তিনি ছিলেন ফুটবলের জাদুকর

 তাঁকে নিয়ে অনেক ধরনের গল্পগাথা প্রচলিত ছিল। তিনি নাকি মাঠে পুরো সময় খেলতেন না। মাঠে নেমে হেঁটে বেড়াতেন এদিক-ওদিক। সতীর্থ আর দর্শকদের সঙ্গে খুনসুটি করতেন। পকেটে নিয়ে আসতেন বাদামভাজা। বাদাম চিবোতে চিবোতে ফন্দি আঁটতেন, প্রতিপক্ষকে বুঝতেন। খেলতেন ম্যাচের অবস্থা বুঝে। তিনি যখন খেলতেন, তখন মনে হতো কোনো জাদুকর তাঁর জাদুর কাঠির স্পর্শে বদলে দিচ্ছে সবকিছু, খেলার ভাগ্য। অনন্য ক্রীড়াশৈলী দিয়েই তিনি ঊনবিংশ শতকে এই বাংলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ফুটবলের জাদুকর হিসেবে।

তাঁর আসল নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। তিনি এ দেশের ফুটবলে ‘জাদুকর’ সামাদ হিসেবেই পরিচিত। তিনি ছিলেন পরাধীন বাংলার মানুষের ফুটবল-বীর। জন্ম অবশ্য তাঁর হয়েছিল বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ায়। ১৮৯৫ সালে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। পড়াশোনা একেবারেই মাথায় ঢুকত না তাঁর। সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন মাঠে। কোনোমতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেই সম্পর্কচ্যুতি ঘটিয়েছিলেন বইয়ের সঙ্গে। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তিনি পাকাপাকিভাবে মনোযোগ দেন ফুটবলে। মাঠের সঙ্গেই তিনি গড়ে তোলেন সখ্য—মাঠই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান, সবকিছুই।

সামাদ আসলে কী ধরনের খেলোয়াড় ছিলেন, সেটার প্রমাণ এই প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা যাবে না। তাঁর খেলার কোনো ছবি নেই, ভিডিও-টিডিওর কথা না ভাবাই ভালো। আসলে তিনি যে সময়ের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, সেই সময়টায় অন্তত এই উপমহাদেশে ফুটবল খেলাটা ছিল কেবলই চিত্তবিনোদনের অনুষঙ্গ। পেশাদার ভিত্তি পেতে ফুটবলের তখনো অনেক বাকি। সামাদ সেই সময়ে ছিলেন বাঙালির চোখে এক অনন্য সেলিব্রিটি, বাঙালির গর্ব। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকে, মনেপ্রাণে ছোট হয়ে থাকা এই জাতি সে সময় বুক ফুলিয়ে বলত সামাদের কথা। ব্রিটিশ শাসনকে জবাব দিতে সামাদের মতো ফুটবলারই ছিলেন সে সময় বাঙালির অব্যর্থ অস্ত্র। ইতিহাস বলে, তাঁর গতি ছিল চিতার সমতুল্য। ড্রিবলিং ছিল মনোমুগ্ধকর। পূর্ণিয়ার জুনিয়র একাদশে শুরু করে প্রথমেই মাত করে দেন সবাইকে। খুব অল্প বয়সেই কলকাতার বড় বড় ক্লাবের কোচ-ম্যানেজাররা তাঁর বাড়িতে লাইন ধরেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি ফুটবল খেলতে পাড়ি জমান সে সময়ের সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও খেলাধুলা চর্চার পীঠস্থান কলকাতা মহানগরে।

কলকাতায় গিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান সামাদ। ময়দানে সবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন তাঁর দিকে। অনন্য ক্রীড়াশৈলী, প্রতিপক্ষকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেওয়া তাঁর পাস, ড্রিবলিং, হেড—সবই নজর কাড়ে সবার। সে সময় কলকাতার বড় ক্লাবগুলো নিজেদের মধ্যে কাড়কাড়ি শুরু করে দিয়েছিল সামাদকে নিয়ে। সবাই তাঁকে পেতে চায়। কলকাতার ময়দানে সে সময় দলে সামাদ থাকা মানেই নিশ্চিত সাফল্য। তিনি ছিলেন হালের ভাষায় গোলমেশিন, গেম-মেকার—সবকিছুই। অনায়াসেই ছয়-সাতজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতেন তিনি। গতি দিয়ে তিনি ছিটকে ফেলতেন প্রতিপক্ষকে। তাঁর সুঠাম শারীরিক কাঠামোও তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে চিনিয়েছিল।

কলকাতায় তিনি খেলেছেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ভারতের এই সেরা ক্লাবের হলুদ-লাল জার্সি গায়ে তিনি চারদিকে মুক্তো ছড়িয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে সামাদ ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যোগ দেন কলকাতা মোহামেডানে। নিজের সেরা সময় পার করে আসার পরও মোহামেডানকে তিনি প্রায় একক কৃতিত্বে টানা পাঁচবার কলকাতা সিনিয়র ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন করেন। এ সময় আইএফএ শিল্ডও ঘরে তুলেছিল মোহামেডান।

খুব অল্প দিনের মধ্যেই সুযোগ পেয়ে যান ভারতীয় দলে। অবিভক্ত ভারতের জাতীয় দলের জার্সি তাঁকে যেন নিয়ে যায় আরেক উচ্চতায়। উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর ফুটবলশৈলী ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।

সামাদকে নিয়ে প্রকাশিত ডাকটিকিট
সামাদকে নিয়ে প্রকাশিত ডাকটিকিট

১৯২৬ সালে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব। তিনি সে সময় ভারতের হয়ে বার্মা (মিয়ানমার), সিলোন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা-জাভা-বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়া), মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইংল্যান্ড সফর করেন। চীনের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ভারত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও তাঁর দেওয়া চারটি গোলে ৪-৩ গোলে অবিস্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল। তাঁর খেলা দেখে ওই সময় স্কটিশ এক ফুটবলবোদ্ধার মন্তব্য ছিল, ‘সামাদ ইউরোপে জন্মগ্রহণ করলে সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পেত।’ ওই সময় ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পড়ে কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসা হয়নি বাংলার ফুটবল জাদুকর সামাদের।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন পূর্ব বাংলায়। পার্বতীপুরে বাড়ি কিনে তিনি শুরু করেন ছিমছাম জীবন। তবে ফুটবলের আকর্ষণটা তিনি কখনোই হারিয়ে ফেলেননি। যুক্ত হন সংগঠক হিসেবে। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সম্মানিত করে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে। ১৯৬৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিশ্বকাপ চলছে। গোটা দেশ এখন ভাসছে ফুটবল-আনন্দে। ফুটবলের উচ্ছ্বাস একটি মাসের জন্য বুঁদ করে রেখেছে আমাদের সবাইকে। মেসি, রোনালদোদের ক্রীড়াশৈলী দেখতে দেখতে আমরা কত বিশেষণেই না তাঁদের বিশেষায়িত করছি। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এ জাতি আজ ভুলে গেছে নিজেদের ফুটবল-বীর সামাদকে। এই প্রজন্মের কয়জন আসলে সত্যিকার অর্থে চেনে-জানে সামাদকে! অথচ, এই সামাদই নিজের দুই পায়ের শৈলীতে মাতোয়ারা করেছিলেন পৃথিবীর বহু ভূখণ্ডের ফুটবলবোদ্ধাদের। নিজের দেশকে করেছিলেন গর্বিত। আজ আমরা অন্য দেশের ফুটবল জাদুকরদের খঁুজে বেড়াই, কিন্তু নিজের দেশের ‘জাদুকর’ থেকে যান স্মৃতির আড়ালে।

বাঙালি ফুটবল খেলতে জানে না—এমন বাণী যাদের মুখ থেকে ঠিকরে বেরোয়, তাদের ফুটবল জ্ঞান আর বোধকে অসার প্রমাণ করে ফুটবল জাদুকর সামাদের গল্প। সামাদের কাহিনি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালির ফুটবল ইতিহাস। সামাদের মতো খেলোয়াড়েরা এ দেশের ফুটবলকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে পতনের দায়ভার অবশ্যই আমাদের, যাদের বয়ে চলার কথা ছিল সামাদের উত্তরাধিকার। ওতে আমরা ব্যর্থ বড় বাজেভাবেই। এই প্রজন্মকে সামাদের কথা জানানোর ব্যাপারটি যেন একটু শাপমোচনের চেষ্টাই।