ওরিগ্যানের রহস্যময় বাতিঘর

বাতিঘরের ছাপ্পান্ন ফুট উঁচু টাওয়ার
বাতিঘরের ছাপ্পান্ন ফুট উঁচু টাওয়ার

 যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগ্যান অঙ্গরাজ্যের হেসেটা সমুদ্রসৈকতে আমি ও আমার মেয়ে কাজরি এসে পৌঁছাই ঠিক দুপুরবেলা। গতকালও আমরা এ সৈকতে নেচার ওয়াক করতে এসেছিলাম। তখন পাহাড়ি ঝোরার মতো একটি নদীতে স্যামন মাছের উজিয়ে যাওয়া দেখেছি। পরিচয় হয়েছে ডিলান ও তার ড্যাডি মি. পেটরিক মারফির সঙ্গে। ডিলান কাজরির মতো এইটথ্ গ্রেডে পড়ে। তারা আমাদের সৈকতে পিকনিকের দাওয়াত দিয়েছে। তারপর তাদের সঙ্গে আমরা একটি বাতিঘর দেখতে যাব বলে কথা হয়েছে।

সৈকতে পড়ে আছে ঝড়ে শিকড় উপড়ানো আস্ত একটি গাছ। তার কাণ্ডে গলা ঠেকিয়ে রোদ পোহাচ্ছে রাশভারী চেহারার তিন তিনটি কচ্ছপ। আমাদের দেখতে পেয়ে তারা বিরক্ত হয়ে গলা সেঁধিয়ে ফেলে শক্তপোক্ত খোলের ভেতর। তারপর পাখনায় থপথপিয়ে বালু সরিয়ে চলে যেতে থাকে সমুদ্রজলের দিকে। তাদের একেকটির দেহ ওজনে তিন শ পাউন্ডের মতো। ‘নিশ্চয়ই এরা বালুচরে ডিম পাড়তে এসেছিল’, বলে মন্তব্য করতেই কাজরি বলে, ‘তোমার ধারণা সঠিক নয়, বাপি। এগুলো হচ্ছে গ্রিন সি টার্টোল বা সবুজ সমুদ্র কচ্ছপ। এদের চামড়ার রং শেওলার মতো সবুজাভ। এখনো এদের ডিম পাড়ার ঋতু আসেনি।’ আমি জানতে চাই, ‘তাহলে এরা এখানে কী করছে?’ সে জবাব দেয়, ‘প্রশান্ত মহাসাগরের পানি এই গ্রীষ্মকালেও বেশ ঠান্ডা। তাই গ্রিন সি টার্টোলগুলো রোদে বসে শরীর গরম করে নিচ্ছে।’ কাজরির স্কুল থেকে তাকে গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রকৃতি বিষয়ে একটি প্রজেক্ট করতে বলেছে। এ প্রজেক্টটি হবে তার হোমওয়ার্ক। সে নেচার ওয়াকে যেসব মাছ, পাখি, কচ্ছপ বা ডলফিন যা কিছু দেখবে , তাদের নিয়ে সে প্রজেক্টের জন্য একটি প্রবন্ধ লিখবে। নেচার ওয়াকের সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকার জীবজন্তু ও গাছপালা নিয়ে লেখা একটি বইও সে পড়ছে। তা থেকে সম্ভবত গ্রিন সি টার্টোল বা সবুজ সমুদ্রকচ্ছপ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।

বালুকায় পাথর দিয়ে চুলা বানিয়ে তাতে আস্ত স্যামন মাছ গ্রিল করছেন মি. পেটরিক মারফি। পাশে বসে টুংটাং করে গিটার বাজাচ্ছে ডিলান। কাজরিকে দেখে সে উঠে এসে বলে, ‘তুমি খুব সুন্দর একটি টপ পরেছ আজ। অ্যান্ড ইউ লুক বিউটিফুল।’ জবাবে কাজরি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘এ জামাটি আমার বাবা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন। কারুকাজ করা এ ধরনের টপকে বলে ফতুয়া।’ সে একটু থেমে বলে, ‘আই লাইক ইয়োর হেয়ার কাট ডিলান। ইউ লুক গুড টু।’ ডিলান একটু হেসে বলে, ‘ড্যাডি কাল সন্ধ্যাবেলা আমার চুল ছেঁটে দিয়েছে। একসময় ড্যাডি চুল কাটার দোকানে কাজ করত।  এখন তার অন্য রকমের চাকরি হয়েছে। কিন্তু শনি বা রোববারে সময় পেলেই সে আমার চুল ছেঁটে দেয়।’

মি. পেটরিক মারফি এসে আমার সঙ্গে হাত মেলান। আসার পথে আমরা কিনে এনেছি তিনটি ভুট্টা, বড় বড় কয়েকটি আলু, টমেটো, লেটুস ও পেঁয়াজপাতা। মাছ গ্রিল করা হয়ে যেতেই আমি আলু ও ভুট্টা রাংতায় মুড়ে ফেলে দিই গনগনে অঙ্গারের ওপর। কাজরি প্লাস্টিকের বউলে ছুরি দিয়ে টমেটো কেটে, লেটুস পাতা ছিঁড়ে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে ছড়িয়ে দেয় কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজপাতা। ততক্ষণে আলু ও ভুট্টা পোড়া হয়ে গেছে। গ্রিল করা স্যামন মাছের সঙ্গে সালাদ দিয়ে এসব খেতে আমাদের খুব ভালো লাগে। খাওয়াদাওয়ার পর কাজরি কিছু শুকনা শনপাপড়ি বের করে পেপার ন্যাপকিনে পরিবেশন করে। কিছুদিন আগে আমরা এক বাংলাদেশি দোকান থেকে এক বাক্স শনপাপড়ি কিনেছিলাম। আজকে তা সে ডিলান ও তার ড্যাডি মি. মারফির সঙ্গে শেয়ার করল। ডিলান বাংলাদেশি কোনো মিষ্টি এর আগে কখনো খায়নি। শনপাপড়ি খেয়ে এত খুশি হয় যে—সঙ্গে সঙ্গে সে গিটার বাজিয়ে গান ধরে, ‘আই বিলিভ আই উইল গো আউট টু সি শোর/ লেট দ্য ওয়েভ ওয়াস মাই মাইন্ড/ জাস্ট টু সি হোয়াট আই ক্যান ফাইন্ড।’ এ গানের বাংলা অনুবাদ করা যেতে পারে, ‘মনে হয় আমি সমুদ্রসৈকতে যাব / তরঙ্গমালা ধুয়ে দেবে আমার মন/  জানি না ওখানে—কী যে পাব?’

গানের কথা শুনে কাজরি বলে, ‘ডিলান, সৈকতে কী পেতে চাও তুমি? চলো খালি পায়ে পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটু হাঁটি।’ মি. মারফিও বলেন, ‘যাওয়া যাক একটু সামনে, বালুচর ধরে খানিকটা এগোলেই দেখা যাবে বাতিঘর। আশা করি বাতিঘরে ঘুরে বেড়াতে তোমাদের সবার ভালো লাগবে?’ সৈকতের একদিকে কিছু পানি জমে তৈরি হয়েছে পুকুরের মতো। তার একপাশে এক সারি গোলাকার পাথর দিয়ে কারা যেন বানিয়েছে বাঁধ। পানিতে একপায়ে দাঁড়িয়ে একটি ঝলমলে সবুজ পালকের গ্রিন হিরন পাখি। আমরা পানি কেটে যাচ্ছি দেখে সে জল ছেড়ে একটু উড়ে এসে বসে বাঁধের গোলাকার পাথরের ওপর। জলা জায়গায় সরসর করে হাঁটছে অনেকগুলো কাঁকড়া। সাদাকালো একটি হাঁস এসে তাদের একটিকে ধারালো ঠোঁটে চেপে ধরে। স্যাঁতসেঁতে জলাজমি পার হতেই চোখে পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিপুল বিস্তার। পানির ভেতর থেকে জেগে উঠেছে কালচে শিলাপাথরের দুটি বড়সড় জলপাহাড়।

জলপাহাড় দুটি পেছনে ফেলে একটু বাঁক ফিরতেই পাহাড়ের ওপর বাতিঘরটিকে স্পষ্ট দেখা যায়। পাহাড়টির গোড়া কালচে শিলাপাথরে বাঁধানো। ওখানে আছড়ে পড়ছে সবুজ রঙের ঢেউ। তা থেকে ২০৫ ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে আছে হেসেটা লাইট হাউস বা  বাতিঘর। তার টাওয়ারের চূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সবুজাভ লালচে রঙের আলো। আলোর বৃত্তটি যেন ঘুরে ঘুরে চক্রাকারে খুঁজছে সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ।

শিলাপাথরের জলপাহাড়
শিলাপাথরের জলপাহাড়

বাতিঘরে পৌঁছার জন্য টিলা বেয়ে আমাদের উঠতে হয়। আমরা খাড়াই ভেঙে বেশ খানিকটা ওপরে উঠতেই হাঁফ ধরে যায়। জিরানোর জন্য গাছের তলায় দাঁড়ালে, মি. পেটরিক মারফি বলেন, ‘১৮৯৪ সালে যখন এ বাতিঘর তৈরি হয়, আমার এক পূর্বপুরুষ অ্যাডাম মারফি ওখানে কাজ করতে আসেন। এদিকে তখন ঘরবাড়ি, জনবসতি, রাস্তাঘাট কিছু ছিল না। বাতিঘর তৈরি করার জন্য জাহাজে করে ইট, সিমেন্ট, কাঠ ও লোহা এসব নিয়ে আসা হয়। চিন্তা করো, অ্যাডাম মারফিকে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে মিলেঝুলে এ পথের খাড়াই ভেঙে মালসামান পাহাড়ের ওপরে তুলতে হয়েছিল।’ আমি এবার জানতে চাই, ‘জনবসতি থেকে অনেক দূরে জঙ্গলের ভেতর কেন অ্যাডাম মারফি কাজ করতে এসেছিলেন?’ জবাবে পেটরিক মারফি জানান, ‘আমরা আইরিশ আমেরিকান। অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষ আয়ারল্যান্ড থেকে অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসেন। তাঁদের অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসার পেছনে মূল কারণ ছিল দারিদ্র্য। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সাল অবধি আয়ারল্যান্ডে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ হয়। আইরিশদের প্রধান খাবার গোল আলু। আলুর ফলন নষ্ট হয়ে গেলে অনাহারের শিকার হয় আয়ারল্যান্ডের দশ লাখ মানুষ। অর্থনীতিতে মন্দা নামলে দলে দলে আইরিশরা জাহাজ চড়ে দেশত্যাগ করে। অভিবাসী হিসেবে তারা এসে উপস্থিত হয় আমেরিকার নিউইয়র্ক বা বস্টনের সমুদ্রবন্দরে। অ্যাডাম মারফির যখন বয়স পাঁচ , তখন তার মা-বাবা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসে বস্টন শহরে অভিবাসী হন। নতুন দেশে এসেও তাদের দারিদ্র্য গোছে না। অ্যাডাম মারফি বস্টনের একটি স্কুলে খানিকটা লেখাপড়া করেন। কিন্তু তাতে তার কোনো চাকরি জুটছিল না। তিনি কাজের সন্ধানে ওরিগ্যান অঙ্গরাজ্যে এসেছিলেন। এদিকে তখন বাতিঘর নির্মাণের জন্য শ্রমিক নিচ্ছিল। অ্যাডাম মারফি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে এখানে কাজ করতে আসেন।’

আমরা আবার খাড়াই ধরে বাতিঘরের দিকে হাঁটা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে এবার ডিলান জানায়, ‘অ্যাডাম মারফি এই বাতিঘরে মোট তেরো বছর কাজ করেন। তখন এ এলাকায় ছিল ঘন বনানী। বাতিঘরের অন্যান্য আরও পাঁচজন কর্মীদের সঙ্গে মিলেঝুলে তিনি পাহাড়ে হরিণ শিকার করতেন। সবাই মিলে অবসর সময়ে মাছও ধরতেন তাঁরা। এদিকে তো তখন খাবারদাবার কেনার জন্য কোনো দোকানপাট ছিল না। তো হরিণের মাংস এবং মাছ ছিল তাদের প্রধান খাবার।’ কাজরি এবার জানতে চায়, ‘ডিলান, তুমি অ্যডাম মারফির জীবন সম্পর্কে এত কিছু জানলে কীভাবে?’ সে জবাব দেয়, ‘অ্যাডাম মারফি রাতের বেলা বাতিঘরের পাহারায় থাকতেন, তাকে খেয়াল রাখতে হতো যাতে বাতি নিভে না যায়। সারারাত বসে থেকে থেকে তার খুব একা লাগত। তখন তিনি ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। ডায়েরিটি পড়ে আমি তার সম্পর্কে বিশদ জানতে পেরেছি।’

অ্যাডাম মারফির ডায়েরির কথা শুনে কাজরি বলে, ‘আমার বাবার পরিবারেও শুনেছি একটি পুরোনো বই আছে। অই বইটিতে আমাদের পূর্বপুরুষ কে কী কাজ করতেন, কার জন্ম কত সালে এসব লেখা আছে। আমি এই বইটির কথা শুনেছি কিন্তু কখনো দেখিনি।’ ডিলান এবার মন্তব্য করে, ‘এত বছর ধরে অ্যাডাম মারফির ডায়েরির কথা আমিও শুনছিলাম, কিন্তু কখনো তা চোখে দেখিনি। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমার স্কুল থেকে হোমওয়ার্ক হিসেবে জিনিওলজির ওপর একটি প্রজেক্ট করতে বলল। জিনিওলজি হচ্ছে নিজের পরিবারের পূর্বপুরুষদের কে কী কাজ করতেন, কোথা থেকে তাঁরা এ দেশে এসেছিলেন, সে সম্পর্কে খোঁজখবর করে সঠিক তথ্য বের করে আনা। তো অ্যাডাম মারফি ছিলেন আমার গ্র্যান্ডফাদারের বাবা গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার। আমি তাঁর জীবন নিয়ে প্রজেক্ট করতে চাই। তাই তাঁর ডায়েরির খোঁজখবর শুরু করলাম। ডায়েরিটি একসময় আমাদের পরিবারেই ছিল, পুরোনো হতে হতে তা ঝুরঝুরে হয়ে গেলে আমার গ্র্যান্ডফাদার তা শহরের স্থানীয় লাইব্রেরিকে সংরক্ষণের জন্য দেন। আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে তাঁর ডায়েরিটি পড়ি। আজ এই বাতিঘরে গিয়ে সরেজমিনে দেখতে চাচ্ছি তিনি কোন পরিবেশে কী ধরনের কাজ করতেন? বিষয়টি চোখে দেখতে পারলে প্রজেক্টের রিপোর্ট সুন্দরভাবে লিখতে পারব।’

হেসেটা বাতিঘরের চত্বরে উঠে আসতে আমাদের বেশি সময় লাগে না। তবে অনেক চড়াই -উতরাই ভেঙেছি তো, তাই আমাদের ক্লান্ত লাগে। আমরা কাঠের বেঞ্চে বসে একটু জিরাই। চার পাঁচটি বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাতিঘরের ছাপ্পান্ন ফুট উঁচু টাওয়ার। থোকা থোকা পাতার ফাঁকে কাচে তৈরি টাওয়ারের চূড়াকে দেখায় টোপর পরানো শৌখিন লন্ঠনের মতো। তাতে থেকে থেকে ঝলসে উঠছে লালচে সবুজ আলো।

কাজরি এবার ডিলানের কাছে জানতে চায়, ‘বাতিঘরে তুমি কি বিশেষ কোনো তথ্যের খোঁজ করছ?’ সে জবাবে বলে, ‘হেসেটা লাইট হাউস ইজ মিস্টিরিয়াস। এ বাতিঘর খুবই রহস্যময়। আমার পূর্বপুরুষ অ্যাডাম মারফি তাঁর ডায়েরিতে কিছু ভুতুড়ে ঘটনার কথা লিখেছেন। আমি জানতে এসেছি এসব সত্য কি না?’

‘কী ভুতুড়ে ঘটনা ডিলান?’ কাজরি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলে সে বলে, ‘অ্যাডাম মারফি অবসর সময়ে বসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। সে যুগে বাতিঘরের চত্বরে বসার জন্য কোনো বেঞ্চ ছিল না। তো তিনি টাওয়ারের পেছনে পাথরের ঢিবির ওপর বসে বসে দেখতেন সমুদ্রজলে লাফিয়ে উঠছে ডলফিন। একদিন খুব ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। ঢিবিতে বসামাত্র তাঁর মনের ভেতর কে যেন নীরবে বলে উঠল, সাবধান হও, সরে বসো এখান থেকে? না, তিনি কোনো শব্দ শোনেননি। ঠিক বুঝতে পারেন না তাঁর মন কেন কথা বলে উঠল! তখন কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে, এটা আমার মেয়ের কবর, ওখান থেকে সরে বসো ! শিউরে ওঠে অ্যাডাম মারফি পাহাড়ের দিকে তাকান। ওখানে কুয়াশার মধ্যে জেগে ওঠে ধূসর এক নারী মূর্তি। মহিলা হাতের ইশারায় তাকে ঢিবি থেকে সরে যেতে বলেন।’

কাজরি এবার জানতে চায়, ‘অ্যাডাম মারফি কি এ ঘটনায় ভয় পেয়েছিলেন? কী লিখেছেন তিনি তাঁর ডায়েরিতে, ডিলান?’ 

সে জবাব দেয়, ‘অ্যাডাম মারফি ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি লিখেছেন যে, তখন অবধি ভূতপ্রেতে তিনি আদৌ বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভাবেন—এসব তার মনের বিকার। বাতিঘরের চত্বরে একা বসে আছেন বলে তার দৃষ্টি বিভ্রম হচ্ছে, কুয়াশায় পাথরের আকৃতিকে হয়তো ভুল করে নারী মূর্তির মতো দেখছেন। বিষয়টি তিনি বিস্তারিতভাবে ডায়েরিতে লেখেন। লেখা শেষ হলে খেয়াল করেন টাওয়ারের কাচ দিয়ে ঠিক জোরালোভাবে আলো বেরোচ্ছে না। কেমন যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারে উঠে দেখেন বাতির কাচ ব্যাপকভাবে ময়লা হয়ে পড়াতে সবকিছু ধোঁয়াশা দেখাচ্ছে। ঘটনা কী? আজ সকালে না তিনি পাঁচ ঘণ্টা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কাচগুলো পরিষ্কার করেছেন। বাতিঘরের দেয়ালে লাগানো খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো বড় বড় কাচ। এসব খুলে পরিষ্কার করতে অনেক সময় লাগে। এগুলো ময়লা হলো কীভাবে? আর জোরালো আলো বের না হলে জাহাজের নাবিকেরা কীভাবে সমুদ্রে দিক খঁুজে পাবে? অ্যাডাম মারফিকে আবার সিল্কের কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয় বাতিঘরের কাচ। এ রকমের ঘটনা ঘটে পরপর তিনবার। তিনি ঢিবিতে বসে সমুদ্রের দিকে তাকালেই মনের ভেতর শুনতে পান সাবধান বাণী। কখনো পাহাড়ে দেখেন কুয়াশায় গড়া নারীমূর্তি। তারপর জাদুবলে ময়লা হয়ে যায় একটু আগে পরিষ্কার করা বাতিঘরের কাচ। অতঃপর তিনি সাবধান হন। এরপর আরও নয় বছর কাজ করেছিলেন তিনি এ বাতিঘরে। তবে আর কখনো ঢিবিতে বসেননি। আর কাচও ময়লা হয়নি।’

বাতিঘরের বৃদ্ধ কর্মচারী বেরিয়ে এসে হাতের ইশারায় আমাদের বাতিঘরে যেতে ডাকেন। তাঁর বয়স হয়েছে প্রচুর। চুল-দাড়ি মায় ভুরু পর্যন্ত পেকে ধবধবে সাদা। তিনি আমাদের প্রথমে টাওয়ারের লাগোয়া ছোট্ট কটেজটি দেখান। আগেকার দিনে অ্যাডাম মারফির মতো কর্মচারীরা এ কটেজে সারারাত বসে থাকতেন। কিছুক্ষণ পরপর সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারে উঠে পরীক্ষা করতেন কাচের চিমনি দিয়ে ঠিকমতো আলো ঝলকাচ্ছে কি না? বৃদ্ধ কর্মচারীর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে আমরাও উঠে আসি বাতিঘরের টাওয়ারে। কাচের কাঠামোটি দেখতে গম্বুজের মতো। কর্মচারী ব্যাখ্যা করে বলেন , এ ধরনের কাচকে বলা হয় ‘ফ্রেসনেল লেন্স’। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী অগাস্টিন জিন ফ্রেসনেল বাতিঘরে ব্যবহারের জন্য এ ধরনের লেন্স আবিষ্কার করেন। অত্যন্ত পুরু এ কাচ মূলত একধরনের প্রিজম। তাই এর ভেতর দিয়ে আলো প্রতিসরিত হলে তা দেখা যায় অনেক দূর থেকে। হেসেটা লাইট হাউস বা এ বাতিঘরের আলো সমুদ্রে ২১ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। ডিলান ক্যালকুলেটরে হিসাব করে বলে, ‘এর অর্থ হচ্ছে সমুদ্রে উনচল্লিশ কিলোমিটার দূরে ভেসে থাকা জাহাজ থেকেও এ বাতিঘরের আলো দেখা যাবে।’ ‘দ্যাট ইজ রাইট, কারেক্ট,’ বলে সাদা চুল -দাড়ি ঝাঁকিয়ে বৃদ্ধ কর্মচারী সায় দেন।

পাথরে বসে গ্রিন হিরন পাখি
পাথরে বসে গ্রিন হিরন পাখি

কাজরি এবার জানতে চায়, ‘অনেক বছর আগে জনবসতিহীন বনভূমিতে কেন বাতিঘর তৈরি করা হলো?’ বৃদ্ধ একটু চিন্তা করে তাকে বাতিঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘বাতিঘর তৈরি হওয়ার অনেক আগেই আঠারো শতকের মাঝামাঝি এদিকে জাহাজ ভাসিয়ে আসেন স্পেন দেশের অভিযাত্রীক ডন ব্রুনো ডে হেসেটা। নিচের সৈকতে জাহাজ নোঙর করে এদিককার সমুদ্রের চার্ট তৈরি করেন তিনি। চার্ট হচ্ছে অনেকটা মানচিত্রের মতো। তা দেখে নাবিকেরা বুঝতে পারেন , কোন জায়গায় জলের গভীরতা কতটুকু, কোথাও পানির নিচে পাথরের ডুবোপাহাড় আছে কিনা; আর স্রোত কোন ঋতুতে প্রবাহিত হয় কোনদিকে? পরবর্তীকালে তার চার্ট ব্যবহার করে নাবিকেরা বাণিজ্য জাহাজ চালাতে শুরু করেন। তখন কুয়াশায় নাবিকদের দিক নির্ণয়ে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বাতিঘরের। তাই ওরিগ্যান অঙ্গরাজ্যের সরকার ১৮৯৪ সালে এ বাতিঘর নির্মাণ করায়। অভিযাত্রিক ডে হেসেটা এদিককার নৌ চলাচলের জন্য সমুদ্রের চার্ট করেছিলেন বলে নিচের এ সৈকতকে বলা হয় হেসেটা সি বিচ। আর এ বাতিঘরের নামও তার নামে রাখা হয়েছে হেসেটা লাইট হাউস।’

সাদা-কালো হাঁসের ঠোঁটে কাঁকড়
সাদা-কালো হাঁসের ঠোঁটে কাঁকড়

‘আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চন স্যার,’ বলে ডিলান বুড়ো কর্মচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে নিজেকে এককালের বাতিঘরের কর্মচারী অ্যাডাম মারফির উত্তরপুরুষ পরিচয় দিয়ে তার ডায়েরিতে উল্লেখ করা ভুতুড়ে ঘটনা বর্ণনা করে। সব শুনে বৃদ্ধ বলেন, ‘ডায়েরির কথা আমি জানি না, তবে এখানে যে ভুতুড়ে একটা ব্যাপার আছে, তা আমি শুনেছি। নিচের কটেজের দেরাজে তালাবদ্ধ করে রাখা আছে বাতিঘরের লগবুক। অতীত দিনের কর্মচারীরা বাতিঘরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে, বা কোনো আজব ঘটনা ঘটলে তার বিবরণ লগবুকে লিখে রেখেছেন। লগবুকে আগেকার দিনের তিনজন কর্মচারী একই ধরনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যেমন ঢিবিতে বসা, মনে মনে সাবধান বাণী শোনা, কুয়াশায় নারীদেহের ছায়ামূর্তির দেখা পাওয়া; পরে কোনো কারণ ছাড়া কাচ ব্যাপকভাবে ময়লা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। তাদের কেউ কেউ এ নারীমূর্তিকে গ্রে লেডি বা ধূসর মানবী হিসেবে উল্লেখও করেছেন।’

টাওয়ার থেকে সিঁড়ি ধরে নামার সময় ডিলান আবার জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, আপনি কি কখনো এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন?’ তিনি হেসে জবাব দেন, ‘আমি তো মাত্র তিন বছর ধরে এ বাতিঘরের দায়িত্বে আছি। আগে নেভির জাহাজে কাজ করতাম। ওখান থেকে অবসর পেয়ে ওরিগ্যানের পোর্টল্যান্ড সিটিতে বাস করেছি কয়েক বছর। কিন্তু ওখানে মন টিকত না। সমুদ্র যেন স্বপ্নে আমাকে ডাকত, বলত—দূরে চলে গেলে কেন? ফিরে আসো আবার আমার কাছে। এ বয়সে তো জাহাজে আর ফিরে যাওয়া যায় না। তাই বাতিঘরে চাকরি নিয়ে এসেছি। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত সমুদ্রের ঢেউ চোখে দেখতে পাই।’ ডিলান তাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘স্যার আমার প্রশ্ন ছিল, আপনি কি কখনো ভুতুড়ে কিছু দেখেছেন?’ তিনি কটেজের জানালা দিয়ে সমুদ্রের তরঙ্গরাজির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে জবাব দেন, ‘দেখিনি, তবে গ্রে লেডির কথা বিশ্বাস করি। তার মেয়ের কবরের পাথরের ঢিবিটি আজকাল বুনো ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। ওদিকে আমি কখনো যাই না , কাউকে যেতেও দিই না। আর গ্রে লেডিও আমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলেন না।’ ডিলান এবার বলে, ‘আমার লাস্ট কোয়েশ্চন হচ্ছে স্যার, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে—পাথরের ঢিবির নিচে গ্রে লেডির মেয়ের কবর?’ বৃদ্ধ দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলেন, ‘লগবুক পড়ে আমি জানতে পেরেছি যে, ১৯৩৭ সালে এক পুরাতাত্ত্বিক কৌতূহলবশত পাথরের ঢিবিটি খোঁড়েন। তাতে একটি বাচ্চা মেয়ের কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ ঘটনায় গ্রে লেডি খেপে গিয়ে প্রতিদিন বাতিঘরের আয়না ময়লা করে দিতেন। কর্মচারীরা বারবার পরিষ্কার করেও এ সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। পরে বছর খানেকের জন্য বাতিঘর বন্ধ করে দিতে হয়। এখন তার রাগ পড়েছে। আর আমরা কর্মচারীরা কেউ তার মেয়ের কবরের কাছে যাই না। ছোট্ট একটি মেয়ে ওখানে অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে। তার শান্তি নষ্ট করা আমাদের উচিত না।’

বৃদ্ধ কর্মচারীর কাছ থেকে আমরা বিদায় নিই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাতিঘরের চত্বর ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয় না। পাহাড়ের প্রান্ত ঘেঁষে আমরা রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াই। সূর্যের তীব্র আলোয় সমুদ্রে উড়ছে রুপালি বাষ্প। আর তরঙ্গের ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে ছুটে চলেছে পাঁচটি ডলফিনের একটি ঝাঁক। একটি বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলি, অ্যাডাম মারফি তার ডায়েরিতে ডিগবাজি খাওয়া ডলফিনের বিষয় বর্ণনা করেছেন। আমরা ভাবি, হয়তো তিনি এ ডলফিনদের পূর্বসূরি কয়েক প্রজন্ম আগের ডলফিনদের এখান থেকে লক্ষ্য করেছিলেন। ডিলাম মৃদু স্বরে বলে, ‘অ্যাডাম মারফি কখনো জানবেন না যে, আমরা বাতিঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এ মুহূর্তে তার কথা ভাবছি, আর তার মতো দেখছি ডিগবাজি দেওয়া ডলফিন।’