহ্‌, ভারি সুন্দর চা। অসংখ্য ধন্যবাদ, ভাবি।’

‘সকালে বলছিলি তুই অনেক কটা নাম নিয়েছিস, এর মানে কী রে? একটা মানুষের এত নাম লাগবে কেন?’

‘আমাকে যদি কেউ কোনো নামে ডাকে, আমি আপত্তি করি না। নামগুলো এভাবেই হয়েছে। আমি বছর দশেক আজমির শরিফে ছিলাম, তখন লোকে আমাকে আশিক বলত। আবার যখন আসামে ছিলাম, তখন আমার নাম দেওয়া হয়েছিল মূষিক শাহ্‌।’

‘বাবা তো তোকে কম শাসন করেননি, কিন্তু লেখাপড়াটা তুই শিখলিই না,’ ছোট ভাইকে বিদ্রূপের সুরে অল্প তিরস্কার করছেন নুরু মাস্টার। ‘ওরে বোকা, মূষিক কারও নাম হতে পারে? মূষিক শব্দটার মানে জানিস?’

‘চুয়া।’

‘না। মূষিক মানে ইঁদুর।’

‘চুয়া মানেও তো ইঁদুর।’ ফকির হাসি চেপে রাখতে পারছেন না। ‘তাহলে কে লেখাপড়া শেখেনি?’

বড় ভাই তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টালেন। ‘আসামের কোথায় ছিলি?’

‘ছিলাম গৌহাটির কাছে কামাখ্যা পর্বতে, ঠিক যেখানটায় সীতার অঙ্গ পড়ে ছিল। ওখানে একটা কালীমন্দিরে থাকতাম, আমার সঙ্গে থাকত একটা মুণ্ডু কাটা জিন্দা লাশ...’

‘চাচা,’ ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে শামসু বলল, ‘তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন?’ জানালা-দরজা বন্ধ, তারপরও কবাটের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকছে ঘরে, তাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে হারিকেনের শিখা, দেয়ালে তৈরি হচ্ছে বিদঘুটে আকৃতির সব ছায়া।

হেসে ফেললেন ফকির চাচা। ‘ভয় দেখাচ্ছি তোরা ভয় পেতে চাইছিস বলে। ওখানে ডাকিনি, যোগিনী, পেতনি, শাকচুন্নি ইত্যাদির সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে আমার, বুঝলি। ওগুলো আমাকে কম করেও পঞ্চাশবার মেরে ফেলার জন্য ফাঁদ পেতেছিল, কিন্তু বৈদ্যঠাকুর হরিহর পাঁজরার শিষ্য হওয়ায় এবং তাঁর শেখানো সঠিক মন্ত্র সঠিক সময়ে জপ করতে পারায় প্রতিবার অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি।’

‘বৈদ্যঠাকুর হরিহর পাঁজরা? কে তিনি?’ জানতে চাইলেন নুরু মাস্টার।

‘আমার অসমীয়া গুরু। বৈদ্যঠাকুর হরিহর পাঁজরা একজন তাক লাগানো জাদুকর। মূষিক শাহ তাঁর কাছ থেকেই জাদুবিদ্যা শিখেছে,’ বললেন ফকির।

‘আচ্ছা, মনির ভাই,’ প্রশ্ন করার সময় নড়েচড়ে বসলেন সারিকা, ‘একটা কথা। সারাটা দিনই লক্ষ করছি, তোমার ওই বেঢপ ফুলে থাকা ক্যানভাসের ঝোলাটা তুমি মুহূর্তের জন্যও কাছছাড়া করছ না। এমনকি বাথরুমে গেলেও সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছো। দুপুরে যখন বিছানায় কাত হলে, দেখলাম কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ওটাকে বালিশ বানিয়ে মাথার নিচে রেখেছ। কী ব্যাপার বলো দেখি? কী সাত রাজার ধন আছে ওতে?’

ব্যাগটা পায়ের কাছে রাখা ছিল, সেটা কোলের ওপর তুলে শক্ত করে ধরে থাকলেন ফকির, চেহারায় কৃত্রিম সতর্কতা আর ভয়। তাঁর অভিনয় দেখে হেসে ফেলল সবাই।

‘এই ব্যাগে আছে জাদুর কাঠি, বানরের শিরদাঁড়া, প্যাঁচার মমি করা পা, গোক্ষুরের খোলস, শিয়ালের লেজ, আলাদা একটা বাক্সে আছে পঁচিশটা মাজার শরিফের তাবিজ, পাঁচ পীরের লেখা দোয়া-দরুদ, এ রকম আরও এক শ একটা জিনিস। তবে...না, থাক।’

‘আমি জানি কোন জিনিসটার কথা চেপে যাচ্ছো তুমি,’ বললেন সারিকা। ‘আড়াল থেকে খেয়াল করেছি, ব্যাগ থেকে বারবার বের করে দেখছিলে ওটা তুমি...’

‘থাকবে কেন, বলো না, চাচা, প্লিজ!’ রহস্যের গন্ধ পেয়ে আবদার জানাল শামসু।

ভাইপোর আবদারে সাড়া না দিয়ে বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন ফকির। ‘তুমি যেন কিছু বলতে চাইছ, বড় ভাই?’

‘না, মানে, বলছিলাম কি,’ নুরু মাস্টারের গলায় সামান্য খেদ, ‘মাঝেমধ্যে আমারও ইচ্ছে হয় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি, অন্তত প্রতিবেশী ভারতটা একবার ঘুরে আসি। আমার তো আর কোথাও যাওয়া হলো না রে!’

‘যেখানে আছো সেখানেই থাকো। কারণ, এখানেই ভালো আছো,’ ফকির বললেন, এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছেন, চায়ের খালি কাপ নামিয়ে রাখলেন। ‘কেউ যদি কিছু মনে না করো তোমরা, এখন আমাকে একটু শিকড়-বাকড়ের ধোঁয়া গিলতে হবে।’

কেউ কিছু বললেন না।

‘মনির ভাই,’ নিজের দিকে দেবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সারিকা। ‘সত্যি করে বলো তো, কী ওটা? খুলি যে, সেটা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু কিসের খুলি বুঝিনি।’

এই প্রথম ফকিরের মুখের হাসি নিভে গেল, চোখ গরম করে ভাবির দিকে তাকালেন তিনি। ‘লুকিয়ে দেখা তোমার উচিত হয়নি, ভাবি। ওটা বিপজ্জনক জিনিস।’

‘বিপজ্জনক হলে তুমি নিজে ওটা খানিক পরপর নাড়াচাড়া করো কেন?’ পাল্টা রাগ দেখালেন ভাবি।

‘আমার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে,’ বললেন ফকির। ‘ওটাকে আমি ফেলে দিতে চাই, নষ্ট করে ফেলতে চাই, কিন্তু পারছি না...’

‘তার মানে ওটার পেছনে খুব গা-ছমছমে একটা গল্প আছে বলে  মনে হচ্ছে,’ নুরু মাস্টার বললেন। ‘নে, শোনা, আমাদের এমন ভয় পাইয়ে দে সারা রাত যাতে ঘুমাতে না পারি।’

হি হি করে হেসে উঠলেন সারিকা। ‘হ্যাঁ, বলো, আমিও ভয় পেতে চাই। প্রথমে শুরু করো ওটার পরিচয় দিয়ে। কী ওটা?’

‘ওটা কিছু না,’ চোখ বুজে জবাব দিলেন ফকির। ‘এর মধ্যে শোনার কিছু নেই।’

‘খুলি? মানুষের খুলি?’ জানতে চাইল শামসু।

‘মানুষের খুলি না।’ ফকির চোখ খুলছেন না।

‘আমি কি তাহলে ভুল দেখলাম?’ ভ্রু কোঁচকালেন সারিকা। ‘আমি তো মানুষের খুলিই দেখলাম। তবে অনেক ছোট। শিশুর খুলি বলে মনে হচ্ছিল।’

‘বানরের খুলি,’ বললেন ফকির, এখনো চোখ বুজে আছেন। ‘ধরো ওটা একটা জাদু।’

তিনজন শ্রোতা বিপুল আগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকল। ফকির মহোদয় অন্যমনস্ক, পিরিচ থেকে খালি কাপটা তুলে চুমুক দিলেন, নিজের ভুল বুঝতে পেরে নামিয়ে রাখলেন আবার।

সঙ্গে সঙ্গে কেটলির দিকে হাত বাড়ালেন সারিকা, দেবরের কাপ কানায় কানায় ভরে দিলেন।

‘দেখতে ওটা,’ ফকির বললেন, ক্যানভাসের ঝোলায় হাত ভরে হাতড়াচ্ছেন, ‘সাধারণ একটা বাঁদরের খুলি যেমন হওয়ার কথা তেমনি, শুকনো খটখটে, ভেতরটা ফাঁপা, চোখ-নাক-কানের কাছে গর্ত।’

ঝোলা থেকে জিনিসটা বের করে ভাবির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। ভাবি সারিকা ভয় পেয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেলেন, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিন্তু শামসু হাতে নিল সেটা, নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করছে, দুই চোখে রাজ্যের কৌতূহল।

‘এটার বৈশিষ্ট্য কী শুনি?’ জিজ্ঞেস করলেন নুরু মাস্টার, ছেলের হাত থেকে খুলিটা নিলেন, পরীক্ষা করার পর নামিয়ে রাখলেন নিচু টেবিলে।

‘আমার অসমীয়া গুরু বৈদ্যঠাকুর হরিহর পাঁজরা মারা যাওয়ার সময় তাঁর প্রিয় শিষ্য হিসেবে আমাকে দিয়ে গেছেন এটা,’ বললেন ফকির। ‘অসম্ভব কামিল ছিলেন, ওখানকার সন্ন্যাসীদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র আর ক্ষমতাবান গণ্য করা হতো। আমি তাঁকে অনেক অলৌকিক কাজ করতে দেখেছি। এই খুলির মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন নিয়তিই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এবং যারা নিয়তির কাজে নাক গলায়, নিয়তি তাদের জন্য দুঃখ বয়ে আনে। আমার গুরু গোপন মন্ত্র পড়ে এই খুলিতে ফুঁ দিয়েছেন, ফলে যে কেউ এটার কাছ থেকে এক এক করে তিনটে জিনিস চাইলে পাবে।’

ফকিরের বলার ভঙ্গিতে অন্ধ ভক্তি এতটাই সংক্রামক, তাঁর ধরন এতটাই বিশ্বাসযোগ্য, শ্রোতারা সচেতন না হয়ে পারলেন না যে ওঁদের হাসি বেসুরো হয়ে গেল।

‘তাহলে, চাচা, তুমি কেন নিজের জন্য তিনটে জিনিস চেয়ে নাওনি?’ চালাকি করে জানতে চাইল শামসু।

ওর ফকির চাচা এমনভাবে তাকালেন, ইঁচড়ে পাকা ছোকরাদের দিকে বিরক্ত চাচারা এভাবেই তাকান। ‘আমি চেয়েছি,’ শান্ত সুরে বললেন, দাগ আর খুদে গর্তে ভরা মুখ সাদা হয়ে গেল।

‘চেয়েছ? তিনটে জিনিস চেয়ে তুমি পেয়েছ?’ জানতে চাইলেন সারিকা।

‘আমি চেয়ে পেয়েছি,’ বললেন মূষিক শাহ্‌, অসমীয়া গুরু বৈদ্যঠাকুর হরিহর পাঁজরার প্রিয় শিষ্য। তাঁর দাঁতের সঙ্গে ঠক ঠক করে দু-তিনবার বাড়ি খেলো চিনামাটির কাপ।

‘মনির, তুমি ছাড়া আর কেউ চেয়েছে? চেয়ে পেয়েছে?’ সারিকা উত্তেজিত।

‘প্রথম যে লোক এটা ব্যবহার করে সে তিনবারই চেয়েছিল। হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন ফকির। ‘তার প্রথম দুটো চাওয়া কি ছিল আমি জানি না, কিন্তু তৃতীয়টা ছিল মৃত্যু। এভাবেই এটা আমি পাই। আমার গুরু জিনিসটা আমার হাতে তুলে দেওয়ার আগে বলেছিলেন, “আমি চলে যাচ্ছি, তু্ই এটা নিজের কাছে রেখে দে। তবে সাবধান কিন্তু, কেমন? এর ক্ষমতা সম্পর্কে জানিসই তো!” সেই থেকে এটা আমার কাছে আছে, আজ পাঁচ বছর হতে চলল।’

‘সেই থেকে এটা তুমি কাউকে ব্যবহার করতে দাওনি?’

‘না।’

মূষিক শাহ্‌ এতটাই গম্ভীর হয়ে উঠলেন যে কারও মুখে আর কথা জোগাল না। কামরার ভেতর নীরবতা অটুট। একসময় সেটা ভাঙলেন নুরু মাস্টার।

‘তুই যদি তিন চাওয়া চেয়ে ফেলে থাকিস, ওটা আর তোর কোনো কাজে লাগবে না, মনির। তাহলে রেখে দিয়েছিস কেন?’

মাথা নাড়লেন ছোট ভাই। ‘মনে হয় শখ করে,’ থেমে থেমে বললেন। ‘ভেবেছিলাম বেঁচে দেব। কিন্তু তা বোধ হয় দেব না। এটা ইতিমধ্যে আমার অনেক ক্ষতি করেছে। তা ছাড়া, মানুষ কিনবেও না। তারা মনে করবে এটা রূপকথা, কিংবা ভুয়া জিনিস, লোক ঠকানোর কৌশল। আর যারা এটার ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা বিশ্বাস করবে, তারা বলবে আগে ব্যবহার করে দেখি, কাজ হলে পেমেন্ট করা যাবে।’

‘তোর যদি আরও এক দফা চাওয়ার অপশন থাকত,’ জানতে চাইলেন নুরু মাস্টার, তাঁর চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ‘তুই চাইতি?’

‘আমি জানি না,’ জবাব দিলেন ফকির ভাই। ‘সত্যি আমি জানি না।’ খুলিটা হাতে নিলেন তিনি, ওটার ওজন অনুভব করলেন, তারপর হঠাৎ রান্নাঘরে লাল হয়ে থাকা মাটির চুলো লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলেন। একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্য, খুলিটা সোজা উড়ে গিয়ে খালি চুলোর ভেতর পড়ল।

তিন

দেখতে পেয়ে নিজের অজান্তে আঁতকে উঠেছেন নুরু মাস্টার, এক নিমেষও নষ্ট না করে ওটার পিছু নিয়ে ছুটলেন। রান্নাঘরে ঢুকে চুলোর দিকে ঝুঁকলেন, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন উত্তপ্ত ছাইমাখা খুলি।

‘ওটাকে পুড়িয়ে ফেললেই ভালো করবে,’ গম্ভীর মুখে বললেন ফকির ভাই।

‘তোর যদি এটা কাজে না লাগে,’ নুরু মাস্টার বললেন, ‘আমাকে দিয়ে দে।’ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে, আলতো ভঙ্গিতে, পাঞ্জাবির পকেটে ভরে রাখলেন খুলিটা।

‘তা দেব না। স্বেচ্ছায় নিতেও তোমাকে নিষেধ করছি,’ জেদের সুরে বললেন ফকির। ‘আগুনে ফেলে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছি, এখন যদি ওটা তুমি নিতে চাও, সেটা নিজ দায়িত্বে নিতে হবে, পরে কিছু ঘটলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না। সংসারী মানুষ, কেন ঝুঁকি নিতে যাচ্ছো? যাও, চুলোয় ফেলে দাও ওটা, পুড়িয়ে ফেলো।’

নুরু মাস্টার মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে। নতুন অর্জিত সম্পদ পকেট থেকে বের করে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন তিনি। ‘কীভাবে কী করতে হয় বল দেখি,’ জানতে চাইলেন।

‘ডান হাতে ধরবে ওটাকে, খুলির ডান কানের গর্তে ঠোঁট ঠেকিয়ে যা চাওয়ার গলা চড়িয়ে চাইতে হবে,’ বললেন ফকির। ‘কিন্তু পরিণতি সম্পর্কে আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।’

‘এ যেন সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প,’ সারিকা বললেন, চেয়ার ছেড়ে রাতের খাবার গরম করতে রান্নাঘরে ঢুকছেন। ‘হ্যাঁ গো, তোমার মনে হয় না আমার জন্য চার জোড়া হাত চাওয়া দরকার?’

তাঁর স্বামী অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন জিনিসটা আবার বের করলেন পকেট থেকে, সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেওয়ার ভঙ্গিতে তাঁর হাত চেপে ধরলেন ফকির, চেহারায় সন্ত্রস্ত ভাব। বাকি তিনজন তাঁর এই আচরণে গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন।

‘যদি কিছু চাইতেই হয়,’ থমথমে গলায় বললেন ফকির, ‘বুদ্ধি করে অর্থবহ কিছু চাও।’

খুলিটা আবার পকেটে ভরলেন নুরু মাস্টার, টেবিলের চারধারে চেয়ার টেনে আনছেন, ইঙ্গিতে সোফা ছেড়ে টেবিলে বসতে বললেন ভাইকে। খেতে বসার পর ওটার কথা ভুলে গেল সবাই। পরে, মনিরুজ্জামান মিয়ার প্রবাসজীবনের রোমাঞ্চকর দ্বিতীয় পর্বটা শোনা হলো।

রাত গভীর হতে যাচ্ছে, শামসুর ঘরে দেবরকে শুইয়ে দিয়ে স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে দোতলায় উঠে এলেন সারিকা।

‘মনির শেষ দিকে যে গল্পগুলো শোনাল,’ বিছানার কিনারায় বসে বললেন নুরু মাস্টার, ‘একটাও আমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। কোথাও কোনো যুক্তি নেই। বাঁদরের খুলির ব্যাপারটাও তো তাই, গাঁজাখুরি গল্প। যত্তসব! দুই যুগ পার করে উনি অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতে এসেছেন, হুহ্‌।’

‘ওটার বিনিময়ে মনির চাচাকে তুমি কিছু দিয়েছ, বাবা?’ জিজ্ঞেস করল শামসু।

‘খুবই সামান্য, নামকাওয়াস্তে,’ বললেন নুরু মাস্টার, চেহারায় বিব্রত ভাব। ‘ও চায়নি, নিতেই চাইছিল না, আমি জোর করে ওর পকেটে গুঁজে দিয়েছি। ওর সেই একই জেদ—পুড়িয়ে ফেলো, পুড়িয়ে ফেলো!’

‘সেটাই করা উচিত,’ বলল শামসু, আতঙ্কিত হওয়ার ভান করল। ‘আরে, আমরা ধনী, বিখ্যাত আর সুখী পরিবার হতে যাচ্ছি। বাবা, তোমার সম্রাট হতে চাওয়া উচিত, তাহলে আর তোমাকে মায়ের মুখঝামটা সহ্য করতে হবে না।’

ঘরের কিনারা ধরে ছুটতে লাগল সে, হাতপাখা নিয়ে ওর পিছু নিয়েছেন সারিকা।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে খুলিটা বের করলেন নুরু মাস্টার। চোখে সন্দেহ নিয়ে দেখছেন। ‘আসল কথা হলো, কী চাইতে হবে সেটাই আমি জানি না,’ থেমে থেমে বললেন। ‘এখন মনে হচ্ছে যা কিছু দরকার সবই আমার আছে।’

‘তোমার ওপেন হার্ট সার্জারির সময় যে দেনাটা হয়েছে, সেটা শোধ করতে পারলে মাথা থেকে বিরাট বোঝা নেমে যাবে,’ বলল শামসু। ‘তিন লাখ টাকা চাও, তাতেই হবে।’

ওর বাবা, নিজের অন্ধবিশ্বাস অনুভব করে নিজেই লজ্জিত, খুলিটা ডান হাতে একটু উঁচু করে ধরলেন। কৃত্রিম গাম্ভীর্যে থমথম করছে শামসুর মুখ, মায়ের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ের সময় চোখ মটকাল। বিছনার কিনারায় বসে খাটের গায়ে ড্রাম বাজাচ্ছে।

খুলির কানের কাছে ঠোঁট ঠেকিয়ে নুরু মাস্টার বললেন, ‘আমি তিন লাখ টাকা চাইছি।’

অকস্মাৎ ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ধুলোয় প্রায় ঢাকা মান্ধাতা আমলের হারমোনিয়াম, সেটাকে চাপা দিল প্রৌঢ় শিক্ষকের আতঙ্কিত চিৎকার। মা আর বেটা তাঁর দিকে ছুটল।

‘আমার হাতের ভেতর নড়ল ওটা!’ চেঁচাচ্ছেন নুরু মাস্টার, মেঝেতে পড়ে থাকা খুলিটার দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ‘যেই আমি চাইলাম, অমনি ওটা আমার হাত থেকে লাফ দিল!’

‘কিন্তু আমি কোথাও কোনো টাকা দেখছি না,’ শামসু বলল, মেঝে থেকে তুলে টেবিলের ওপর রাখল খুলিটা। ‘বাজি ধরে বলতে পারি, দেখবও না।

‘শুনছ,’ স্বামীকে বললেন সারিকা, চোখে উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। ‘ব্যাপারটা তোমার কল্পনাও হতে পারে।’

মাথা নাড়লেন নুরু মাস্টার। ‘বাদ দাও, ঠিক আছে? আল্লাহ মেহেরবান, কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এটা ঠিক যে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছি।’

বিছানার কিনারায় কিছুক্ষণ বসে থাকলেন তিনজন। বাড়ির বাইরে  বাতাসের হুংকার আগের চেয়ে বেড়েছে। নিচতলার একটা জানালার কবাট কীভাবে যেন খুলে গেছে, দড়াম দড়াম করে বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে। একসময় হারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন সারিকা। দেখাদেখি নুরু মাস্টারও শুলেন।

মায়ের আরেক পাশে বসে আছে শামসু। ‘সকালে ঘুম ভাঙার পর বড় একটা ব্যাগে টাকাটা দেখতে পাবে তোমরা, বিছানার ঠিক মাঝখানে,’ বলল সে। ‘আর অন্যায়ভাবে পাওয়া সেই টাকা যখন তোমরা সরাবে, মুখ তুললেই চোখে পড়বে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ওয়ার্ডরোব মাথায় বসে দেখছে তোমাদের।’

অন্ধকারে একা বসে থাকল সে, টেবিলের ওপর মিটমিট করা হারিকেনের শিখা দেখছে, শিখার চারপাশে বিচিত্র আকৃতির সব মুখ ভেসে বেড়াচ্ছে বলে মনে হলো তার। একটা মুখ এতটাই ভয়ঙ্কর, শামসুর হার্টবিট বেড়ে গেল, অথচ ওটার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। জোর করে একটু হাসল সে, হাত বাড়াল টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিতে, ওই মুখের ওপর পানি ঢালবে। হাতে চলে এল গ্লাস নয়, খুলিটা। শিউরে উঠে ছেড়ে দিল, হাত মুছল লুঙ্গিতে, তারপর শুয়ে পড়ল।

রোদ-ঝলমলে পরদিন সকাল। ঘুম ভাঙার পর কাল রাতে ভয় পাওয়ার কথা ভেবে হেসে উঠল শামসু। কামরার ভেতর একটা নীরস গদ্যময়, কিন্তু শান্তির পরশ লাগা একটা ভাব রয়েছে, কাল রাতে যেটা একদমই অনুভব করা যায়নি। তারপর ওর চোখ পড়ল কুৎসিতদর্শন, শুকনো খটখটে খুলিটার ওপর, অযত্নের সঙ্গে ওয়ার্ডরোবের মাথায়  ফেলে রাখা হয়েছে, দেখে বিশ্বাস হতে চাইছে না ওটার অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে।

‘আমার ধারণা, আজকাল যারা ফকিরি পথ ধরে, তারা সবাই একই রকম হয়,’ বললেন সারিকা। ‘তাদের কথাও যেমন ফলে না, তেমনি তাদের আচরণেরও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।’

‘মা, কী হয়েছে বলো তো?’

‘তোর ফকির চাচা। দুই যুগ পর বাড়ি ফিরেছে। ভোর অন্ধকার থাকতে বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে কে বলবে? কী করে বুঝব আর ফিরবে কি না?’

‘বলো কী! চাচা ফের নিরুদ্দেশ? দূর, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কাছেই কোথাও গেছে, এখনই চলে আসবে।’

‘তোর বাপও কম যায় কিসে! আজকাল বর পাওয়া যায়, অ্যা? যেন ছেলের হাতের মোয়া, “আমি তিন লাখ টাকা চাইছি” বললেই তিন লাখ টাকা চলে আসবে!’

‘মা, তুমি খুব সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছো। ব্যাগভর্তি টাকা ঝুপ করে আকাশ থেকে যখন পড়বে...’

ছেলেকে বাধা দিয়ে নুরু মাস্টার বললেন, ‘মনির বলেছে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিকভাবে ঘটবে যে মনে হবে যেন কাকতালীয় ঘটনা।’

‘যা-ই হোক, আমি কারখানা থেকে না ফেরা পর্যন্ত টাকাটা ভেঙো না, কেমন?’ বলল শামসু। ‘আমার ধারণা, ওটা পেয়ে সাংঘাতিক লোভী হয়ে উঠবে তুমি, তোমার জ্বালায় আমাদের না বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়।’

ছেলের কথা শুনে হেসে উঠলেন সারিকা, তাঁর পিছু নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত গেলেন। জলার পাশ ঘেঁষা রাস্তা ধরে হনহন করে হাঁটছে শামসু, যতক্ষণ দেখা গেল মায়ের কোমল দৃষ্টি অনুসরণ করল তাকে।

বেলা আস্তে আস্তে বাড়ছে। স্বামী বানরের খুলির ওপর বিশ্বাস রাখায় যতই তাঁর সমালোচনা করুন সারিকা, যতবার সদর দরজার কড়া নড়ল ততবার চমকে উঠলেন তিনি, তাড়াহুড়ো করে দেখতে গেলেন কে এসেছে। প্রথমবার গোয়ালা দুধ দিয়ে গেল। দ্বিতীয়বার চৌকিদার এল চাঁদা নিতে।

দুপুরে খেতে বসে সারিকা বললেন, ‘বাড়ি ফিরে আরেক দফা রসাল মন্তব্য করবে তোমার ছেলে।’

‘তা করবে। কিন্তু তোমরা যে যা-ই বলো, ওটা কিন্তু সত্যি সত্যি আমার হাতের ভেতর লাফিয়ে উঠেছিল।’

‘সত্যি কি আর লাফিয়ে উঠেছিল...ওটা তোমার ধারণা,’ সুর নরম করে বললেন স্ত্রী।

‘আমি বলছি লাফিয়ে উঠেছিল।’ নুরু মাস্টার বিরক্ত। ‘ধারণা বলছ কেন? ওটা স্রেফ...কী ব্যাপার, সারিকা?’

সারিকা উত্তর দিলেন না। তিনি জানালা দিয়ে বাড়ির বাইরে তাকিয়ে এক রহস্যময় মানুষের গতিবিধি লক্ষ করছেন। ইতস্তত একটা ভঙ্গিতে বাড়িটার ওপর নজর রাখছেন অচেনা কেউ একজন, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না।

মনের সঙ্গে তিন লাখ টাকার যোগাযোগ থাকায় সারিকা খেয়াল করলেন ভদ্রলোক বেশ দামি কাপড়চোপড় পরে আছেন, তাঁর হাতে কালো একটা ব্রিফকেস, পায়ে জুতো জোড়া একদম নতুনের মতো চকচক করছে। এক এক করে তিনবার গেটের দিকে হেঁটে এলেন তিনি, গেটের সামনে এক মুহূর্ত থামলেন, তারপর আবার সরে গেলেন। চতুর্থবার গেটের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তারপর আকস্মিক সাহস দেখিয়ে খুলে ফেললেন ওটা, ঢুকে পড়লেন উঠানে, সরু পথ ধরে দালানের দিকে এগিয়ে আসছেন।

তাড়াহুড়ো করে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সারিকা। একটু পরই আগন্তুককে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানায় ফিরলেন। ভদ্রলোক আড়ষ্ট হয়ে আছেন। চোরাচোখে সারিকাকে দেখছেন, একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে শুনছেন তাঁর কথা:

‘ঘরদোর এ রকম আগোছাল হয়ে আছে, কোথায় যে বসতে দেব আপনাকে...’ সোফার ওপর থেকে গামছা সরালেন সারিকা। ‘এখানটায় বসুন।’ তারপর একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন ভদ্রলোক কী বলেন শোনার জন্য।

কিন্তু অবাক কাণ্ড, ভদ্রলোক কিছু বলছেন না।

‘আপনি...’ নীরবতা ভেঙে বললেন সারিকা,‘...বসবেন না?’

কথা না বলে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, ভাব দেখে মনে হলো এই মুহূর্তে তিনি যেন এখানে নেই।

‘আপনি কার কাছে এসেছেন?’ এবার নুরু মাস্টার মুখ খুললেন।

এতক্ষণে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে...’ থেমে ট্রাউজারের পকেটে হাত ভরলেন, টিস্যু পেপার বের করে কপাল আর মুখের ঘাম মুছছেন। ‘...আমি শিকদার অ্যান্ড কোম্পানি থেকে আসছি...’

চমকে উঠে স্ত্রীর দিকে তাকালেন নুরু মাস্টার।

সারিকার বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল। ‘কেন, কী ব্যাপার?’ দ্রুত জানাতে চাইলেন, অস্থির হয়ে পড়ছেন। ‘শামসুর কিছু হয়েছে? কী ঘটল? আমার ছেলে ভালো আছে তো?’

স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলেন নুরু মাস্টার। ‘তুমি শান্ত হও। বসো এখানটায়। কল্পনার লাগাম টানো, মাথা ঠান্ডা রাখো।’ ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন। ‘বেশ বুঝতে পারছি আপনি খারাপ কোনো খবর নিয়ে এসেছেন।’ ভদ্রলোকের দিকে কাতর, অনুনয় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ‘বলুন।’

বিড়বিড় করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি দুঃখিত।’

উন্মত্ত আবেগ চেপে রেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কি আহত হয়েছে?’

প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মাথা নুইয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন আগন্তুক, তারপর বললেন, ‘খুব মারাতÄকভাবে আহত হয়েছেন। তবে তিনি কোনো ধরনের ব্যথা অনুভব করছেন না।’

‘আল্লাহ তুমি মেহেরবান! আল্লাহ তোমাকে ধন্যবাদ! আল্লাহ...’

আশ্বস্ত করার অশুভ অর্থটা বোধগম্য হতে শুরু করায় থেমে গেলেন সারিকা এবং ভদ্রলোকের লুকাতে চেষ্টা করা মুখে প্রমাণ খুঁজে পেলেন নিজের ভয় অমূলক নয়। দম আটকালেন, ঘুরে বোবা বনে যাওয়া স্বামীর হাত ধরলেন।

ঘরের ভেতর অনেকক্ষণ কোনো শব্দ নেই।

‘তিনি রোলার মেশিনে আটকা পড়ে যান,’ একসময় নীরবতা ভেঙে ফিসফিস করলেন ভদ্রলোক।

‘মেশিনে আটকা...’ যান্ত্রিক সুরে এটুকু বলে থেমে গেলেন নুরু মাস্টার।

‘হ্যাঁ।’

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন নুরু মাস্টার, দুই হাতে সারিকার একটা হাত ধরে আছেন, চাপ দিচ্ছেন মৃদু —প্রায় চল্লিশ বছর আগে বিয়ের পরপর যেভাবে ধরে থাকতেন।

‘ওই একটাই ছিল আমাদের,’ ভদ্রলোকের দিকে ফিরে বললেন তিনি। ‘এ সহ্য করা বড় কঠিন।’

খুক করে কাশলেন ভদ্রলোক, ধীর পায়ে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ‘কোম্পানি আমাকে পাঠিয়েছে সহানুভূতি জানাতে,’ বললেন তিনি. সরাসরি কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। ‘আপনাদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পূরণ করার ক্ষমতা কারও নেই। আমার অনুরোধ, আমাকে কোম্পানির একজন চাকর হিসেবে দেখবেন, মালিক পক্ষের হুকুম পালন করছি মাত্র।’

স্বামী-স্ত্রী চুপ করে থাকলেন, কেউই ভালো করে শুনছেন না।

‘শিকদার অ্যান্ড কোম্পানি কোনো দায়িত্ব নেবে না,’ নিজের কথা বলে যাচ্ছেন আগন্তুক। ‘তাঁরা কোনো রকম দায় স্বীকার করবেন না, তবে আপনাদের ছেলে কোম্পানিকে যে সার্ভিস দিয়েছে সেটা বিবেচনা করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নির্দিষ্ট একটা অঙ্ক তাঁরা আপনাদের দিতে চেয়েছেন।’

সারিকার হাতটা ছেড়ে দিলেন নুরু মাস্টার, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আতঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে ভদ্রলোককে দেখছেন। তাঁর শুকনো ঠোঁট শব্দটাকে আকৃতি দিল। ‘কত?’

‘তিন লক্ষ টাকা,’ উত্তর পাওয়া গেল।

স্ত্রীর চিৎকার সম্পর্কে বেখেয়াল, প্রবীণ স্কুল মাস্টারের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল, অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে হাতড়াচ্ছেন, তারপর ঢলে পড়লেন মেঝেতে—চেতনাবিহীন একটা স্তূপ।

চার

বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বড়সড় কবরস্থান, গাঁয়ের লোকজন শোকাচ্ছন্ন মা-বাবাকে রিকশা-ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল সেখানে। মর্গে ছিল লাশ, ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর সরাসরি এলাকার কবরস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ছেলেকে মাটিচাপা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর বাবা কারও সঙ্গে কথা বলছেন না, ছায়া আর নীরবতার ভেতর তাঁর দিন কাটছে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে, প্রথমে তারা ব্যাপারটা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেননি এবং বুকে একধরনের প্রত্যাশা নিয়ে ছিলেন যে আরও কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে—এমন কিছু, যেটা তাঁদের এই বোঝা হালকা করে দেবে।

কিন্তু দিন যত পার হচ্ছে, প্রত্যাশা ততই পরিণত হচ্ছে হতাশায়। নুরু মাস্টার আর সারিকা পরস্পরের সঙ্গে কথা প্রায় বলেনই না। সারিকার সারাক্ষণ শুধু কাঁদেন। নুরু মাস্টার মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন।

এক সপ্তাহ পর সারিকা স্বামীকে বললেন, ‘তোমার ভাই তাহলে এই কাজটা করতেই এসেছিল?’

‘মানে? কোন কাজটা?’ নুরু মাস্টার বিস্মিত।

‘তা না হলে, না বলে চলে গেল কেন?’

‘আহা, কোন কাজটার কথা বলছ তুমি?’

‘তুমি না জানার ভান করছ। কোন কাজটা আবার, প্রতিশোধ নেওয়ার কাজটা।’

‘প্রতিশোধ...কিসের প্রতিশোধ?’

‘ওর ছেলে উত্তমকে আমরা ডুবিয়ে মারিনি?’

‘না! কক্ষনো না!’ প্রচণ্ড প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন নুরু মাস্টার। ‘উত্তম স্রোতের মুখে পড়েছিল, পানির প্রচণ্ড তোড় তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে...’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, কিন্তু তুমি নিজে আমাকে বলেছ ওই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে তুমি হয়তো ওকে বাঁচাতে পারতে।’

‘সেটা আমার ধারণা ছিল, সত্যি নাও হতে পারত। ওকে বাঁচাতে চেষ্টা করলে আমি নিজেও হয়তো মারা যেতাম।’

‘উত্তমের জায়গায় শামসু হলে কী করতে তুমি?’

নুরু মাস্টার চুপ করে থাকলেন।

তিনি দিন পর।

গভীর রাত। অন্ধকার কামরা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিছানার ওপর হাত বুলাচ্ছেন নুরু মাস্টার। স্ত্রীর স্পর্শ না পেয়ে উঠে বসলেন। চাপা কান্নার আওয়াজ ঢুকল কানে।

‘বিছানায় এসো,’ নরম সুরে ডাকলেন তিনি। ‘বেশ শীত পড়েছে, খোলা জানালার সামনে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগবে তোমার।’

‘আমার ছেলে হিম মাটিতে শুয়ে আছে,’ বলে নতুন করে কান্না শুরু করলেন সারিকা।

চোখে ঘুম, আবার শুলেন নুরু মাস্টার, স্ত্রীর ফেরার অপেক্ষায় থাকা হলো না, আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। সেটা ভাঙল সারিকার চিৎকারে।

‘খুলিটা!’ উন্মাদের মতো চেঁচাচ্ছেন তিনি। ‘বানরের খুলিটা!’

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন স্বামী। ‘কোথায়? কোথায় ওটা? কী ঘটল?’

জানালার কাছ থেকে পড়িমরি করে ছুটে এলেন সারিকা। ‘ওটা আমার চাই,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন। ‘ওটা তুমি ফেলে দাওনি তো? কিংবা নষ্ট করে ফেলোনি?’

‘না। নিচে, ভাঁড়ার ঘরে আছে,’ নুরু মাস্টার বললেন। ‘কেন?’

সারিকা একই সঙ্গে কাঁদছেন এবং হাসছেন। ‘চিন্তাটা এইমাত্র মাথায় এল। আরও আগে কেন ভাবিনি? তুমিই বা ভাবোনি কেন?’

‘কী ভাবব?’ জানতে চাইলেন নুরু মাস্টার।

‘বাকি দুটো ইচ্ছে,’ বললেন সারিকা। ‘ওগুলো তো চাওয়া হয়নি। তিনটের মধ্যে আমরা মাত্র একটা চেয়েছি।’

‘একটাই কি যথেষ্ট নয়?’ খেপে উঠে জিজ্ঞেস করলেন নুরু মাস্টার।

‘না।’ সারিকার গলায় বিজয়িনীর উল্লাস। ‘আমরা আরও একটা চাইব। যাও, নিচে থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো ওটা, ওটার কানে মুখ ঠেকিয়ে বলো আমাদের ছেলেকে আবার আমরা জীবিত ফেরত চাই!’

গা থেকে চাদর সরালেন নুরু মাস্টার। ‘হায় খোদা! সারিকা, তুমি পাগল হয়ে গেছ!’

‘নিয়ে এসো!’ সারিকা হাঁপাচ্ছেন। ‘তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো! চাও! আমার ছেলে...ও আমার শামসু রে!’

দেশলাই জ্বেলে মোমবাতি ধরালেন নুরু মাস্টার, শোয়ার ঘরের হারিকেনটা ভুল করে নিচতলায় রেখে আসা হয়েছে। ‘যা বলছি শোনো। বিছানায় ওঠো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, ঘুমানোর চেষ্টা করো। কী পেতে চাইছ নিজেও জানো না।’

‘আমাদের প্রথম চাওয়া পূরণ হয়েছে,’ সারিকা যুক্তি দেখালেন। ‘দ্বিতীয়টা হবে না কেন?’

‘কোইন্সিডেন্স, কাকতালীয়। ঝড়ে বক পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে—শোনোনি?’

‘কথা নয়! নিয়ে এসো যাও, বলো ছেলেকে ফেরত চাই,’ কেঁদে-ককিয়ে একাকার হচ্ছেন সারিকা, একই সঙ্গে প্রবল উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন।

‘তুমি ভেবে দেখছ না,’ স্ত্রীকে বোঝানোর সুরে বললেন নুরু মাস্টার। ‘আজ ১০ দিন হলো মারা গেছে...আর তা ছাড়া সে...সব কথা তোমাকে বলা যাচ্ছে না...শুধু বলি ওকে আমি ওর কাপড় দেখে চিনেছি। তখন যদি দেখতে ভয়ঙ্কর লেগে থাকে, এখন তাহলে ওর কী অবস্থা?’

‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনো!’ বৃদ্ধা মা চিৎকার করছেন,  টেনেহিঁচড়ে স্বামীকে বিছানা থেকে নামিয়ে দরজার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ‘তুমি ভেবেছ যে ছেলেকে মানুষ করেছি, তাকে দেখে আমি ভয় পাব?’

অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নুরু মাস্টার। ভাঁড়ার ঘরে যেখানে রেখেছেন সেখানেই পাওয়া গেল ছোট্ট খুলিটা। চোখের সামনে বীভৎস দৃশ্য ভেসে উঠল—থেঁতলানো মাংস, ভাঙা আর গুঁড়ো হওয়া হাড়ের সঙ্গে পরনের কাপড়, মানুষ বলে চেনার উপায় নেই, এমনকি লাশও বলা যায় না। এই দৃশ্য বাস্তবেও আবার দেখতে হবে?

 শোয়ার ঘরে ফিরে স্ত্রীর মধ্যে আশ্চর্য একটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন—চেহারা সাদা, প্রত্যাশায় ভরা চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভয় পেলেন নুরু মাস্টার।

‘চাও!’ কঠিন সুরে বললেন সারিকা।

‘কাজটা খুব খারাপ আর বোকামি হয়ে যাচ্ছে...’

‘চাও!’ হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলেন সারিকা।

খুলি ধরা হাতটা একটু তুললেন অসহায় স্বামী। ‘আমি চাই আমার ছেলে আবার জীবিত ফিরে আসুক।’

মন্ত্র পড়া খুলি হাত থেকে লাফ দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। কিছুদূর গড়িয়ে থামল, সেটার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসলেন। সারিকা, চোখ দুটো আগুন, হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরালেন।

ঠায় বসে আছেন নুরু মাস্টার, মাঝেমধ্যে চোখ তুলে জানালার ধারে স্থির হয়ে থাকা স্ত্রীর মূর্তির দিকে তাকাচ্ছেন—তিনি অপলক তাকিয়ে আছেন বাইরে। মোমদানিতে নিভে আসছে মোমবাতি, দেয়ালে আর ছাদে কিম্ভূতকিমাকার ছায়া ফেলছে, তারপর একসময় দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল।

বাঁদরের খুলি কাজ না করায় পরম স্বস্তি বোধ করছেন বাড়ির কর্তা, চেয়ার ছেড়ে বিছানায় উঠলেন। এক কি দুই মিনিট পর নিঃশব্দে সারিকাও বিছানায় ফিরলেন, হতাশা এত তীব্র যে কাঁদতেও ভুলে গেছেন।

দেয়ালঘড়ির টিক-টক শুনছেন দুজন। কাঠের সিঁড়িতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো, ল্যান্ডিংয়ে একটা ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। অন্ধকার চেপে বসছে ওঁদের স্নায়ুতে। সাহস সঞ্চয় করে আবার বিছানা থেকে নামলেন নুরু মাস্টার, টেবিল থেকে দেশলাই নিয়ে নিচে যাচ্ছেন মোমবাতি আনতে।

সিঁড়ির তলায় পৌঁছাতেই নিভে গেল কাঠিটা, আরেকটা ধরানোর জন্য থামতে হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে গোপন বা চুপিচুপি ঢংয়ে মৃদু নক হলো সদর দরজায়, তিনি নিচতলায় থাকা সত্ত্বেও কোনো রকমে শুনতে পেলেন।

হাত থেকে আধ খোলা দেশলাই পড়ে গেল, কাঠিগুলো ছড়িয়ে পড়ল প্যাসেজে। স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি, যতক্ষণ না আবার নক হলো ততক্ষণ দম আটকে রাখলেন। তারপর ছুটে সিঁড়ি ভাঙলেন, উঠে পড়লেন নিজেদের শোয়ার ঘরে, ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। তৃতীয় নক গোটা বাড়ি থেকে শোনা গেল।

 ‘কী ওটা?’  চিৎকার দিলেন সারিকা, সটান উঠে বসলেন বিছানায়।

‘ইঁদুর,’ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন নুরু মাস্টার। ‘একটা ইঁদুর। সিঁড়িতে আমাকে পাশ কাটাল।’

আবার নক। এবার আরও জোরে।

‘শামসু! আমার শামসু এসেছে!’

বিছানা ছাড়লেন লাফ দিয়ে, দরজার দিকে ছুটছেন সারিকা। কিন্তু স্বামী তাঁকে খপ করে ধরে ফেললেন, ধরার পর ছাড়ছেন না। ‘কী করতে চাইছ তুমি?’ কর্কশ সুরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমার ছেলে বাড়ি ফিরেছে...ও আমার শামসু!’ পাগলের মতো করছেন সারিকা, স্বামীর সঙ্গে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে ধস্তাধস্তি করছেন। ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে কবরস্থান তিন কিলোমিটার দূরে। তুমি আমাকে ধরে রেখেছ কেন? ছাড়ো, যেতে দাও। আমাকে দরজা খুলতে হবে।’

‘আল্লাহর দোহাই লাগে, ওটাকে ভেতরে ঢুকিয়ো না!’ এই প্রথম চিৎকার করে কথা বলছেন নুরু মাস্টার, তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে।

‘নিজের ছেলেকে ভয় পাচ্ছো তুমি!’ ধস্তাধস্তি করছেন সারিকা। ‘ছাড়ো আমাকে, যেতে দাও। আমি আসছি, শামসু, আমি আসছি।’

আবার নক হলো। আবার। ছেলের জন্য ব্যাকুল বৃদ্ধা মা তাঁর সবটুকু শক্তি ব্যয় করে ছাড়িয়ে নিলেন নিজেকে, কামরা থেকে উন্মাদিনীর মতো ছুটলেন। তাঁর স্বামী ল্যান্ডিং পর্যন্ত পিছু নিলেন, ফিরে আসার জন্য কাকুতি-মিনতি করছেন। স্বামীর কথায় কান না দিয়ে ঝড়ের বেগে সিঁড়ির নিচে পৌঁছে গেলেন সারিকা, প্যাসেজ ধরে দরজার দিকে ছুটলেন।

লোহার চেইন ঝনঝন করে উঠতে শুনলেন নুরু মাস্টার, একদিকের খোপ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে কাঠের ভারী তসলা, তারপর সেটাকে একটু উঁচু করে সরিয়ে এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো চেইনের সঙ্গে। সারিকার রুদ্ধশ্বাস গলা ভেসে এল।

‘ওপরের ছিটকিনি!’ কেঁদে ফেললেন তিনি। ‘তুমি নিচে নামো। আমি ছিটকিনির নাগাল পাচ্ছি না।’

কিন্তু ল্যান্ডিং থেকে আবার কামরায় ফিরে গেছেন নুরু মাস্টার। এই মুহূর্তে খুলির খোঁজে মেঝেতে হাঁটু আর তালু ঠেকিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছেন তিনি। তাঁর এখন একটাই চাওয়া—বাইরের জিনিসটা ভেতরে  ঢোকার আগে খুলিটাকে হাতে পেতে হবে।

এক ঝাঁক গুলিবর্ষণের মতো নক হলো, ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছে। নুরু মাস্টার শুনতে পেলেন ভারী একটা চেয়ার ঘষা খাচ্ছে মেঝেতে, সারিকা ওটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, ওটায় ওপর দাঁড়ালে ছিটকিনির নাগাল পাবেন।

খটাস করে দরজার গায়ে ঠেকল চেয়ার। সারিকা ছিটকিনির নাগাল পেয়ে গেছেন। ধাতব শব্দ তুলে ধীরে ধীরে লম্বা সকেট থেকে থেকে বেরিয়ে আসছে ওটা। ওই একই মুহূর্তে বানরের খুলিটা পেয়ে গেলেন নুরু মাস্টার এবং উন্মত্ত ব্যস্ততার সঙ্গে তিনি তাঁর তৃতীয় এবং শেষ চাওয়াটা চাইলেন।

হঠাৎ করেই বন্ধ হলো নক, তবে বাড়ির ভেতর তখনো তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দড়াম করে দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলেন নুরু মাস্টার। একরাশ ঠান্ডা বাতাস সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে। করুণ, কাতর এবং দীর্ঘ একটা হাহাকার ধ্বনি বেরিয়ে এল স্ত্রীর গলা থেকে, সেটা শুনে ছুটে নিচে নামার সাহস পেলেন তিনি, তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন, সেখান থেকে ছুটে বারান্দায় বেরোলেন, বারান্দা থেকে ঘেরা উঠানে, তারপর গেটের একেবারে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। চারদিকে ভোরের আলো ফুটছে। আসছে নতুন একটা দিন। জলা, জলার ধারের রাস্তা, সব খাঁ খাঁ করছে। শান্ত পরিবেশ। কেউ কোথাও নেই।

বিদেশি গল্প অবলম্বনে

অলংকরণঃ তুলি