বিজ্ঞানী মামার মহা আবিষ্কার

মামার বদ্ধ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আবার মন খারাপ হয়ে গেল আনিকার। এই নিয়ে সাত দিন হলো মামার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখা হলো না তার। এটা কোনো কথা হলো! মামা মস্ত বড় বিজ্ঞানী, সারা দিন গবেষণা করেন। তাই বলে একবার দেখাও হবে না তার সঙ্গে! অভিমানে একেবারে চোখে পানি চলে এল আনিকার। 

সে এবার পড়ে ক্লাস থ্রিতে। তাদের বাসা থেকে তার মামার বাসা ঢিল মারা দূরত্বে কিন্তু মাঝখানে ধানমন্ডি লেকের কারণে আসতে হয় অনেকখানি ঘুরে। মায়ের সঙ্গে সেই ৮ নম্বর ব্রিজ বা ধানমন্ডি ২ নম্বরের রাস্তা হয়ে। মামা বলেছেন, আনিকাকে যেন এতদূর ঘুরে তার নানুর বাসায় না আসতে হয়, এ জন্য তিনি একটা ছোট্ট নৌকা বানিয়ে দেবেন। আনিকা তার বাসা থেকে নেমে নৌকায় উঠে সুইচ চাপলেই নানুর বাসার ঘাটে এসে নৌকা থামবে। সব মিলিয়ে দুই মিনিটের মামলা। তার চেয়ে বড় কথা, তখন সে একা একাই আসতে পারবে। সেই নৌকার লোভে লোভেই আনিকার প্রতিদিন এ বাসায় আসা। মামা নৌকা বানানোর কত দূর কী করলেন বুঝতে। কিন্তু মামার সঙ্গেই তার দেখা নেই। দরজা বন্ধ থাকছে প্রতিদিনই। সেই বন্ধ দরজায় আবার যে ধাক্কা দেবে, সে উপায়ও নেই। মামা দরজার ওপর শত শত যন্ত্রপাতি লাগিয়ে কী কী জানি করে রেখেছেন। যতই বাইরে থেকে ধাক্কাও না কেন ভেতর থেকে কিছুই শোনা যায় না। দরজার ওপর একটা সিসি ক্যামেরা বসানো। সেটা দিয়ে ভেতর থেকে সব দেখতে পান মামা। আর দরজার নবের ওপর একটা সাবধানবাণী। সেই সাবধানবাণী উপেক্ষা করে কেউ নবে ধরলেই ইলেকট্রিক শক মাস্ট। আনিকা প্রথমে কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাল। কিন্তু কিছু হলো না দেখে মরিয়া হয়ে যেই নবের দিকে হাত বাড়াল, তখনই খুট করে খুলে গেল দরজা। রুমের ভেতর হাজার হাজার যন্ত্রপাতির মাঝে একটা টেবিল আর সেই টেবিলের পেছনে একটা চেয়ারে বসে আছেন মামা চিন্তিতমুখে। উঠে এসে আনিকাকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, ‘কি রে কী হয়েছে? নবে হাত দিতে গিয়েছিলি কেন? আরেকটু হলেই তো ইলেকট্রিক শক খেতি।’

‘খেলে খেতাম। আমার নৌকার কী হলো মামা? কবে দেবে? সাত দিন হয় আসি, তুমি খালি ফাঁকি দিচ্ছ।’

‘না রে ফাঁকি দিচ্ছি না। তোর নৌকার ডিজাইন প্রায় শেষ করে ফেলেছি। এখন খালি তৈরি করে ফেললেই হবে।’

‘কবে করবে মামা?’

‘এই তো হাতের কাজটা শেষ করেই।’

‘হাতের কী কাজ?’

‘ভিন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে একটা গবেষণা। গবেষণাটাও প্রায় শেষের দিকে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলাম এত দিন। এই যে ডিশ অ্যান্টেনা দেখতে পাচ্ছিস, এগুলো দিয়ে সিগন্যাল ধরছিলাম। আমি এখন তাদের ব্যাপারে শিওর। বুঝলি, আমাদের সবার আসলে ভিন গ্রহের প্রাণীদের মাঝেই বসবাস। আমরা টের পাই না। কী বোকা আমরা!’

ভিন গ্রহের প্রাণীদের কথা শুনে কোল থেকে নেমে একেবারে লাফিয়ে উঠল আনিকা। বলল, ‘টের পাই না? তার মানে বলছ ভিন গ্রহের প্রাণী আছে?’

‘অবশ্যই আছে।’

‘এ রকম গল্প-উপন্যাসে সবাই বলে আছে। কিন্তু গল্প শেষ হওয়ার পরে দেখা যায় নেই। তখন খুব মন খারাপ হয় আমার। সেদিন জাফর ইকবালের একটা বই পড়ে বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম যে তারা আছে। পরে বই শেষ হওয়ার পর এত মনটা খারাপ হলো! তুমি সত্যি বলছ আছে? আচ্ছা কবে থেকে আছে? স্পেসিফিক একটা ডেট বলো। ’

‘তারা খুব চালাক। মানুষকে বুঝতেই দেয়নি যে তারা ভিন গ্রহ থেকে এসেছ। এ জন্য তারা দারুণ এক কৌশল নিয়েছে। সেই ১৮৭৬ সালের ১০ মার্চ থেকে তারা এই পৃথিবীতে আছে।’

‘সত্যি! তারা দেখতে কেমন?’

 কেউ বড়, কেউ ছোট। তবে তাদেরও মানুষের মতো বিবর্তন হয়েছে। মানুষের আগে যেমন লেজ ছিল, তাদেরও এই পৃথিবীতে শুরুটা লেজ দিয়ে হয়েছে। তবে তাদের লেজ ছিল দুটি। একটি প্যাঁচানো প্যাঁচানো আরেকটি স্ট্রেইট লম্বা লেজ। আর সেই লম্বা লেজের কারণে তারা বেশি দূর চলতে-ফিরতে পারত না। একটা ছোট জায়গার ভেতরই ঘুরপাক খেতে হতো।’

‘এখন তাদের আর লেজ নেই?’

‘না, এখন তাদের বেশির ভাগেরই একটা লেজও নেই। বিবর্তনের কারণে খসে পড়েছে। এখন তারা যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলতে-ফিরতে পারে।’

‘তাদের কি শিং আছে?’

‘হ্যাঁ, আগে একটা ছোট্ট শিং ছিল। এখন আর নেই। খসে পড়ে গেছে।’

‘তাদের কি চোখ-কান-মুখ আছে?

‘ হ্যাঁ আছে। তারা মানুষের মতোই শুনতে পায়, কথা বলতে পায়। আর ইদানীং দেখতেও পায়।’

‘চোখ কয়টা তাদের?’

‘প্রথম দিকে একটাও ছিল না। ইদানীং বেশির ভাগেরই চোখ ফুটেছে। কারও একটি চোখ, কারও দুটি।’

‘তারা কি কাপড় পরে?’

‘তারা একেবারে বিবর্তনের শুরুর দিকে আছে তো, তাই সবাই পরে না। তবে তাদের সবাই জন্মায় কিন্তু মানুষের মতোই ন্যাংটা পুটো হয়ে। পরে কেউ কেউ কাপড় পরে। কেউ কেউ একেবারেই পরে না। আবার অনেকে বেশি কাপড় পরে একেবারে পর্দানশীনও হয়ে যায়।’

‘তারাও কি মরে যায় মানুষের মতো?’

‘হ্যাঁ। তারা বেশিদিন বাঁচে না। গড় আয়ু খুবই কম তাদের। এই ধরো তিন থেকে চার বছর।’

‘তারাও কি মানুষের মতো খাওয়াদাওয়া করে?’

‘হ্যাঁ, তাদেরও খেতে হয়। ডেইলি একবার করে খায় তারা। অনেকের খিদে কম, তারা দু-তিন দিনে একবার করে খায়। আর অনেক অনেক খিদে লাগলে যদি তারা খাবার না পায় তাহলে ঘুমিয়ে পড়ে। আর অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকলে তারা আর জেগে উঠতে পারে না। মরে যায়।’

‘তাদেরও কি আমাদের মতো রাগ-দুঃখ হয়?’

‘দুঃখ হয় কিনা এখনো বুঝতে পারছি না। তবে তারা অনেক সময় রেগে যায় এটা শিওর। যখন তারা বেশি রেগে যায়, তখন অনেক উল্টাপাল্টা আচরণ করে। পুরো শরীর গরম হয়ে যায় রাগে।’

‘বলো কী! ওদেরও কি শরীর খারাপ করে?’

‘হ্যাঁ, করে। আমাদের মতোই ভাইরাসে ধরা, কেটে-ছিলে যাওয়া ইত্যাদি হয়। তখন তারা ডাক্তারের কাছে যায়। বেশি সমস্যা হলে অপারেশনও করতে হয়।’

‘বাপ রে। আচ্ছা, তারা কি আমার মতোই। সাঁতার শিখতে পারেনি এখনো?’

‘না। এইটা একটা অবাক করা বিষয়। তারা ইদানীং অনেক স্মার্ট হয়ে উঠলেও এখনো সাঁতারটা শিখে উঠতে পারে না। অনেকের তো আবার জলাতঙ্কও আছে। পানি দেখলেই ভয় পায়।’

‘আচ্ছা তাদের গায়ের রং কী?’

‘ওই যে বললাম না মানুষের মতোই। মানুষের যেমন গায়ের রং সাদা-কালো-বাদামি আছে, তাদেরও তেমনি আছে। তবে তারা একেবারেই বর্ণবাদী নয়। তবে আজকালকার ভিন গ্রহের প্রাণীগুলো খুব স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। তারা অবশ্য বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারে অনেক আগে থেকেই।’

‘বাংলাও বলতে পারে?’

‘হ্যাঁ, পারে। ইদানীং পারে। এমনকি বাংলায় লিখতেও পারে।’

‘তারা কি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে?’

‘বোকা মেয়ে। পারবে না কেন, অবশ্যই পারে। পৃথিবীর প্রতিটি ভিন গ্রহের প্রাণী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, কথা বলতে পারে। লিখে লিখে চিঠি পাঠাতে পারে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন।’

‘মামা, এরা কি মানুষের মতোই সাইজ?’

‘না রে, এই জায়গায় তারা একটু ডিফারেন্ট। মানুষের মতো এত বড় না তারা। তাদের অবশ্য এত বড় হওয়ার দরকারও নেই। সাইজে তারা একেবারে মানুষের হাতের সমান।’

‘মামা এরা কোথায় থাকে। আমি এদের দেখি না কেন?’ বলে আনিকা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

মামা বললেন, ‘অবশ্যই তুই দেখিস। আমি তুই আমাদের আশপাশের সবাই এই ভিন গ্রহের প্রাণীদের দেখতে পাই। কিন্তু আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে এরাই সেই ভিন গ্রহের প্রাণী। যখন তারা তাদের গ্রহে যায়, তখন সসারের মতো বাহন ব্যবহার করে। আর বাকি সময় আমাদের সঙ্গেই থাকে।’

‘আমারে সঙ্গেই থাকে?’

‘হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গেই থাকে। তবে ছোটদের সঙ্গে থাকে না। বড় মানুষদের সঙ্গে থাকতে এরা বেশি পছন্দ করে বলে তাদের সঙ্গেই বেশি থাকে।’

‘মামা, এরা কারা, কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। বলো না মামা, বলো না।’ বলে আনিকা পাগলের মতো লাফিয়ে ওঠে।

মামা আনিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ‘তুই তো অনেক বুদ্ধিমান। নিজেই ভেবে বের কর। এরা দিন যাচ্ছে আর আমাদের দখল করে নিচ্ছে। আমরা নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি তাদের ওপর। আমি আর বেশি কিছু বলব না। এই ভিন গ্রহের প্রাণী এই রুমেও একটা আছে। খুঁজে বের কর দেখি।’

অলংকরণঃ শিখা