গুড্ডুবুড়ার নতুন বোকামি, তারপর...

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

গুড্ডুবুড়ার নাম বুড়া হলেও সে কিন্তু মোটেও বুড়া নয়; বরং সে একটা ছোটখাটো বালক। খুব হালকা-পাতলা একটা ছেলে সে। সে কিছুই খেতে চায় না।

ফলে একদমই বুদ্ধি নেই তার মাথায়।

আর তার মাথাটা বড় হওয়ায় তাকে সবাই ডাকে গুড্ডুবুড়া বলে। আসলে এটাও তার নাম নয়। যা–ই হোক, গুড্ডুবুড়ার বাবা একদিন বাসায় কিনে আনলেন কালো জাম। বললেন, বছরের একটা ফল। এটা খেতেই হবে। গুড্ডুবুড়া, তুমি অবশ্যই এই ফল খাবে। খুব ভালো ফল।

গুড্ডুবুড়া তো খেতেই চায় না। সে ভাবল, না, খাব না।

কিন্তু হঠাৎ বিকেলবেলা তার মনে পড়ল, তাদের পরীক্ষার ফল দেবে এক দিন পর। কাল নানি ফোন করেছিলেন। ফোন করে বলেছেন, গুড্ডুবুড়া, তোমাদের পরীক্ষার ফল দিয়েছে?

না, নানু, দেয়নি।

কবে দেবে।

দুই দিন পর দেওয়ার কথা।
ফল ভালো হবে তো?
তা তো জানি না, নানু।

ফল ভালো করা চাই।

গুড্ডুবুড়া ভাবতে লাগল, বাবা বলেছেন, কালো জাম খুব ভালো ফল। আবার এক দিন পরে পরীক্ষার ফল দেবে। নানু বলেছেন, পরীক্ষার ফল ভালো করা চাই।

ফ্রিজের মধ্যে কালো জামগুলো রাখা আছে। গুড্ডুবুড়া পকেটে করে কালো জাম নিয়ে স্কুলে গেল। পকেটে সেই কালো জাম গলে দাগ লেগে গেল তার প্যান্টটাতে।

স্কুল থেকে বেরিয়ে সে দেখল, স্কুলের গেটে মা দাঁড়িয়ে আছেন।

মা বললেন, ফল দিয়েছে?

জি মা।

কেমন হলো?

খুব ভালো, মা।

দেখি।

গুড্ডুবুড়া পকেট থেকে কালো জাম বের করল। ভর্তা হয়ে গেছে প্রায়।

মা বললেন, গুড্ডুবুড়া, তুমি কী করেছ? প্যান্টটা তো নষ্ট হয়ে গেল।

গুড্ডুবুড়া হেসে বলল, ফল এনেছি, মা। ভালো ফল। বাবা বলেছেন, এই ফল ভালো ফল।

মা কেঁদে ফেললেন।

বাসায় গিয়ে সেই প্যান্ট ধুতে দেওয়া হলো। কিন্তু জামের দাগ আর গেল না। শুনে বাবা বললেন, এই ফল আর ওই ফল এক না। পরীক্ষার ফলের ইংরেজি হলো রেজাল্ট। আর কালো জাম যে ফল, তাকে ইংরেজিতে বলে ফ্রুট।

তুমি বেশি করে খাও গুড্ডু, তাহলে তোমার বুদ্ধি হবে। যাও। কালো জাম খাও।

গুড্ডুবুড়া জানে না, কীভাবে কালো জাম খেতে হয়। সে মাকে গিয়ে বলল, মা, কালো জাম ছিলে দাও।

মা বললেন, এই ফল ছিলে খেতে হয় না। মুখে পুরে খেয়ে ফেলো। সাবধান, ভেতরে কিন্তু বিচি আছে, দেখো, আবার বিচি খেয়ে ফেলো না।

গুড্ডুবুড়া একটা জাম মুখে দিল। একটু একটু করে খাচ্ছে। ভালোই তো লাগছে। যা–ই হোক, ভেতরে একটা বিচি আছে। সেটা সে ফেলে দিল।

আরেকটা বিচি এসে গেল মুখে।

কিন্তু ভুলক্রমে সেই বিচি সে খেয়ে ফেলল।

এখন কী হবে?

সে তার বন্ধু পিয়ালকে ফোন করল। দোস্ত, আমি একটা কালো জামের বিচি খেয়ে ফেলেছি। এখন কী হবে?

পিয়াল বলল, কী আর হবে। তোর পেটে গাছ হবে। সেই গাছটা বড় হবে। তোর মাথা ফুঁড়ে গাছ বের হবে।

শুনে গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল।

মা বললেন, কী হয়েছে গুড্ডুবুড়া, কাঁদছ কেন?

গুড্ডুবুড়া বলল, মা, আমি জামের বিচি খেয়ে ফেলেছি। এখন আমার পেটে গাছ হবে। মাথা ফুঁড়ে গাছ বের হবে।

মা বললেন, কে বলেছে এসব কথা?

পিয়াল বলেছে।

মা বললেন, না, জামের বিচি খেয়ে ফেললে পেটে গাছ হয় না। যাও, বোকার মতো কান্নাকাটি কোরো না।

কিন্তু গুড্ডুবুড়া কাঁদতেই থাকল। তখন তার ডাক্তার মামাকে ডেকে আনা হলো। ডাক্তার মামা একটা অ্যাপ্রোন গায়ে চাপিয়ে স্টেথিস্কোপ দিয়ে গুড্ডুবুড়ার পেট পরীক্ষা করে বললেন, ওর পেট কেটে বিচি বের করতে হবে।

তিনি তাকে শুইয়ে কাঁচি–ছুরি নানা কিছু দিয়ে পেট কাটার ভঙ্গি করলেন।

তারপর একটা জামের বিচি হাতে নিয়ে বললেন, এই যে তোমার পেটের বিচি। আমি বের করে ফেলেছি।

সেই বিচি হাতে নিয়ে তবে গুড্ডুবুড়ার কান্না থামল।

গুড্ডুবুড়ার ভয় তবু যায় না।

কয়েক দিন পরে গুড্ডুবুড়া গেছে তার ফুফুর বাড়ি। তার ফুফুর বাসা ধানমন্ডিতে। ফুফু ফ্রিজ থেকে বের করলেন একটা মিষ্টির প্যাকেট। তারপর বললেন, খুব ভালো মিষ্টি আছে। কালো জাম। নে। গপ করে খেয়ে ফেল।

গুড্ডুবুড়া বলল, ফুফু, আমি কালো জাম খাওয়ার নিয়ম জানি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। এটা ছিলে খেতে হয় না। মুখে পুরে খেতে হয়। কিন্তু সাবধান। বিচিটা যেন পেটে না যায়।

ফুফু বললেন, কালো জামের বিচি আসবে কোত্থেকে।

গুড্ডুবুড়া হেসে বলল, ফুফু, তুমি এত বড় হয়েছ। কিছুই জানো না। গুড্ডুবুড়া একটা কালো জাম মুখে পুরল। ফুফুকে বিচি দেখাতে হবে। সে মুখের মধ্যে বিচি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই বিচি পেল না।

গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল।

ফুফু বললেন, কী হয়েছে?

আমি কালো জামের বিচি আবার খেয়ে ফেলেছি।

আরে বোকা, এই কালো জাম হলো মিষ্টি। আর তুই যার বিচি খেয়েছিলি, সেটা ছিল ফল। সেই ফলে বিচি হয়। এটায় বিচি হয় না।

গুড্ডুবুড়া তবু কাঁদে। আমার পেটে বিচি ঢুকে গেছে। আমার পেটে গাছ হবে। আবার আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমার পেট কেটে বিচি বের করো।

ডাক্তার মামার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হলো গুড্ডুকে।

তারপর বললেন, গুড্ডুবুড়া, তোমার সব ভালো। কিন্তু একটাই সমস্যা। তুমি খেতে চাও না। না খেতে খেতে তোমার ব্রেন গেছে শুকিয়ে। সে জন্য তুমি নানা রকমের বোকামো করছ। তুমি কাল থেকে বেশি করে খাবে। ভাত খাবে, মাছ খাবে, মাংস খাবে, সবজি খাবে, ফল খাবে, মিষ্টি খাবে, দুধ খাবে, দই খাবে, ডিম খাবে, রুটি খাবে। আর প্রচুর খেলবে। তাহলে তোমার বুদ্ধি হবে।

গুড্ডুবুড়া ডাক্তার মামার কথা মন দিয়ে শুনল।

বাসায় এসেই বলল, আমাকে খেতে দাও।

গুড্ডুবুড়া ঠিকভাবে খেতে লাগল। আর সে প্রচুর খেলে। ভালো খাওয়া আর খেলা। গুড্ডুবুড়ার স্বাস্থ্য হতে লাগল সুন্দর। তার মাথার বুদ্ধি গেল খুলে।

এখন সে স্বাস্থ্যবান গুড্ডুবুড়া। এখন সে বুদ্ধিমান গুড্ডুবুড়া।

একদিন তাদের স্কুলে একটা সমস্যা হলো।

হেড স্যারের নাতি এসেছিল নানার কাছে বেড়াতে। হেড স্যারের রুমে সে ছিল। বাথরুমে ঢুকে সে ভেতরের লক লাগিয়ে দিয়েছে। গোল একটা হাতলের ভেতরে টিপ দেওয়ার লক। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু হেড স্যারের কাছে এই বাথরুমের কোনো চাবি নেই।

বাথরুমের ভেতরে বাচ্চাটা কাঁদতে লাগল। হেড স্যার কী করবেন?

তিনি বলতে লাগলেন, এই তপু, কাঁদে না। কাঁদে না।

তপু আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।

তার কান্না শুনে হেড স্যারও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।

তার কান্না দেখে সব স্যার আর ম্যাডাম কাঁদতে লাগলেন।

তখন বাংলার আপা সামিনা বললেন, গুড্ডুবুড়ার তো এখন খুব বুদ্ধি।

ওকে ডাকলে কেমন হয়।

ঠিক ঠিক ঠিক। ডাকো ওকে।

ক্লাস থ্রি থেকে গুড্ডুবুড়াকে ডেকে আনা হলো।

গুড্ডুবুড়া বলল, কী হয়েছে?

বাথরুমে একটা বাচ্চা আটকা পড়েছে। হেড স্যারের নাতি। দেখো না কীভাবে কাঁদছে। ভেতর থেকে ও লক করে দিয়েছে। এখন ওকে বার করব কীভাবে?

ইংরেজির স্যার বললেন, দরজা ভাঙো।

গণিতের ম্যাডাম বললেন, একটা চাবিওয়ালা ডেকে আনো।

গুড্ডুবুড়া বলল, একজনকে পাঠিয়ে দিন চাবিওয়ালা ধরে আনতে। আর আমরা নিজেরাই একটু চেষ্টা করতে পারি। তপুকে বলি, তপু, গোল জিনিসটা ধরে ঘোরাও। তাহলেই লক খুলে যাবে।

হেড স্যার কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ছোট মানুষ, কোনো কথা শুনছে না। শুধু কাঁদছে। বলেই হেড স্যার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন সব স্যার আর ম্যাডাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

গুড্ডু বলল, আচ্ছা আমার সঙ্গে একটু আলিমুদ্দিন মামা আসুন। একটা লম্বা লাঠি হবে? ঝুল ঝাড়ার লাঠি হলেও হবে।

আছে আছে, ঝুল ঝাড়ার লাঠি আছে।

সেটা নিয়ে আলিমুদ্দিন মামা বাথরুমের পেছনে চলে যান। ছোট জানালাটা দিয়ে ভেতরের লকে চাপ দিন ওই লাঠির মাথা দিয়ে। লক খুলে যাবে।

আলিমুদ্দিন মামা স্কুলের পিয়ন। তিনি হাতে একটা ঝুল ঝাড়া লাঠি নিয়ে চলে গেলেন হেড স্যারের রুমের পেছনে। বাথরুমের জানালা দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে লকের বোতামটা টিপ দিলেন।

 দিছি—তিনি চিৎকার করে উঠলেন।

গুড্ডুবুড়া অমনি হাতল ঘোরাল।

বাথরুমের দরজা গেল খুলে।

হেড স্যার দৌড়ে ভেতরে ঢুকে তার নাতিকে কোলে নিয়ে বাইরে এলেন।

আহা বেচারা। কাঁদতে কাঁদতে তার ঠোঁট নীল হয়ে গেছে।

সবাই গুড্ডুবুড়ার বুদ্ধির প্রশংসা করল। সায়েন্সের ম্যাডাম গুড্ডুবুড়াকে কোলে তুলে নিলেন। গুড্ডুবুড়া খুব খুশি।