সিঙ্গাপুরির ডালপুরি

শরিফ সিঙ্গাপুরির মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব খেয়াল হয়। সবকিছুর সঙ্গে আমি বা ছোটকাকু যে একমত হই তাও নয়। কিন্তু তারপরও শরিফ সিঙ্গাপুরি নিজের মতো করে অনেক কিছু করে ফেলে। আমাদের পাড়ায় শরিফ সিঙ্গাপুরির নিজের ফ্ল্যাট। কিন্তু তারপরও পুরান ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকার জন্য চলে গেলেন শরিফ সিঙ্গাপুরি।

যে সময় লোকজন পুরান ঢাকা থেকে নতুন ঢাকায় আসছে, সে সময় শরিফ সিঙ্গাপুরি এ রকম বাড়িবদলের কারণ জানতে চাওয়ার কারণেই হয়তো ছোটকাকু বললেন, বিকেলবেলা কোনো কাজ না থাকলে শরিফ সিঙ্গাপুরির নতুন বাসা থেকে ঘুরে আসা যায়।

আমার তো কলেজ বন্ধ। অর্শারও তা-ই। কাজ একটাই—ছোটকাকুর সঙ্গে থাকা। নতুন কোনো রহস্যের খোঁজ করা।

কিন্তু রহস্যের বই পড়া এবং টেলিভিশনে রহস্যের সিরিয়াল দেখা ছাড়া আর কোনো রহস্যেরই খোঁজ পাচ্ছিলাম না। এই অবস্থায় ছোটকাকুর এই কথায় মনে মনে মহা আনন্দিত আমি। বললাম, শরিফ সিঙ্গাপুরিকে ফোনে জানাব?

না, না, না। ফোনে জানানোর দরকার নেই। তাহলে তো আমাদের যাওয়ার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

অর্শাকে নেব?

তোমার ইচ্ছে।

মানে কী? তোমরা দুজন কোথাও যাবে আর আমি যাব না? কোথা থেকে অর্শা আমাদের সামনে এসে উপস্থিত।

ঠিক আছে। তুমিও যাবে।

ছোটকাকুর কথা শুনে অর্শা বলল, আমি যাব বলে শরিফ সিঙ্গাপুরির বাসায় বসে বসে গরম ডালপুরি খেতে পারবে।

সত্যিই তাই।

পুরান ঢাকায় আসা হয় না অনেক দিন, গাড়ির ড্রাইভার বলল, রেললাইনের ওপারে যাবেন?

রেললাইন কোথায় পেলে?

ছোটকাকুর প্রশ্ন।

নবাবপুরে।

নবাবপুরের রেললাইন উঠে গেছে আজ থেকে বিশ বছর আগে। কিন্তু লোকের মুখে এখনো কথাটা রয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, পুরান ঢাকা আর নতুন ঢাকার মাঝখানে রয়েছে এই অদৃশ্য রেললাইন। এখানে রেললাইন নেই। রেলক্রসিং নেই। শুধু মানুষের মুখে সব রয়েছে।

বাসের কন্ডাক্টরও বলছে, নবাবপুর রেলক্রসিং। রিকশাচালকও বলছে নবাবপুর রেলক্রসিং। ছোটকাকু অবশ্য বললেন, আজ সময় নেই। নাহলে একটু গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে গেলে দেখতে পেতে রেলওয়ের সঙ্গে জড়িত অনেক কিছু এখনো রয়ে গেছে।

সেগুলো কী?

লাল ইটের রেলওয়ের হাসপাতাল, টিকিট বিক্রির কাউন্টার। স্টেশনটাও এখানেই ছিল। আমি স্টেশনটার নাম জানি। অর্শা ছোটকাকুর দিকে তাকিয়ে বলল, স্টেশনটার নাম ফুলবাড়িয়া। আর তুমি বগুড়া থেকে প্রথমে এই স্টেশনে এসে নেমেছিলে।

তখন তোমার বাবা থাকত ওয়ারীতে। সেই বাড়িতেই আমি প্রথম গিয়েছিলাম।

শরিফ সিঙ্গাপুরির বাড়ি কি ওয়ারীর কাছে?

না। ঠিকানা তো লেখা রয়েছে ভিক্টোরিয়া পার্ক।

সেখানে নতুন কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে।

ঠিক তাই। আর শরিফ সিঙ্গাপুরি বলেছে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে উঁচু যে বাড়িটা দেখা যাবে, সেটাতেই উনি থাকেন।

এই কথাটা বলার জন্যই কি শরিফ সিঙ্গাপুরির পুরান ঢাকায় আসা?

না। একদম না। পুরান ঢাকায় আমি এসেছি ছোটবেলার একটা কথা মনে করে। রংপুরে আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেই পাড়ায় একটা গির্জা ছিল। প্রতি ঘণ্টায় গির্জার ঘণ্টাটা শুনলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যেত। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর রংপুরের এই গির্জার কথা আমার বহুবার মনে হয়েছে।

এই গির্জার ঘণ্টা শোনার জন্য আপনি পুরান ঢাকায় এসেছেন?

ঠিক তাই। পুরান ঢাকার গির্জার পাশে এই জন্যই ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়েছি। প্রতি ঘণ্টায় ঢং ঢং শব্দ শুনি। আর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে।

শরিফ সিঙ্গাপুরির ফ্ল্যাটে বসে এই নস্টালজিক কথা শুনতে শুনতে মনে হলো এখনো মানুষ গির্জার ঘণ্টা শোনার জন্য এভাবে ঢাকায় মানুষ বেঁচে থাকে, এই তথ্যটাই একটা বড় রহস্য।

আর শরিফ সিঙ্গাপুরির কাছে রহস্যময় হলো ব্যাপারটা যখন অর্শা সত্যি সত্যি গরম ডালপুরি ভেজে এনে টেবিলের ওপর রাখল।

আমার ফ্ল্যাটে গরম ডালপুরি?

অর্শা বলল, আমি কি অন্য ফ্ল্যাট থেকে চুরি করে এনেছি?

তা নয়। তবে মিসেস গোমেজ টের পেলে ঠিকই আমার ফ্ল্যাট থেকে ডালপুরি চুরি করে নিয়ে যাবেন।

মিসেস গোমেজ? তিনি কে?

অর্শার সরল প্রশ্ন।

ঠিক আমার ফ্ল্যাটের নিচে থাকেন। জানালাটা বন্ধ করে দাও।

কেন?

ডালপুরির গন্ধ পেলে ভদ্রমহিলা সত্যি সত্যি এখানে চলে আসবেন।

আমি বাসা থেকে অনেক পুরি নিয়ে এসেছি। মিসেস গোমেজ এলে অসুবিধা নেই।

ভদ্রমহিলার আসার অবস্থা নেই। আমিই বরং দুইটা পুরি মিসেস গোমেজকে দিয়ে আসব।

সে সময় পুরির সঙ্গে আমি একটু কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ আর লেবু দিয়ে দেব।

আচ্ছা আমার ফ্ল্যাটটা কেমন লাগছে তোমাদের? লিফটে এগারো তলা টিপেছ কিন্তু আমার ফ্ল্যাটটা আসলে বারো তলায়। এখান থেকে পুরো ভিক্টোরিয়া পার্কটা দেখা যায়।

এরই মধ্যে মিঁউ মিঁউ শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি ধপধপে সাদা একটা বিড়াল।

ওই যে মিসেস গোমেজের প্রতিনিধি এসে হাজির হয়েছে।

মিসেস গোমেজের প্রতিনিধি মানে?

ওই বিড়ালটা। আদর করে মিসেস গোমেজ ডাকেন মিঁয়াও বলে।

আমি এত মোটা বিড়াল জীবনেও দেখিনি।

অর্শার কথার সঙ্গে সায় দিয়ে আমিও যোগ করলাম, বিড়ালটা মিসেস গোমেজকে ছেড়ে আপনার এখানে গেল। ডালপুরি আর ঘিয়ের গন্ধে?

আমি আর অর্শা একটু বোকার মতো শরিফ সিঙ্গাপুরির দিকে তাকালাম। ডালপুরি আর ঘিয়ের গন্ধে বিড়াল আসবে কেন?

গন্ধ পেয়েছেন মিসেস গোমেজ। তাই পাঠিয়ে দিয়েছেন বিড়ালকে।

এতক্ষণে খেয়াল করলাম, বেড়ালের গলায় একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। শরিফ সিঙ্গাপুরি একটা ডালপুরি হাতে নিয়ে বিড়ালটাকে ইশারা করতেই সোজা সে এসে বলল সোফার পাশে। আর শরিফ সিঙ্গাপুরি দুটো ডালপুরি রেখে দেন বিড়ালের গলার ঝোলার মধ্যে। বিড়ালটিও সঙ্গে সঙ্গে তার মোটা শরীর নিয়ে ভোঁ দৌড়।

মিসেস গোমেজ বিড়ালের গলায় ঝোলানো এই ঝোলার ডালপুরি খাবেন নাকি?

অর্শার প্রশ্ন।

তিন কুলে কেউ নেই ভদ্রমহিলার, রয়েছে শুধু এই বিড়ালটা। আর মাঝেমধ্যে একজন কাজের বুয়া এসে বাসার কাজকর্ম করে দিয়ে যায়।

ভদ্রমহিলা সারা দিন কী করেন?

হুইল চেয়ারে বসে থাকেন।

হুইল চেয়ারে?

হ্যাঁ। একাত্তরের যুদ্ধে ভদ্রমহিলার দুটো পা বোমা হামলায় উড়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে ভদ্রমহিলা হুইল চেয়ারে। পাঁটি ভাষা জানেন ভদ্রমহিলা। আর এসব ভাষায় যত বই রয়েছে দিনের পর দিন শুধু সেগুলো পড়েন।

টেলিভিশন দেখেন?

না। বই পড়েন আর গান শোনেন।

আমি বোধ হয় ভদ্রমহিলার কথা জানি।

অর্শা বলল, সিলেট অঞ্চলের যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। ভদ্রমহিলার বাবার বিশাল একটা লাইব্রেরি ছিল।

ঠিক তাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই লাইব্রেরির অধিকাংশ বই পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে ফেলেছিল।

বারান্দা থেকে আসলেই পুরান ঢাকা দেখতে দারুণ লাগছে। বারো তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাটা আমি বেশ জোরেই বললাম।

আমি ইচ্ছা করেই বারান্দায় গ্রিল রাখিনি। সে জন্যই পুরো এলাকাটা আরও খোলা মনে হচ্ছে। আর আকাশটাও কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে।

অদ্ভুত শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনলাম। নিচে কোনো রিকশা বা গাড়ির টায়ার ফাটল নাকি?

ছোটকাকু বললেন, বারো তলার ওপরে রাস্তার গাড়ির টায়ার ফাটার শব্দ এত জোরে শোনার কথা নয়।

তাহলে এটা কিসের শব্দ?

আমার যদি ভুল না হয়, গুলির! আর গুলির শব্দটা নিচের দিক থেকে এসেছে।

আমাদের এই বিল্ডিংয়ে গুলির শব্দ?

শরিফ সিঙ্গাপুরির কণ্ঠে বিস্ময়।

গুলির শব্দে আপনি এত অবাক হচ্ছেন কেন?

এই বিল্ডিংয়ে সব শান্তিপ্রিয় মানুষ। তা ছাড়া বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটিরও দায়িত্ব পালন করছে বড় একটা কোম্পানি। এই বিল্ডিংয়ে গুলি করবে?

শরিফ সিঙ্গাপুরি বিস্ময়ের সঙ্গে কিছুটা বিব্রত।

ইতিমধ্যে আমরা টের পাচ্ছি বাইরে অনেক গলার আওয়াজ। নানা রকম শব্দ ভেসে আসছে। শরিফ সিঙ্গাপুরির সঙ্গে আমরাও বাইরে বেরিয়ে আসি।

ওপরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন মোটা এক মহিলা। তাকে দেখেই শরিফ সিঙ্গাপুরি বলে উঠলেন।

কী হয়েছে জাহানারা আপা?

মিসেস গোমেজকে নাকি কেউ গুলি করেছে।

কী বলছেন আপনি? সাতকুলে যে মহিলার কেউ নেই, তাঁকে কে গুলি করবে?

বলতে বলতে আমরা সিঁড়ি বেয়ে মিসেস গোমেজের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াই। দরজাটা খোলা। খালি একটা হুইল চেয়ার। মিসেস গোমেজ কোথায়?

ম্যাডামকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বাসার সামনে যে জটলাটা রয়েছে সেখান থেকে উর্দিপরা একজন লোক জবাব দিল।

আমরা দেখলাম দরজার ওপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।

গুলি কোথায় লেগেছে?

হাতে। ভয় পাওয়ার বেশি কারণ নেই।

খুব মোটা গলায় একজন কথাটা বলল। তাকিয়ে দেখলাম, পুলিশের পোশাকে পরা এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ওপরে। বুকের মধ্যে নাম লেখা: মনির।

আমি তো শুনেছিলাম ঘটনা ঘটার পরে গোয়েন্দারা সেখানে উপস্থিত হয়। আর আপনারা দেখছি ঘটনার আগেই এখানে উপস্থিত।

বুঝলাম ইন্সপেক্টর মনির ছোটকাকু এবং আমাদের সবাইকে আগে থেকেই চেনেন। আমি বললাম,

ঘটনার আগে নয়, ওপরের ফ্ল্যাটে আমাদের শরিফ সাহেব থাকেন। গুলির আওয়াজ শুনে আমরা নিচে নেমে এসেছি।

ভালোই হলো। চলুন, একসঙ্গে সবাই মিলে দেখি কী ঘটেছে।

খুবই সাধারণ ফার্নিচার দিয়ে সাজানো একটা ঘর। হুইল চেয়ারটার পাশে ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিল। পাশে একটা সোফা। চেয়ারটার সামনে কিছুক্ষণ আগে শরিফ সিঙ্গাপুরির ঘর থেকে আনা একটা ডালপুরি পড়ে আছে। অবাক কাণ্ড! বিড়ালটা ঠিকই ডালপুরি নিয়ে মিসেস গোমেজের কাছে এসেছিল।

আপনি তো বলেছিলেন, মিসেস গোমেজ হুইল চেয়ার ছাড়া উঠতে পারতেন না।

হ্যাঁ। সারাক্ষণ খোলা দরজার দিকে মুখ করে বসে থাকতেন। ফ্ল্যাটের কেউ যাওয়া-আসা করলে তার সঙ্গে নানা রকম কথা বলতেন।

ছোটকাকুর কথা শুনে জবাব দিলেন শরিফ সিঙ্গাপুরি।

একটু আগে শুনলাম যে ভদ্রমহিলার হাতে গুলি লেগেছিল।

আপনি ঠিকই শুনেছেন। বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন একজন ভদ্রলোক। মুখে চাপদাড়ি। বয়স ষাটের কোঠায়। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা।

ভদ্রলোকের নাম জামাল হোসেন। শরিফ সিঙ্গাপুরি পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনি আমাদের এই বিল্ডিংয়ের সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। সবার সুখ-দুঃখে সবার সঙ্গে রয়েছেন। গুলির শব্দ শুনে আজও তিনি সবার আগে এসেছেন এই ফ্ল্যাটে এবং মিসেস গোমেজকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।

ইন্সপেক্টর মনির তথ্যটা জানাতেই জামাল হোসেন বললেন, এই বিল্ডিংয়ে কোনো ঘটনা ঘটলেই আমি কেমন করে যেন সেখানে উপস্থিত হয়ে যাই। আজও যখন গুলিটা চলল—

ঠিক তখন আপনি এই ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই তো?

আপনি—তুমি কী করে ব্যাপারটা জানলে?

একটু থতমত খেয়ে অর্শার দিকে তাকিয়ে বললেন জামাল হোসেন।

আচ্ছা, মিসেস গোমেজের গুলিটা কোন হাতে লেগেছে?

ছোটকাকুর প্রশ্ন।

বাম হাতে।

কী করে তা সম্ভব?

ছোটকাকু খুব আস্তে করে কথাটা বললেও আমরা সবাই কথাটা শুনতে পেলাম। অর্শা আমার পাশে এসে বলল, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলি?

আমি মাথা নাড়ালাম।

মানে না।

অর্শা ফিসফিস করে বলল, তাকিয়ে দ্যাখ। মিসেস গোমেজ চেয়ারটায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর বাঁ দিকেই আছে ছোট ড্রাইনিং টেবিলটা। সে ক্ষেত্রে কারও পক্ষে হাতে গুলি করা কী করে সম্ভব?

তাই তো।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বাঁ দিকে কোনো মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে গুলিটা কে চালাল? ছোটকাকু ইতিমধ্যেই ইন্সপেক্টর মনিরকে নিয়ে পরীক্ষা করে ফেলেছেন—দেয়ালের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর নেই।

এই সময় দুটো ঘটনা ঘটল একই সঙ্গে। বিল্ডিংয়ের দারোয়ান গোছের একজন লোক মিসেস গোমেজের সাদা বিড়ালটা নিয়ে ঘরে ঢুকল আর একই সময়ে মিসেস গোমেজের ডান দিকের টেবিলের ওপরের দেয়ালে থাকা ঘড়িটায় ছয়টা বাজার সংকেত বেজে উঠল। এ ধরনের ঘড়ি আমি আর অর্শা আগেই দেখেছি। সময় সংকেত দেওয়ার সময় ঘড়ির মধ্যকার একটা দরজা খুলে যায়। আর সেখান থেকে একটা পাখি বের হয়ে আসে। ঘড়ির সময় সংকেত শুনে নাকি পাখিটাকে দেখে বিড়ালটা হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ছুটে যেতে চায় ঘড়ির দিকে।

এটা কেমন কথা? এই ঘড়িটা নিশ্চয়ই প্রতি ঘণ্টায় এই ভাবে বাজে?

হ্যাঁ। মিসেস গোমেজের খুব প্রিয় ঘড়ি এটি। একা বসে থাকতেন তিনি। প্রতি ঘণ্টায় এই ঘড়ির শব্দ শুনে আর পাখিটাকে দেখে নতুন জীবন ফিরে পেতেন তিনি।

আমাকে এই কথা বলেছিলেন গোমেজ, ছোটকাকুর কথার জবাব দিলেন শরিফ সিঙ্গাপুরি।

শুধু শরিফ সাহেবকে নয়, আমি পাঁচ বছর ধরে এই ফ্ল্যাটে আছি। আমাকেও বহুবার এই কথা বলেছেন মিসেস গোমেজ।

আপনারা নিশ্চয়ই মিসেস গোমেজের এই ঘরে এসে গল্প করেছেন অনেকবার।

হ্যাঁ।

শরিফ সিঙ্গাপুরি আর জামাল হোসেন একই সঙ্গে বলে উঠলেন। এই বিড়ালটাকে কখনো এভাবে উত্তেজিত হতে দেখেছেন?

না।

বিড়াল তো একটা শান্ত প্রাণী। এই ঘড়িটাও গত কয়েক বছর এখানে রয়েছে। তাহলে আজ হঠাৎ বিড়ালটা এত উত্তেজিত হয়ে গেল কেন?

আমরা ভাবছি মিসেস গোমেজকে কে গুলি করল, কীভাবে গুলি হলো সেই কথা। আর আপনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন বিড়াল কেন উত্তেজিত হয়েছে সেটা নিয়ে। ইন্সপেক্টর মনির বোধ হয় একটু ঠাট্টা করেই ছোটকাকুকে বললেন।

আমার মনে হয় এই কেসটার সঙ্গে বিড়ালটার উত্তেজিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক রয়েছে।

অর্শা আবার ফিসফিস করে আমাকে কথাটা বলল। ব্যাপারটা আমিও বুঝছি।

আমার মনে হয়, এখানকার সব ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালালে এ রকম আরও একটা ঘড়ি পাওয়া যাবে।

ছোটকাকুর কথা শুনে জামাল হোসেন বললেন, কী বলছেন আপনি? এই বিল্ডিংয়ে সব সম্মানিত মানুষ থাকেন। তাঁদের ঘরে গিয়ে পুলিশ তল্লাশি করবে, তা কি হয়?

দুর্ঘটনা একটা ঘটেছে। সুতরাং পুলিশকে তার দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

ইন্সপেক্টর মনির একটু কঠিন কণ্ঠেই কথাটা বললেন। আচ্ছা জামাল সাহেবের যখন বাড়ি তল্লাশির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে তখন তোমরা একটু আশপাশে খঁুজে দেখো কোনো ক্লু পাও কি না!

ছোটকাকু আমার আর অর্শার দিকে তাকিয়ে বললেন।

আর ইন্সপেক্টার মনির, আপনি আপনার দলবল নিয়ে যা করার করুন। আমরা শরিফ সিঙ্গাপুরির ঘরে ফিরে যাচ্ছি।

ছোটকাকু শরিফ সিঙ্গাপুরিকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি আর অর্শা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখলাম বিল্ডিংয়ে একজন দারোয়ান ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে আসছে।

কী ব্যাপার?

স্যার, এই ঘড়িটা নিচে পেয়েছি।

মিসেস গোমেজের ঘরে পাখির ডাক দেয় যে ঘড়িটা, হুবহু একই ঘড়ি। শুধু মাঝখানে পাখিটা নেই। কেউ পাখিটা খুলে ফেলেছে।

ঘড়িটা নিয়ে আমি ছুটলাম ছোটকাকুর কাছে। ঘড়িটা দেখে ছোটকাকু শরিফ সিঙ্গাপুরিকে বললেন,

এই বিল্ডিংয়ে কারও কাছে পিস্তল রয়েছে?

হ্যাঁ। একজনের কাছে খুউব ছোট্ট একটা রিভলবার রয়েছে।

কার কাছে ছোটকাকু জিজ্ঞেস করলেন না। বরং প্রশ্ন করলেন, জামাল হোসেন সাহেব কোথায় কাজ করতেন?

পাবলিক লাইব্রেরিতে। বইয়ের সঙ্গেই তাঁর কেটেছে সারা জীবন।

আর মিসেস গোমেজের বাবারও সময় কেটেছে বইয়ের সঙ্গে সারা জীবন।

ছোটকাকুর কথা শুনে শরিফ সিঙ্গাপুরি বললেন, বই, মিসেস গোমেজের বাবা, জামাল হোসেন—এই সবকিছুর সঙ্গে গুলির কী সম্পর্ক?

আচ্ছা, আপনি তো অনেকবার মিসেস গোমেজের ফ্ল্যাটে গেছেন।

হ্যাঁ।

কখনো ছবি তুলেছেন?

বহুবার।

কোথায় ছবি?

টেলিফোনে।

দেখাবেন?

শরিফ সিঙ্গাপুরি টেলিফোনে একটা ছবি বের করলেন। মিসেস গোমেজ বসে রয়েছেন হুইল চেয়ারে।

একটু ক্লোজ করুন তো ছবিটা।

ছোটকাকুর কথা শুনে ছবিটা আরও ক্লোজ করলেন শরিফ সিঙ্গাপুরি। ছোটকাকু মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে বললেন, চলুন আবার যাওয়া যাক মিসেস গোমেজের ফ্ল্যাটে।

ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম, ইতিমধ্যে বিল্ডিংয়ের আরও কয়েকজন লোক সেখানে উপস্থিত। ইন্সপেক্টর মনিরের সঙ্গে বেশ কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ কাজ করছেন।

ছোটকাকু শরিফ সিঙ্গাপুরির ছবিটার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কী দেখতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।

ইন্সপেক্টর মনির, আপনি কিছু পেলেন?

পেয়ে যাব।

শরিফ সিঙ্গাপুরির প্রশ্ন শুনে ইন্সপেক্টর মনির বললেন, গন্ডগোল তো বাঁধিয়েছেন আপনি আর ছোটকাকু।

সেটা কী রকম?

ওই যে সমস্যা একটা—গুলিটা।

কেমন করে চলল।

আমি বলছি।

ছোটকাকু ইন্সপেক্টর মনিরকে বললেন, তবে তার আগে ঘরটা খালি করা প্রয়োজন। যাদের দরকার নেই তারা সব বেরিয়ে গেলে ভালো হয়।

ফ্ল্যাটের সবাই বের হয়ে গেল। ছোটকাকু একটু জোরে বললেন, জামাল হোসেন সাহেব আপনি একটু থাকবেন। দারোয়ান যে ঘড়িটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, ছোটকাকু সেই ঘড়িটা টেবিলের ওপর রেখেছিলেন। তারপর জামাল হোসেনকে বললেন, আপনার পকেটেই ছোট্ট একটা রিভলবার রয়েছে, সেটা বোধ হয় এই ঘড়ির পেটের মধ্যে স্পি্রং দিয়ে বসানো সম্ভব।

কী বলছেন আপনি? আমার লাইসেন্স করা রিভলবার।

আমি তো সেই প্রশ্ন করিনি। এমনকি বলিওনি আপনার রিভলবারে একটা গুলি কম রয়েছে।

কী বলতে চাইছেন আপনি?

অনেক কিছুই বলতে পারি আমি। কিন্তু আপনি ধন্যবাদ দেন ওই প্যাকেটে থাকা ডালপুরিটাকে।

আমি আর অর্শা ছোটকাকুর এই কথায় অবাক হলাম। ডালপুরির সঙ্গে এই ঘটনার কী সম্পর্ক? এর আগে আমরা যখন এই ঘরে এসেছিলাম তখন ডালপুরিটা মাটিতে পড়েছিল।

পুলিশ ঘটনার আলামত হিসেবে ডালপুরিটাকে প্যাকেটে করে টেবিলের ওপর রেখেছিল।

আমার আর অর্শার মতো জামাল হোসেনও বিস্মিত। আমি ঘটনাটা বলা শুরু করছি। ভুল হলে শুধরে দেবেন। আপনি চিন্তা করেছিলেন মিসেস গোমেজকে এমনভাবে খুন করবেন, যাতে কেউ কোনো দিন কিছু টের না পায়।

মিসেস গোমেজকে আমি খুন করতে চাইব কেন?

সেটা পরে বলছি। কিন্তু প্ল্যানটা মন্দ ছিল না আপনার। ঘড়ির মধ্যে রিভলবারটা বসিয়েছিলেন। পাখির বদলে বেরিয়ে আসবে রিভলবারের নল। আর চাপ পড়বে ট্রিগারে।

ইন্সপেক্টর মনির টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে বললেন, ঠিক বলেছেন, রিভলবারটা একেবারেই ঘড়ির মধ্যে বসে গেছে।

বিড়ালটা এই ঘড়ি থেকে গুলিটা বের হতে দেখেছে। আর তারপর দেখেছে মিসেস গোমেজকে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে। সে জন্যই এই ঘড়িতে যখনই ঘণ্টা বাজছে বিড়ালটা তখনই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। অবুঝ প্রাণীটা বুঝতে পেরেছে—এই ঘড়ি থেকেই তার মনিবকে কেউ আঘাত করেছে।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না জামাল হোসেন মিসেস গোমেজকে গুলি করবেন কেন?

ইন্সপেক্টর মনিরের প্রশ্ন শুনে ছোটকাকু শরিফ সিঙ্গাপুরির হাতের ফোনটা নিয়ে বললেন,

মিসেস গোমেজের ছবিটা দেখুন আর সামনের দিকে তাকান। কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে?

ইন্সপেক্টার মনির একবার ছবি আর আরেকবার সামনের দিকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ছোটকাকু বললেন,

আপনি বলার আগে বরং জামাল হোসেন সাহেবই বলুক, বই দুটো কোথায় গেল?

জামাল হোসেন সাহেব একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ। বই দুটো আমিই নিয়ে গেছি।

১৫৬০ সালে ছাপা শেক্সপিয়ারের  হ্যামলেট  এবং ১৮০০ সালে ছাপা চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস। অতি পুরোনো বই। অতি মূল্যবান বই দুটো এই ছবিতে ছিল। কিন্তু এখন বই দুটো ঘরের মধ্যে নেই।

ছোটকাকুর কথা শুনে জামাল হোসেন বললেন, আমি বহুবার বই দুটো মিসেস গোমেজের কাছে চেয়েছি। কিন্তু তিনি কিছুতেই দিতে রাজি হননি। অথচ আমি বই বিক্রির গ্রাহকও ঠিক করে ফেলেছিলাম। সে জন্য বাধ্য হয়ে এই প্ল্যান করেছিলাম। আমি জানতাম, গুলির শব্দের পরপরই যে হইচই হবে তার মধ্যেই আমি ঘড়িটা বদলে ফেলতে পারব।

সবকিছুই আপনার প্ল্যানমতো হয়েছিল। শুধু গন্ডগোল বাঁধিয়েছে বিড়াল আর ডালপুরিটা।

ছোটকাকুর কথা শুনে অর্শা বলল, বিড়ালের কথা বুঝলাম। কিন্তু ডালপুরির সঙ্গে এই ঘটনার কী সম্পর্ক?

ডালপুরিটা না থাকলে জামাল হোসেনের শাস্তি হতো ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এটা আবার কোন রহস্য?

শরিফ সিঙ্গাপুরির প্রশ্ন, বিড়ালের গলা থেকে ডালপুরি নেওয়ার জন্য মিসেস গোমেজ সামনের দিকে একটু ঝুঁকেছিলেন। সে জন্যই গুলিটা বুকে না লেগে হাতে লেগেছে।

ও... এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। ডালপুরির জন্য জামাল সাহেবের জীবনটা হয়তো বেঁচে গেল। কিন্তু মিসেস গোমেজ আবার এই ঘরে ফিরে আসবেন। এই চেয়ারে বসবেন। আড্ডা দেবেন। আর ঢং ঢং করে বাজা গির্জার ঘণ্টাটা শুনবেন। এটাই আমাদের পরম পাওয়া।

শরিফ সিঙ্গাপুরির আনন্দভরা এই কণ্ঠ শুনে জামাল হোসেনের কি একবারের জন্য মনে হবে, অন্যায় না করেও আনন্দে জীবন কাটানো একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে পরম পাওয়া।

অলংকরণঃ তুলি