আলী হোসেনের সমস্যা

পুরোনো ধরনের একটি বাড়ি। বড় বড় কাঠের দরজা-জানালা, এমনকি সামনে এক তোলা বাগানও আছে। বাগান বলা ঠিক হলো কি না, কে জানে; গাছগুলোর বেশির ভাগেরই নাম জানে না কেউ। ইস্কাটনের অহংকারী বাড়িগুলোর মধ্যে এ যেন হাত-পা ছড়িয়ে বসা যেমন খুশি তেমন বাড়ি। জঙ্গলে আগাছা সামনে নিয়ে রং ওঠা দালানটিকে হানাবাড়ি হয়তো বলা যেত, যদি বাড়িটিতে ভয়ংকর কিছু থাকত। বাড়ির বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম আর তার ৩৫ বছরের নাতি আলী হোসেনকে নিরীহ গোবেচারা বলাই সংগত, অন্তত পাড়া-প্রতবেশী তাই জানে আর কী। আলী হোসেন অবশ্য নিজেকে সাংঘাতিক লোক বলেই মানে, ছোটবেলা থেকেই রহস্য-রোমাঞ্চ আর গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে পড়তে ইদানীং তার এ বিশ্বাস বদ্ধমূল যে সে একজন বিশ্বমানের সমস্যা সমাধানকারী। তার নিজের এমন কিছু সমস্যা নেই বলে সে অন্যের সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত হয়েছে। আপাতত সমস্যা একটাই সমাধান করার মতো কোনো সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা খুঁজে পাওয়া এত মুশকিল কে জানত। সমাধানের যোগ্য সমস্যা খুঁজতে একজন সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাস তিনেক ধরে। আশ্বিনের এক বিকেলে তার সঙ্গেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে আলী হোসেনকে।

: তা কিছু পাইলা?

: না স্যার।

: না বললে তো হবে না। মন দিয়ে সন্ধান করো।

: জি স্যার।

: তোমার বয়স কত?

: সামনের মাসে ২৪ হবে স্যার।

: তোমরা আজকালকার ছেলে-ছোকরারা কাজে-কর্মে তেমন উৎসাহ পাও না, ঠিক না? তোমাদের বয়সে আমরা কত সমস্যা খুঁজে পেতাম। সমস্যা আর সংকটে জড়াজড়ি হয়ে থাকতাম বলতে গেলে।

: স্যার গত দুই মাসের বেতনটা..

: বেতন কী হয়েছে?

: আজ কত তারিখ?

: ১৫।

: প্রতি মাসের ৫ তারিখেই তো তোমার বেতনের চেক দিয়ে দেওয়া হয়।

: তা হয় স্যার, কিন্তু

: কিন্তু আবার কী?

: সেই চেক ব্যাংকে দিলে তারা টাকা দেয় না।

: কেন টাকা দেবে না কেন? স্বাক্ষর মিলে না বুঝি?

: স্বাক্ষর মেলে স্যার, কিন্তু ওরা বলে যে ব্যাংকে নাকি টাকা নাই।

: এই দেখো সমস্যা। ব্যাংক দিয়ে বসেছে অথচ টাকা নাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি লিখতে হবে। ব্যাংক আছে টাকা নাই।

: না মানে স্যার, ব্যাংকে টাকা ঠিকই আছে, আপনার অ্যাকাউন্টে টাকা নেই।

: আমার অ্যাকাউন্টে টাকা নেই?

: না স্যার।

: হবে হয়তো। দাদির কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে যেয়ো।

: দাদির কাছেও টাকা নেই। দাদি বলেছেন, আগামী সপ্তাহে বাজার করার মতো টাকাও নাকি নেই।

: তাই নাকি? এ রকম কেন হলো? সে যাকগে তুমি কিছু একটা সমস্যা খুঁজে বের করো। হাতে কিছু সমস্যা এলে তা সমাধান করে দেওয়ার জন্য কিছু টাকাও আসবে। পত্র-পত্রিকাগুলো পড়ো তো ঠিকমত?

: জি স্যার। পত্রিকা পড়ি, টিভি দেখি। কিন্তু সব সমস্যার সমাধানই টক শোগুলোতে দিয়ে দেওয়া হয়।

: টক শো আবার কী?

: আছে স্যার। টিভিতে দেখায়। সব সমস্যার সমাধান দু-তিনজন হাসতে হাসতে দিয়ে দেয়।

: ভারি মুশকিল হলো দেখছি। কী সময় এল রে বাবা সমস্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ সমাধানও দিয়ে দিচ্ছে। আজব।

: স্যার আমি যাই।

: যাও, দেখি আমি ভেবে টেবে একটা কিছু বের করতে পারি কি না।

আলী হোসেন ভাবতে থাকে। তার মানে হলো দেশে এখন সমস্যার অভাব। ভিক্ষার অভাবকে এক কথায় দুর্ভিক্ষ বলা যায়। সমস্যার অভাবকে কী বলা যাবে? ভাবনার জাল দাদির তীক্ষ্ণ চিৎকারে দড়ি দড়ি হয়ে যায়। হোসনে আরা বেগমের গলা তীব্রতর হচ্ছে। ছিন্নভিন্ন সূত্র নিয়ে বিষণ² আলী হোসেন অপেক্ষা করে। ৫০ বছরের সঙ্গী সবিতা রানীকে নিয়ে হোসনে আরা বেগম আসেন।

: তুই কী সারাটা জীবন এই ভেরেন্ডাই ভাজবি?

প্রশ্নটা তলিয়ে দেখে সংকটে পড়ে আলী হোসেন। ভেরেন্ডার কথা আগে শুনলেও জিনিসটা চেনে না সে। আর ভেরেন্ডা ভাজতে হলে কী তেল দরকার সেটাও সে জানে না। অথচ দাদি বলছেন সে ভেরেন্ডা ভাজছে, শুধু এখন নয় দাদির কথা সত্য বলে ধরে নিলে সারাটা জীবন ধরেই ভেরেন্ডা ভেজে আসছে সে। ভেরেন্ডা ভেরেন্ডা...শব্দটা কোন দেশি? আফ্রিকান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, ভেরেন্ডা।

: তখন থেকে কী বিড়বিড় করছিস?

: ভাবছিলাম

: কী ভাবছিস?

: ভেরেন্ডা নিয়ে

: আচ্ছা সবিতা তুই বল। আমার নাতিটা কি পাগল?

কানের কাছে মুখ নিয়ে সবিতা রানী বলে, বদ্ধ উন্মাদগো দিদি বদ্ধ উন্মাদ। জোয়ান ছেলে ঘর থেকে বেরোয় না। সারা দিন হাবিজাবি পড়ে আর কী সব খুঁজে বেড়ায়। মাথা কামিয়ে মলম লাগিয়ে দেন।

: আমি আর সহ্য করব না। এক সপ্তাহের মধ্যে তুই একটা কাজ খুঁজে বের করবি। দুই ঘর ভাড়াটে চলে গেছে ছয় মাস হয়। সংসার চলে কেমনে খবর রাখিস তুই?

দাদি চলে যাওয়ার পর আলী হোসেন সুডোকু খেলতে বসে। ঘরের দরজায় বড় বড় শব্দ। সুডোকু আর পেনসিল নিয়েই দরজায় আসে হোসেন। পুলিশ।

: পাইছি স্যার পাইছি। এ-ই সে।

: তাই নাকি?

: জি স্যার। খাতা কলম নিয়ে টাকা-পয়সার হিসাব করছে।

: এই তোর নাম কী?

: আমাকে বলছেন?

: আর কাকে বলব। আর সবার নাম তো আমার জানা। ভুলে গেলেও বুকে নেমপ্লেট আছে। কী আছে না?

: আছে।

: তোর নাম বল।

: আলী হোসেন।

: আসল নাম বল।

: আমার একটাই নাম। আলী হোসেন। অনেকে হোসেন আলী বলে ভুল করে অবশ্য।

: খুন করে কত টাকা পেয়েছিস?

: কাকে?

: তোর কী খুন করার আলাদা আলাদা রেট? তোদের চারতলায় যে থাকে তাকে খুন করে কত পেয়েছিস?

: আমাদের চারতলা?

: হুম মনে কর। মনে করে ঠিকমতো বল।

: কিন্তু আমাদের বাড়ি তো দুই তলা। মানে আমি তো তাই জানতাম।

: স্যার ঠিকই বলছে বাড়ি দুই তলা।

: মারাতÄক লোক তো? ছেটখাটো অপরাধীরা লাশটাশ গুম করে। এ গুণধর পুরো বাসাই গায়েব করে দিয়েছে? এ বিদ্যা শিখলি কোথায়?

: সুডোকু? নিজে নিজে শিখেছি।

: ও একে বুঝি সুডোকু বলে? কোন দেশি?

: জাপানি।

: কুংফু, জুডো, কারাতে শুনেছি, সুডোকু শুনি নাই। এত বছর পুলিশে চাকরি করেও কত কিছু অজানা রয়ে গেল।

: বাসাটা লুকিয়েছিস কোথায়? আবার বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিস নাই তো? যে ময়লা। ওখান থেকে তুলতে হলেই গেছি। যে ময়লা আর গন্ধ। তোদের মতো গুন্ডা-বদমাশদের কাণ্ডকীর্তি দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয় পুলিশের চাকরি করি, বলি যেন আমরা মানুষ নই।

কে রে আমার নাতিকে এমন গালাগাল দিচ্ছে। সবিতা, রান্নাঘর থেকে আমার খুন্তিটা নিয়ে আয় তো। চোখটা গেলে দেই প্রথমে। তারপর আস্তেধীরে বাবার নাম, বাড়ির নম্বর জানা যাবে?

: ওরে বাবা এদের দলে দেখি আরও লোক আছে। এই ওয়্যারলেসে খবর দে। থানাকে বাড়তি ফোর্স পাঠাতে বল।

: স্যার।

: আবার কানে কানে কথা বলছ কেন? তুমিও ভয় পেলে নাকি হাবিলদার, ছি ছি ছি।

: স্যার আমরা আসলে এই বাড়িতে আসতে চাইনি।

: তা চাইবে কেন? সব সময় তো ফাঁকি মারার তাল। থানায় বসে বসে লুডু খেলে জীবন পার করে দিতে পারলেই তো তোমাদের শান্তি।

: তা না স্যার। এই বাড়ির নম্বর ২৩৫, আমরা যাব ৫৩২ নম্বর বাড়িতে। ওটা চারতলা।

: তাই নাকি? ঠিকঠাক জানো ওই বাড়ির চারতলা সুডোকু না যুযুৎসু করে গায়েব করে দেওয়া হয়নি।

: না স্যার।

: তবে আর কী চলো। সঙ্গে কী এ ব্যাটা গোলাম হোসেনকেও বেঁধে নিয়ে যাব নাকি।

: বাদ দ্যান স্যার।

আহ একটি জ্বলজ্যান্ত সমস্যা পেতে পেতে পাওয়া হলো না। মন খারাপ করে খেলায় মন দেয় আলী হোসেন।