কুতুকাতু কাতুকুতু

কাতুকুতু দিলে হাসে না এমন মানুষ একটু বিরলই বটে...।
কাতুকুতু দিলে হাসে না এমন মানুষ একটু বিরলই বটে...।

কাউকে হুটহাট করে মধুর বিপদে ফেলতে চাও? চিন্তা কি! জাঁদরেল একটা অস্ত্র তোমার সঙ্গেই আছে। ভাবছ, এটা আবার কেমন কথা! আহা, বলছি। কাউকে হাসাতে চাও বা নাচাতে চাও, গলা দিয়ে গগন ফাটানো চিৎকার বের করাতে চাও অথবা তোমার বশে নিতে চাও—অব্যর্থ অস্ত্র হলো কাতুকুতু। এই অস্ত্র ব্যবহার করে কারও লম্ফঝম্ফও দেখার সৌভাগ্য হতে পারে। তবে খেয়াল করলে দেখবে, সাধারণ সৌজন্যমার্কা হাসির চেয়ে কাতুকুতুমার্কা হাসি কিন্তু ভিন্ন রকম। সৌজন্যমার্কা হাসিতে বড়জোর দাঁত বের হয়, কিন্তু কাতুকুতু হাসি আসে পেট কাঁপিয়ে। আমার হাসিটা কেমন হচ্ছে, সেটা চিন্তা করার মতো সময়ও পাওয়া যায় না। কাতুকুতু নিয়ে কিন্তু সুকুমার রায়ের একটা কবিতা আছে ‘কাতুকুতু বুড়ো’। সেখানে তিনি লিখেছেন,

‘আর যেখানে যাও নারে ভাই সপ্তসাগরপার,

কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!

সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তারবাড়ি

কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি।’

পেটের নাড়ি ছিঁড়লে ছিঁড়ুক। কিন্তু কাতুকুতুর কুলপি খায়নি বা অন্যকে খাওয়ায়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ক্লাস চলাকালে সবচেয়ে ভদ্র ও সহজ দুষ্টুমির একটা হলো, সামনের বেঞ্চে বসা মনোযোগী বন্ধুকে সুড়সুড়ি দেওয়া। বেচারা টিচারের ভরে কিছু বলতেও পারে না আর ওদিকে দুই পক্ষেরই দম ফাটানো অবস্থা। কেউ গাল ফুলিয়েছে তোমার ওপর, অভিমান করে আছে? ব্যস...সুরসুর করে সুড়সুড়ি শুরু হয়ে যাক। কতক্ষণ সেই মানুষটা মুখ পেঁচা করে হাসি চেপে রাখবে!

এবার নিয়মকানুনের কথা একটু বলে নিই। সুড়সুড়ি দেওয়ার নিয়মটা হচ্ছে অন্যের গায়ে হালকা করে ছুঁতে হবে। জোরে চেপে ধরলে কিন্তু সুড়সুড়ি পালাবে। তখন উল্টো তোমাকেই ধোলাই খেতে হবে। হঠাৎ করে এই আলতো স্পর্শে ব্রেনে অ্যালার্ম বাজা শুরু হয়ে যায়। আর তাতেই যত হাসিখুশি কাহিনি। আর মনে আছে নিশয়ই, সুড়সুড়ির প্রকাশটাই হলো পেট কাঁপানো হাসিতে। কেউ সুড়সুড়ি দিলে আমরা এমন অনুভূতি পাই। কারণ, আমাদের ত্বকের নিচে যে স্নায়ু বা নার্ভ আছে, এর প্রান্তগুলো উত্তেজিত হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সংবাদ চলে যায় ব্রেনে। ব্রেনের দুটো অংশে এসবের বিচার-বিশ্লেষণ চলে। একটা অংশ হলো সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স, যেটা স্পর্শ ও চাপের ধরন নিয়ে বিশ্লেষণ করে। আরেকটা অংশ হলো অ্যান্টেরিয়র সিংগুলেটেড কর্টেক্স। এখানে যখন সিগন্যাল পৌঁছে যায়, তখনই আসল অ্যালার্ম বাজা শুরু হয়। 

নিজেকে কখনো সুড়সুড়ি দিয়ে দেখেছ? নাহ্‌, কিচ্ছু হওয়ার না। এর কারণ হলো, আমাদের ব্রেনের পেছনে সেরেবেলাম আছে, যেটা শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। যখন নিজেকে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবে, সেরেবেলাম মহাশয় আগেই বুঝে যাবেন এবং ব্রেনকে বলে দেবেন, ওই যে আসিতেছে। আর তাতেই ব্রেন সুড়সুড়ির হুঁশ হারিয়ে চুপ হয়ে যাবে। কিছুই টের পেতে দেবে না। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, ব্রেন এমন আচরণ করে কেন? আসলে, এটা করে ইন্দ্রিয়জনিত বা সংবেদন অপচয় রোধের জন্য। ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। আমাদের ব্রেন কিন্তু অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলোকে ফিল্টার করে ফেলে। এতে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো মনোযোগ দিয়ে কাজে লাগানো যায়। নিজের হাতের ছোঁয়া ব্রেন অতটা প্রয়োজনীয় মনে করে না। তাই আমাদের মন এই অনুভূতিতে সচেতন হওয়ার আগেই ব্রেন এই তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়। তবে, এদিক-ওদিক থেকে সুড়সুড়ি এলে সেরেবেলাম আগে থেকে বুঝতে পারে না, তাই প্রতিরোধও করতে পারে না।

কখনো কাতুকুতু না দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করলেও হাসি পায়
কখনো কাতুকুতু না দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করলেও হাসি পায়

কারও কারও তো সারা গা-ভর্তি সুড়সুড়ি। তাদের ধরলেই চিৎকার করে লাফ দেবে। আবার কেউ কেউ গা শক্ত করে রেখে ভান দেখায়, যত যা-ই করো, আমার সুড়সুড়ি নেই। তবে কাউকে তীব্র কাতুকুতু দেওয়ার জায়গা হলো পায়ের পাতা, বাহুমূল ও ঘাড়। কারণ, এসব জায়গা খুব সংবেদনশীল। সামান্য আঘাতে অসামান্য পরিণতি ঘটতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে এসব অংশকে রক্ষা করার জন্য সুড়সুড়ির অনুভূতি সতর্কসংকেত হিসেবে কাজ করে।

তবে সাবধান, সুড়সুড়ি কিন্তু প্রয়োগ করতে হবে বুঝেশুনে, ডোজ বুঝে ওষুধ খাওয়ানোর মতো। এমন যেন না হয় যে ওভারডোজ হয়ে সুড়সুড়ির হাসি হাসার পর তোমার বন্ধু তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বসল। তবে কিন্তু মহা মুশিবত। আর জানো তো, সব ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। যেকোনো সময়, প্রতিপক্ষ পালানোর চেষ্টা না করে তোমাকেই পাল্টা আক্রমণ করে বসতে পারে। তাই কাতুকুতুর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় আত্মরক্ষার টেকনিক শিখেই মাঠে নেমো।

মডেলঃ সৌরভ ও নাসিফ

ছবিঃ কবীর শাহরীয়ার