প্রাণীদের শব্দ

অভিধানের গল্পের এবারের শব্দ ও বাগ্‌ধারাগুলো প্রাণিবাচক। চারপাশের প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রাণীর বিশেষ কিছু স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে মানুষের স্বভাবের যেগুলো মেলে উপমা হিসেবে মানুষ সেগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। শব্দের জগৎ যে কত বিচিত্র হতে পারে এসব শব্দ ও বাগ্‌ধারার মধ্যে তার বেশ পরিচয় পাওয়া যায়।

অহিনকুল সম্পর্ক

মানুষে-মানুষে অহিনকুল সম্পর্কের কথা আমাদের অজানা নয়। চিরশত্রুতা বা চিরস্থায়ী শত্রুতার সম্পর্ককে আমরা অহিনকুল সম্পর্ক বাগ্‌ধারা প্রকাশ করি।

অহি ও নকুল—এই দুই শব্দের দ্বন্দ্ব সমাসে তৈরি হয়েছে অহিনকুল। ভাষাজগতের দ্বন্দ্ব সমাসে অহি ও নকুল একত্রে বাস করলেও বাস্তব জগতে এদের ভয়ানক দ্বন্দ্ব এবং এদের সম্পর্ক ও অবস্থান ভিন্ন। এটাই অহিনকুল সম্পর্কের আসল কথা।

অহি শব্দের অর্থ সাপ এবং নকুল শব্দের অর্থ বেজি। প্রাণিকূলে সাপ ও বেজি পরস্পরের চিরশত্রু। এই শত্রুতাই বনজঙ্গল পেরিয়ে আমাদের মুখের কথায় এসে পড়েছে।

এই অহিনকুল কথাটাই আবার আমাদের কথা বলার চলতি ভঙ্গিতে সাপেনেউলে হয়ে দাঁড়ায়। তাতে অর্থের হেরফের হয় না। হেরফেরটা কেবল সাধু ও চলিত ভাষার। নেউল মানেও বেজি।

ওত পাতা

আক্রমণের জন্য কিংবা কারও গোপন কার্যকলাপ অকস্মাৎ ধরে ফেলার জন্য সতর্কভাবে প্রতীক্ষা করার ব্যাপারটিকে আমরা ওত পাতা অথবা ওত পেতে থাকা বাগ্‌ধারায় প্রকাশ করে থাকি। আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকার কাজটি মানুষও যেমন করে, তেমনি প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রাণীও করে থাকে।

বিড়াল কীভাবে শিকারের জন্য ওত পেতে থাকে সে দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। বাঘও এ ধরনের কাজ করে থাকে। কিন্তু বাঘের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা কম। আমরা বিড়ালেরটাই বেশি চিনি।

ওত পাতা কথাটি এসেছে সংস্কৃত ওতুবৎ থেকে। ওতুবৎ শব্দটির অর্থ হলো ওতুব মতো। সংস্কৃত এই ওতু হলো বাংলা বিড়াল।

গড্ডলিকা প্রবাহ

গড্ডল শব্দের অর্থ ভেড়া। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশু হিসেবে ভেড়ার স্থান খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়। সম্ভবত এই কারণেই গড্ডল বা ভেড়া থেকে তৈরি শব্দগুলো বাংলাভাষায় ভালো কোনো অর্থ বহন করে না। গড্ডল থেকে তৈরি হয়েছে গাড়ল, ভেড়া থেকে তৈরি হয়েছে ভেড়ুয়া শব্দ। শব্দ দুটির কোনোটার অর্থই ভালো নয়।

গড্ডলিকা শব্দটিও এসেছে গড্ডল থেকে। শব্দটির অর্থ হলো ভেড়ার পালের অগ্রবর্তিনী স্ত্রী ভেড়া। গড্ডলিকাপ্রবাহ কথাটির অর্থ হলো স্ত্রী ভেড়ার পিছু পিছু চলা ভেড়ার পাল। এভাবে চলাটা ভেড়াদের এক অনবদ্য স্বভাব।

বাংলাভাষায় গড্ডলিকাপ্রবাহ কথাটির অর্থগত কোনো প্রয়োগ নেই। আছে শুধু আলংকারিক প্রয়োগ। ফলে কথাটি এখন বাগ্‌ধারায় পরিণত। নিজে বিচার-বিবেচনা না করে অন্ধ ও গাড়লের মতো অন্যকে অনুসরণ করাই হলো গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো।

গোধূলি

গোধূলি সংস্কৃত শব্দ। যখন গরুর পাল ধূলি উড়িয়ে গোশালায় ফেরে সেই সময়টা হলো গোধূলি বা গোধূলিবেলা। সংস্কৃত অভিধানে আছে হেমন্ত ও শীতে সূর্যের তাপ মৃদু বা কম হয়ে এলে, বসন্ত ও গ্রীষ্মে সূর্য অর্ধাস্তমিত হলে এবং বর্ষায় ও শরতে সূর্য অস্তমিত হলে সেই সময়টাকে বলে গোধূলি।

গরু এবং ধূলিযুক্ত হলেও গোধূলি শব্দটি চিত্ররূপমা। দিনের শেষে রাখাল মাঠ থেকে গরুর পাল নিয়ে ফিরছে। গরুর খুরে মেঠোপথে উড়ছে ধূলি। দিগন্তে সেই ধূলির আবরণ। তাতে মিশছে অস্তগামী সূর্যের রক্তিমাভা। আর সেই ছবিটাই হলো আসল গোধূলি বা গোধূলি লগন। তবে গোধূলির এই ছবির এখন আর দেখা পাওয়া যায় না।

শশব্যস্ত

ব্যস্তসমস্ত বা অত্যন্ত ব্যস্ত ভাবকে আমরা শশব্যস্ত শব্দ দিয়ে প্রকাশ করি। শশব্যস্ত প্রাণিবাচক একটি শব্দ। এর ব্যাকরণগত অর্থ হলো শশক বা খরগোশের মতো ব্যস্ত।

প্রাণিকূলে অত্যন্ত সতর্ক, চঞ্চল ও ব্যস্তসমস্ত প্রাণী হিসেবে শশকের নাম অতি বিখ্যাত। তা থেকেই যে ধরনের ব্যস্ততার মধ্যে শশকের ওই সব ভাব রয়েছে তাকেই আমরা শশব্যস্ত বলি। আমরা শশব্যস্ত হয়ে পড়ি আবার শশব্যস্ত হয়ে চলি।

হ্যাংলা

কারও হ্যাংলামি বা হ্যাংলাপনা দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিরক্তি আসে, ঘেন্নাও লাগে। তাই এই হ্যাংলামি ব্যাপারটা সহজে বোঝানো সম্ভব নয়। অভিধানে হ্যাংলা শব্দের অর্থ দেওয়া আছে, যে হীনভাবে লোভ প্রকাশ করে, খেলো ধরনের লোক এবং যার দৃষ্টি অশোভনভাবে লোলুপ। হ্যাংলামি দেখলেই কুকুরের কথা মনে পড়ে যায়।

বস্তুত কুকুরের আরেকটি প্রতিশব্দ হলো হেঙ্গল। আর হেঙ্গল থেকেই হ্যাংলা বা হ্যাংলামি।