হাওরের গান

হাওরজুড়ে শেষ বর্ষার পানি এখনো থইথই করছে। দিনমান সেই পানিতে ডানা ঝাপটিয়ে খেলা করছে কতশত পানকৌড়ি। পানিতে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলো রাতের বেলা যেন জেগে ওঠে। সন্ধেবেলায় ঘরের বধূ কুপিবাতি জ্বালিয়ে দেয়। হাওরের লিলুয়া বাতাসের স্পর্শ পেয়ে কোমল মোহনীয় সেই আলো নিবু নিবু জ্বলতে থাকে। এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে ভেসে আসে গানের সুর—‘জ্বালাইয়া মোমের বাতি, জেগে রইলাম সারা রাতি গো...’।

দিনের অবসরে বাড়ির আঙিনায় বসে গানের আসর
দিনের অবসরে বাড়ির আঙিনায় বসে গানের আসর

ঠিক সত্যি সত্যিই এ গানের মতো হাওরের বাসিন্দাদের অনেকে সারা রাত জেগেই পার করে দেন। কারণ, বর্ষা মৌসুমে প্রতি রাতেই গ্রামে গ্রামে ঘটা করে আয়োজন করা হয় যাত্রাগান, বাউলগান, কীর্তন, মুর্শিদী ও ফকিরিগানের আসর। আর সেসব আসরের মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে হাওরের নারী-পুরুষ সবাই ঘুমহীন রাত কাটান। ঢুলুঢুলু ঘুমচোখে ছোট ছেলে-মেয়েরাও এসব আসরে বুঁদ হয়ে থাকে। আসর শেষে সেই ভোরে ঘুমোতে যান সবাই। এভাবে হাওরবাসী বংশপরম্পরায় বর্ষা যাপন করে আসছেন যুগের পর যুগ।

দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গান, এই হলো হাওরের মানুষের বিনোদন
দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গান, এই হলো হাওরের মানুষের বিনোদন

বৈশাখ মাসে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ঘরে তোলার পর এখানকার মানুষের তেমন কোনো কাজ থাকে না বললেই চলে। এই অবসর সময়টুকুই তারা গান-বাজনা আমোদ-প্রমোদ করে কাটিয়ে দেন। বৈশাখ শেষে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে হাওরের বাঁধ ভেঙে কিংবা নদীর পাড় উপচে হুহু করে চারপাশে পানি ঢুকতে থাকে। এতে তলিয়ে যায় মাঠের পর মাঠ, খেতের পর খেত। এমনকি গ্রামগুলোতে পর্যন্ত সেই পানির ঢেউ এসে লাগে। গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে অলস দিন কাটানোর সময়ই নানা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন।

বর্ষায় অলস সময় কাটাতে গ্রামের কেউ কেউ যাত্রাগান লিখে আরও কয়েকজনকে নিয়ে সেটা মঞ্চায়ন করেন। কেউবা গান লিখছেন আবার অন্য একজন সেটাতে সুর দিয়ে আসর জমিয়ে তুলছেন। কেউ আবার দূরদূরান্তের নামীদামি বাউলশিল্পীদের এনে রাতের পর রাত বসাচ্ছেন গানের আসর। এভাবেই হাওরে গানের জন্ম ও উত্থান। পুরো বর্ষাজুড়ে গ্রামীণ মানুষ এভাবেই নানা গান ও উৎসব আয়োজনে সময় কাটান। যে বছর বর্ষায় পানি বেশি হয়, সে বছর মানুষের দুর্ভোগেরও শেষ থাকে না। কারণ, ঝোড়ো বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটায় পানির প্রমত্ত ঢেউ ভেঙে নিয়ে যায় বাড়িঘর। ঝড়-ঝঞ্ঝাট মোকাবিলা করে বুক চিতিয়ে পথ চলেন হাওরের মানুষ।

গানের পাশাপাশি নাচেও পারদর্শী হাওরের মানুষ
গানের পাশাপাশি নাচেও পারদর্শী হাওরের মানুষ

প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের কারণে হাওরবাসীর আছে বাধা, আছে বিপত্তি। এতদ্সত্ত্বেও শত দুর্যোগ-দুর্ভোগ-দুঃসময় উপেক্ষা করে হাওরের মানুষ শামিল হন আনন্দযজ্ঞে। আর এই আনন্দযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গান আর লোকনাট্যের নানা ধারা-উপধারা। কেউ হয়তো এবেলা খেয়েছেন তো ওবেলা অর্ধাহার কিংবা অনাহারে কাটিয়েছেন। কিন্তু যখন গানের আসর শুরু হয়, তখন এই অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত মানুষগুলোই হয়ে ওঠেন ডাকসাইটে শিল্পী অথবা যাত্রাভিনেতা। পেটের ক্ষুধা অগ্রাহ্য করে রাতভর গেয়ে শোনান কতশত গান। কেবল গানই নয়। বংশপরম্পরায় গ্রামীণ মানুষ নৌকাবাইচ, মোরগ লড়াই, লাঠিখেলা, কুস্তিখেইড়, দাবা প্রতিযোগিতাসহ কতশত লোকক্রীড়ারও আয়োজন করে থাকেন।

‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়...’ সুর তুলে দিনভর চলে নৌকাবাইচ। সে বাইচে যোগ দেন আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ। কেউ কেউ উঠোনে মাদুর বিছিয়ে ষোলগুটি কিংবা তাস খেলায় মেতে ওঠেন। ছোট ছেলেরা ব্যস্ত থাকে মার্বেল খেলায় আর মেয়েরা মাটির পুতুল তৈরিতে। দিনমান এভাবেই খেলায় খেলায় কেটে যাওয়ার পর শেষ বিকেলের সূর্য যখন টুপ করে ডুব দেয় হাওরের পানিতে, তখন ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’। চারপাশে নেমে আসে সন্ধ্যার নীরবতা। সেই নীরবতা ভাঙে বাউলের একতারার সুর কিংবা কোনো লোকগায়কের সুকণ্ঠী গায়কিতে। এরপর রাতভর ঢোল বাজে, খোল বাজে, করতাল বাজে, বেহালা বাজে, লোকবাদ্যযন্ত্রের মনোহর তালে নাচে গ্রামীণ মানুষের মন।

হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রেমে পড়েই এখানকার মানুষ আউল-বাউল-সাধক-শিল্পী হয়ে ওঠেন। এই হাওরাঞ্চলেই জন্ম নিয়েছেন হাসন রাজা, রাধারমণ, উকিল মুনশি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শাহ আবদুল করিম, জালাল উদ্দীন খাঁ, রামকানাই দাশসহ প্রখ্যাত শিল্পীরা। হাওরের লিলুয়া বাতাস গায়ে মেখেই উকিল মুনশি রচনা করেছিলেন ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে পুবালি বাতাসে’, ‘সুজন বন্ধু রে আরে ও বন্ধু কোনবা দেশে থাকো’সহ অসংখ্য গান। একইভাবে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমও লিখেছিলেন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে’, ‘বসন্ত বাতাসে’, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’সহ পাঁচ শতাধিক গান। হাওরকন্যার প্রেমে পড়ে হাসন রাজা লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান—‘নিশা লাগিল রে’।

সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এই সাত জেলার হাওর-অধ্যুষিত যেকোনো উপজেলায় গিয়ে এখন কেবল গানের আসরের আয়োজনই চোখে পড়বে সবার। ইতিমধ্যে পানি নামতে শুরু করেছে, কিছুদিন পরেই শুরু হবে বোরো ধান রোপণের মৌসুম। তখন কাজের চাপে গানের আয়োজনে কিছুটা ভাটা পড়বে। তাই দেরি না করে যত শিগগিরই সম্ভব হাওরের পথে রওনা দিতে পারো। এই সময়টাতে হাওরে আসতে পারলে এখানকার মানুষের বর্ষাযাপন তোমরাও উপভোগ করতে পারবে। এবার চলো তাহলে রওনা দিই রোমাঞ্চকর হাওর অভিযাত্রায়।