কী ছিল...ওটা?

স্বীকার করতে আপত্তি নেই, বেশ খানিক ভয়ে ভয়ে এই অদ্ভুত লেখাটা লিখতে বসেছি। যে ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণনা এখানে আমি দেব, তা এতটাই অস্বাভাবিক যে পাঠকমাত্রই আমাকে পুরো অবিশ্বাস করবে এবং সমালোচনার কোনো সীমা মানবে না। তার সবই গ্রহণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছি আমি। অবিশ্বাস্য সত্যকে গ্রহণ করার সাহিত্যিক সাহস আমার আছে।

জটিল বিষয় যথাসম্ভব সহজ করে বলতে হয়, তা না হলে গোটা বিষয় মিথ্যা বা বানোয়াট বলে সন্দেহ করা হবে। কিছু ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, সেটা গত জুলাই মাসে; সেগুলোকে কেউ পৃথিবীর অন্য কোনো ঘটনার সঙ্গে মেলাতে বা তুলনা করতে পারবে না। বিশ্বাস করো, ফিজিক্যাল সায়েন্সে এর দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ সত্যি নেই। এ রকম কোথাও মাত্র একবারই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।

ঢাকা শহরেই আমার আবাস, বাড়ি নম্বর..., মিল ব্যারাক, ফরিদাবাদ।  কিছু কিছু বিষয়ে কৌতূহল জাগায় আমার এই ঠিকানা। গত দুবছর হলো ভর করা জায়গা হিসেবে খ্যাতি-অখ্যাতি যা-ই বলো, উপভোগ করছে এই বাড়ি। ঘিঞ্জি এলাকার তুলনায় আকারে-প্রকারে এটা বিরাট, ফাঁকা যে বিস্তৃতি ওটাকে ঘিরে রেখেছে, সেখানে এককালে বাগান আর কৃত্রিম ঝরনা ছিল, কিন্তু এখন সেটা  লতানে গাছ দিয়ে আড়াল করা কাপড়ে রং লাগানোর প্রায় নোংরা একটা জায়গা মাত্র।

পুরোনো জমিদারবাড়ির মতো দেখতে, ভেতরেও প্রচুর জায়গা। মূল ফটক থেকে বেশ খানিক ভেতরে জোড়া সিংহমূর্তি বসানো গেট, তারপর উঁচু আর চওড়া বারান্দা, সেখান থেকে চৌকাঠ পেরোলেই ফুটবল খেলার উপযোগী বিরাট হলঘর। হলঘরের মাঝখান থেকে রাজকীয় ভঙ্গিমায় ওপরে উঠে গেছে একপ্রস্থ প্যাঁচানো সিঁড়ি। ওপরে প্রশস্ত করিডর, দুপাশে একাধিক কামরা নিয়ে একেকটা ইউনিট, আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট সিস্টেম। এটা ১৫-২০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছে, বানিয়েছিলেন জনাব আ...ঢাকার অত্যন্ত নামকরা একজন ব্যবসায়ী, যিনি বছর পাঁচেক আগে দেশে ও বিদেশে একের পর এক ব্যাংক জালিয়াতি করে বাণিজ্যিক জগতে তুমুল বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন।

জনাব আ, সবাই যেমন জানে, ইউরোপে পালিয়ে গিয়েছিলেন; এবং মন ভেঙে যাওয়ায় কিছুদিন পর সেখানেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবর দেশে পৌঁছাল এবং সেটা সত্যি কি না, তা যাচাইয়ের পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রটে গেল যে ২২/..., মিল ব্যারাক রোডের বাড়িটায় ভূত ভর করে আছে।

তারপর একসময় আদালত থেকে আদেশ পাওয়া গেল, মেরামত করার পর  বিক্রি কিংবা ভাড়া দেওয়া হবে ওটা, তা থেকে পাওয়া টাকা যতটুকু সম্ভব পরিশোধ করা হবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে। এদিকটা দেখার দায়িত্ব পেল একটা প্রাইভেট হাউসিং কোম্পানি। আইনের বিধিবিধান মেনে সাবেক মালিকের বিধবা স্ত্রীকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো, বাড়ির দেখাশোনার জন্য নিয়োগ পেল একজন কেয়ারটেকার আর তার স্ত্রী।

 বাড়িটায় ওঠার পর এই মানুষগুলো বলতে লাগ অস্বাভাবিক সব শব্দ খুব বিরক্ত করছে তাদের। কারও কোনা রকম দৃষ্টিগ্রাহ্য স্পর্শ ছাড়াই খুলে যাচ্ছে দরজা। আগে থেকে রয়ে যাওয়া বাড়িয় বিভিন্ন কামরার ফার্নিচার গভীর রাতে অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে একটার ওপর একটা চড়ে বসছে, তৈরি করছে বেঢপ স্তূপ। দিনের উজ্জ্বল আলোয় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ওঠা-নামা করে কে জানে কার অদৃশ্য পা, সঙ্গে থাকে অদৃশ্য সিল্ক কাপড়ের খসখস আওয়াজ—কাঠের চওড়া রেলিংয় ছঁুয়ে প্রায় উড়তে দেখা যায় শার্টের আস্তিন।

 কেয়ারটেকার আর তার স্ত্রী জানিয়ে দিল তারা আর এই বাড়িতে থাকবে না। হাউসিং কোম্পানির এজেন্ট হেসে ফেললেন, বিদায় করে দিলেন তাদের, তারপর তাদের বদলে নতুন লোকদের ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। তাতে আজব শব্দ আর অতিপ্রাকৃত কর্মকাণ্ড কিছুই থামল না, চলতে থাকল, আর এভাবে চলতে থাকায় এবার প্রতিবেশীরাও জেনে ফেলল বাড়িটায় আসলে কী ঘটছে। পর পর তিন বছর খালি পড়ে থাকল বাড়ি। কিছু লোক ভাড়া নিতে বা কিনতে এসেছে, কিন্তু আলোচনা শুরুর পর যেই তারা গুজব শুনেছে যে বাড়িটায় অশুভ কিছু ভর করে আছে, অমনি চুপচাপ কেটে পড়েছে।

আমি তখন পারগেন্ডারিয়া, বোম ভোলা নামে রাস্তার ধারের একটা মেসে থাকি। মেসটা পরিচালনা করেন সিতারা বেগম নামের এক নারী। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন শিশুসন্তান নিয়ে মহাবিপদে পড়েন তিনি, পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শুরু করেন নীরব বিদ্রোহ। তবে সেটা শুধু গতরে খেটে নয়। মানুষকে ভালোবাসেন তিনি, প্রতিদান হিসেবে ভালোবাসা গ্রহণ করেন। চেহারা আর আচরণে জননীসুলভ একটা কোমল দিক আছে, আমরা কিছু ছাত্র আর ভবঘুরে টাইপের প্রাণী তাঁর সেই ছায়ায় ভারি আরাম বোধ করি।

মেসটা রাস্তার ধারে হওয়ায় আমরা সারাক্ষণ শব্দদূষণ আর ধূলিদূষণের শিকার। কিন্তু সিতারা বেগমের হাতের রান্না এবং স্বর্গীয় আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না বলে অন্য কোনো মেসে চলে যাওয়ার কথা ভুলেও কেউ ভাবতে পারি না।

ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সিতারা বেগমই প্রথম ওই ভর করা বাড়ির খবর নিয়ে এলেন, প্রবল উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, সাহস করা গেলে আমরা ২২/..., মিল ব্যারাক রোড, ওনাদের ওই আস্তানা  নতুন মেস হিসেবে ভাড়া নিতে পারি। ঘটনাক্রমে তাঁর মেসের সদস্যরা দু-একজন বাদে সবাই সাহসী, সংগ্রামী এবং দার্শনিক টাইপের মানুষ; সে কথা মাথায় রেখেই তাদের সামনে ওই ভূতে ভর করা বাড়ি সম্পর্কে যা কিছু তিনি জানেন, সব প্রকাশ করলেন। দুজন বাদে আমরা সবাই তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম। রাজি হলেন না বরগুনার চাল ব্যবসায়ী মিজান মিয়া, যিনি তাঁর পালানো ছেলের পিছু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। রাজি হলেন না গাইবান্ধার অবসর পাওয়া সরকারি কর্মচারী করম চাঁদও, যিনি পুরোটা চাকরিজীবন ধরে খাওয়া ঘুষের টাকায় মানুষের উপকার হয়, এমন একটা কিছু করার তাগিদ অনুভব করছেন।

ভূতটুত থোড়াই কেয়ার করি, এ রকম একটা ভাব নিয়ে মাস শেষে সিতারা বেগমের পিছু নিয়ে ওই ভর করা বাড়িতে উঠলাম আমরা। ভাষায় আর আচরণে যত সাহসই দেখাই না কেন, একটা ভয় ভয় ভাব আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি ছিল। কাজটা কি ঠিক হলো? ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে বড় কোনো খেসারত দিতে হয় কিনা!

পয়লা মে ওনাদের আস্তানায় উঠেছি আমরা। নতুন আবাস আমাদের যেন জাদু করল। আমাদের বাড়ি, ২২/...-এর পেছনে চওড়া একটা রাস্তা আছে। ওটা আসলে বাঁধ, বুড়িগঙ্গাকে বেঁধে রেখেছে। বাড়ির পেছনে বাগান, তারপর বাঁধ আর নদী—ভারি সুন্দর খোলামেলা পরিবেশ। এমনকি দেখে মন ভরানোর মতো সবুজ ঘাস জন্মায় বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে থাকা কর্কশ বাগানও, যদিও কাপড় রং করার কাজ বাদেও ধোপারা নদী থেকে পানি এনে ময়লা কাপড় ধোয় ওখানে। গরমের দিন সন্ধ্যয় বাতাস খাওয়ার আর জ্বলজ্বল করতে থাকা জোনাকি দেখার আদর্শ একটা জায়গা।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাড়িটায় গুছিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে ভূত দেখতে পাব বলে আশা করলাম আমরা। প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি কখন বা কীভাবে তারা আসবে। রাতে খেতে বসে আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল সুপার ন্যাচারাল বা অতিপ্রাকৃত। এক মেস সদস্য  রাতেরঅশরীরীতৎপরতা নামে একটা বই কিনে সিতারা বেগমকে ব্যক্তিগত উপহার দিয়েছেন, মেসের প্রত্যেকে ওই ভদ্রলোককে জনগণের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে আরও বিশ কপি না কেনায়। এই বইটা যখন তিনি পড়েন, তাঁর নিন্দায় পরিপূর্ণ থাকে প্রত্যেকের হৃদয়, সন্দেহ করা হয় দুনিয়ায় যত রকমের খারাপ কাজ আছে, তার প্রায় সবই ইনি করেছেন বা করার মতো মানসিকতা রাখেন। তাঁর বিরুদ্ধে একটা এসপিওনাজ সিস্টেম চালু করা হলো। তিনি যদি ভুল করে হাতের বই রেখে ঘর থেকে বেরোন, তা সে যত কম সময়ের জন্যই হোক, সঙ্গে সঙ্গে সেটা ছোঁ দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন কোনো জায়গায়, সেখানে বাছাই করা কজন শ্রোতার উদ্দেশে চাপা গলায় পড়া হয়।

মেস সদস্যদের কাছে আমার গুরুত্ব বলা যায় রাতারাতি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, কারণ কৌশলে আমি তাদের জানার সুযোগ করে দিয়েছি যে সুপার ন্যাচারাল-বিষয়ক ইতিহাস নিয়ে আমার মোটামুটি পড়াশোনা আছে এবং একসময় আমি এক (অখ্যাত) পত্রিকায় একটা গল্পও লিখেছিলাম, যে গল্পের মূল চরিত্র ছিল এক ব্যাটা ভূত। 

ধরো, আমরা সবাই বড়সড় বৈঠকখানায় বসে আছি, এই সময় আলমারির দরজা বা একটা টেবিল থেকে যদি কোনো শব্দ বের হয় বা ওগুলো যদি নিজে থেকে একটু নড়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাঝখানে নীরবতা নেমে আসে, সবাই চেয়ারগুলোর নেচে ওঠা এবং ভৌতিক একটা আকৃতি দেখতে পাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হয়ে যায়। এক মাস এ রকম সাইকোলজিক্যাল উত্তেজনার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর চরম হতাশা আর অসন্তোষের সঙ্গে আমাদের স্বীকার করতে হলো যে অতিপ্রাকৃত কিছুর দেখা পাওয়ার ক্ষীণতম কোনো সম্ভাবনাও নেই এখানে।

ইয়াদ আলী আমাদের ফাইফরমাশ খাটে। হঠাৎ এক রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর মোম জ্বেলেছে সে। তার দাবি, খানিক পর সে যখন প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরছিল তখন অদৃশ্য একটা হাত তার মোমবাতি নিভিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তার এই দাবি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। কারণ, আমি জানি ইয়াদের চোখে কিছু সমস্যা আছে। প্রায়ই একটা মোমকে দুটো মোম দেখে সে। তার দৃষ্টিশক্তির এই ত্রুটি আরও এক ডিগ্রি বাড়তে পারে না, এমন তো নয়। যে লোক একটা জিনিসকে দুটো দেখে, উল্টো দেখাটাও তার পক্ষে সম্ভব হতে পারে—সে কোনো মোমবাতি নাও দেখতে পেতে পারে, তার হাতে একটা মোমবাতি থাকা সত্ত্বেও।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এমন একটা বিস্ময়কর এবং ব্যাখ্যার অতীত দুর্ঘটনা ঘটল যে আমি হকচকিয়ে গেলাম, আমার যুক্তিপ্রিয় মাথা ভোঁতা হয়ে এল।

সেদিন জুলাইয়ের ১০ তারিখ। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে, আমার বন্ধু তরুণ হোমিও ডাক্তার নিস্তার হায়াত আমাকে একরকম জোর করেই বাগানে নিয়ে এসে বসিয়েছে, উদ্দেশ্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে আঙুর খাওয়া। লাহোর না কোত্থেকে যেন তার ভাই এই আঙুর পাঠিয়েছেন, তা নাকি ১০ কিলোরও বেশি। ইতিমধ্যে প্রায় সবটুকুই স্বজনদের মধ্যে বিলি করা হয়ে গেছে, বাকিটুকু আমরা দুজন সদ্ব্যবহার করব।

নিস্তার জানাল, যতই ফলাও করে প্রচার করা হোক না কেন যে আঙুর ফল টক, আঙুর সম্পর্কে ওটাই শেষ বা আসল কথা নয়—আসল কথা, আঙুর খেলে নেশা হয়। তবে পরিমাণে একটু বেশি খেতে হবে।

নিস্তার আর আমি পরস্পরকে বেশ কয়েক বছর হলো চিনি। দুজন দুজনের প্রায় সব কথাই জানি আমরা। পরস্পরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব বোধ প্রচুর। ওর জ্ঞান শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রে সীমিত নয়, নিজে সমাজবিদ্যার ছাত্র হলেও জ্ঞানপিপাসায় কাতর আমিও।

তো সেদিন রাতে চাঁদের আলোয় বাগানে বসে দেদার আঙুর খাচ্ছি আর দার্শনিক কথাবার্তা বলছি: মানুষ সবাই কেন বরণ্যে হতে পারে না। সবাই না হোক, যারা প্রাতঃস্মরণীয় তাঁদের সংখ্যা হাজার বা লাখ গুণ বেশি নয় কেন? নবী হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু মাদার তেরেসা? মাদার তেরেসা হওয়া কঠিন, আবার কঠিন নয়ও—কঠিন এই জন্য নয়, মানুষের ভেতর পরের সেবা করার এবং আত্মত্যাগের প্রবণতা জন্মসূত্রেই আছে। ইচ্ছে করলে যে কেউ মাদার তেরেসা বা ও রকম কিছু হতে পারে।

নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকারে লাগতে পারলে ভালো লাগার বা তৃপ্তি বোধ করার স্বর্গীয় যে অনুভূতি জাগে, তার কোনো তুলনা নেই। আমাদের সমাজে দরিদ্র মানুষের সমস্যার কোনো শেষ নেই, তাদের উপকারে লাগাটা প্রত্যেকেরই ব্রত হওয়া উচিত, কিন্তু আমরা তা লাগছি না।

আঙুর খেলে নেশা হয়, এ আমিও শুনেছি, তবে সেদিনই প্রথম সেটা বুঝতে পারলাম। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করলাম শরীর গরম লাগছে, হাঁটার গতি নিজে থেকেই বেড়ে যাচ্ছে, মনে ভালো লাগার একটা অনুভূতি।

আমাদের আলোচনার বিষয় খানিক পর পর বদলে গেল। মিস্টিসিজমের প্রতি মানবমনের দুর্বলতা নিয়ে রসাত্মক আলোচনা হলো। যা কিছু ভয়ংকর, সারা বিশ্বের সব মানুষকেই তা টানে। এই সময় হঠাৎ করে নিস্তার আমাকে জিজ্ঞাস করল, ‘কোনটাকে তুমি সবচেয়ে বড় আতঙ্ক বলে মনে করো?’

প্রশ্নটা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিল। আমি জানি অনেক কিছুই মানুষের মনে মাত্রা ছাড়ানো আতঙ্ক ছড়ায়। এই যেমন অন্ধকারে একটা লাশের গায়ে কেউ যদি হোঁচট খায়, আমি যেমন একবার খেয়েছিলাম। একবার এক মহিলাকে ভরা বরষার সময় বুড়িগঙ্গার তীব্র স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছিলাম, উন্মত্তের মতো হাত-পা ছুড়ছেন, আকাশের দিকে তোলা বিকৃত মুখ থেকে যে আর্তনাদ বেরোচ্ছিল, ওখানে উপস্থিত আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়কে থেঁতলে দিচ্ছিল, কিন্তু পানি থেকে ৬০ ফুট ওপরের একটা জানালায় ভিড় করে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাঁকে বাঁচানোর জন্য কারও কিছু করার ছিল না। তাঁর আতঙ্ক আর প্রাণ রক্ষার ব্যর্থ প্রয়াস চেয়ে চেয়ে দেখাটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

আরেকবার একটা বিধ্বস্ত জাহাজকে সাগরে ডুবতে দেখেছিলাম। ওই জাহাজে কেউ বেঁচে আছে কি না, দেখা যাচ্ছিল না। সাগরে অস্থির, ভাসমান অবস্থায় ওটাকে দেখতে পাই আমরা। এত বড় একটা যাত্রীবাহী জাহাজ, অথচ প্রাণের কোনো চিহ্ন বা সাড়া নেই—চরম আতঙ্কজনক কিছুরই আভাস দেয়, যেটা আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

তবে এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, এই প্রথম, সবচেয়ে বড় ভয় বলে কিছু থাকতে পারে—আতঙ্কের রাজা, যার তুলনায় বাকি সব ভয় একদম তুচ্ছ।

কী হতে পারে সেটা? কোন পরিস্থিতিতে, কী শর্ত পূরণ করলে সে রকম একটা আতঙ্ক অস্তিত্ব পেতে পারে?

‘আমি স্বীকার করছি, নিস্তার,’ ডাক্তার বন্ধুকে বললাম, ‘বিষয়টা নিয়ে আগে কখনো ভাবিনি। কিছু একটা তো নিশ্চয় আছে। অনুভবে ধরা পড়বে বাকি সবগুলোর চেয়ে বেশি ভীতিকর। কিন্তু সেটা কী, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করতে রাজি নই আমি। আমি তার সংজ্ঞা জানি না।’

‘আমি অনেকটা তোমারই মতো, বুঝলে, ধরন,’ বলল নিস্তার। ‘হিন্দু তান্ত্রিকেরা শ্মশানে বসে পোড়া লাশের মুণ্ডু চিবায় বলে শুনেছি। আক্রোশের বশে মানুষ মানুষকে কল্পনার অতীত কষ্ট দিয়ে মারে, জ্যান্ত অবস্থায় তার হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে কুকুরকে খাওয়ায় বা নিজে খায়। এগুলো? না! আমার ধারণা আরও ভয়ংকর কিছু আছে।’

‘শোনো, নিস্তার,’ বললাম ওকে, ‘আমরা বরং প্রসঙ্গটা বাদ দিই এসো। এটা নিয়ে শুধু শুধু ভুগব আমরা...’

‘জানি না আজ রাতে কী হয়েছে আমার,’ বিড়বিড় করে জবাব দিল নিস্তার। ‘কিন্তু না চাইতেই আমার মাথায় শুধু উদ্ভট আর বিদঘুটে সব চিন্তাভাবনা চলে আসছে। মনে হচ্ছে, আজ রাতে আমি এমন একটা ভীতিকর গল্প লিখতে পারতাম, যা এর আগে কোনো লেখক লিখতে পারেননি, শুধু যদি ভাষার ওপর আমার খানিকটা দখল থাকত।’

‘বেশ, বুঝলাম; প্রসঙ্গটা ছাড়তে পারছ না। যাই তাহলে, শুয়ে পড়ি। আঙুরের রস দেখা যাচ্ছে সবার জন্য একই প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। আমি ভাবছি সমাজের কী করে ভালো করা যায়, আর তুমি পড়ে আছ আতঙ্ক নিয়ে। গুড নাইট, মাই ফ্রেন্ড।’

‘গুড নাইট, ধরন। প্রার্থনা করি ভালো ভালো স্বপ্ন দেখো।’

‘ধন্যবাদ, দোস্ত। তুমি ভূত, পেতনি, শাকচুন্নি, প্রেত আর অশান্ত আত্মাদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারো, এই প্রার্থনা করি...’

পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে বিছানায় উঠলাম আমি, অভ্যাস মতো সঙ্গে নিলাম একটা বই—যেকোনো বই হলেই হয়, চোখ বোলাতে বোলাতে ঘুমিয়ে পড়ি। বালিশে মাথা দিয়ে ওটা খুলতে যা দেরি, ছুড়ে ফেলে দিলাম ঘরের আরেক প্রান্তে।

বইটার নাম  হিস্ট্রিঅবমনস্টার, ফরাসি ভাষায় লেখা, ইংলিশ অনুবাদ। ওই মুহূর্তে আমার যে মানসিক অবস্থা, আমাকে সঙ্গ দেওয়ার সাধ্য ওই বইয়ের নেই। ভাবলাম চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করা যাক। ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মোবাইল ফোন নাগালের বাইরে, রিচার্জ হচ্ছে। চার্জারের লাল আলো খুব বেশি হলে ইঞ্চি তিনেক জায়গা আলোকিত রাখতে পারছে।

কয়েক মিনিট কাটল। ঘুম আসছে না। মরিয়া হয়ে চোখের ওপর হাত চাপা দিলাম, যেন অন্ধকারকেও বন্ধ করে দিতে চাইছি এবং চেষ্টা করছি কিছু না ভাবতে। বৃথাই। বাগানে নিস্তার যা বলেছে, সেগুলো আমি মাথা থেকে সরাতে পারছি না। ওগুলোর সঙ্গে লড়াই শুরু করেছি। ঠেকানোর জন্য বুদ্ধিমত্তাজাত দুর্গ তৈরি করলাম। কিন্তু তার পরও ওগুলো আমার দিকে ভিড় করে আসতে লাগল। একটা লাশের মতো পড়ে আছি বিছানায়, আশা করছি শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা মানসিক স্থিরতা ফিরিয়ে আনবে, এই সময় ভয়ংকর ব্যাপারটা শুরু হলো।

কিছু একটা পড়ল, আমার অন্তত তা-ই মনে হলো। পড়ল মাথার ওপরের ছাদ বা সিলিং থেকে। পড়ল আমার বুকে। পরমুহূর্তে আমি অনুভব করলাম হাড়সর্বস্ব দুটো হাত আমার গলা চেপে ধরছে, দম আটকে মেরে ফেলতে চাইছে আমাকে।

আমি কাপুরুষ নই। আমার শরীরও প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করে। হামলার আকস্মিকতা আমাকে স্তম্ভিত করার বদলে শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকে চরম উত্তেজিত করে তুলল। সবার আগে আমার ইন্সটিঙ্কটই মূল ভূমিকা নিয়ে ফেলল, অর্থাৎ ওটাই আমাকে চালিয়েছে, আমার আতঙ্কজনক অবস্থা ব্রেন উপলব্ধি করতে পারারও আগে। একপলকে পেশিবহুল আমার দুটো হাত ওই প্রাণীকে জড়িয়ে ধরল, আত্মরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে সবটুকু শক্তি দিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে পিষছি ওটাকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যে হাড়সর্বস্ব হাত দুটো আমার গলা টিপে ধরেছিল, সেগুলো একটু ঢিলে হলো, আবার আমি শ্বাস নিতে পারলাম। তার পরই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম তীব্র এক শারীরিক সংগ্রামে।

চারদিকে গভীর অন্ধকার। জানি না কোন শক্তির দ্বারা অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়েছি, সেটার ধরন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আমি, উপলব্ধি করলাম প্রতিমুহূর্তে আমার হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ওটা। বেরিয়ে যাচ্ছে আমার প্রতিপক্ষ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হওয়ার কারণে। আমার কাঁধ, ঘাড় আর বুক ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করছে। তার হাত শুধু হাড় বললেই হয়, থাকার মধ্যে আছে প্রচুর শিরা, চামড়া আর একগাদা টিস্যু, কিন্তু ওগুলো আসুরিক শক্তি ধারণ করে। প্রতিমুহূর্তে ওই হাতের টার্গেট হলো আমার গলা, আর আমি যদি ওই গলা বাঁচাতে না পারি, তাহলে এখানে এবং এখনই মারা যাব। এ এমন এক পরিস্থিতি, যখন প্রাণ বাঁচাতে হলে সবটুকু শক্তি, সাহস আর দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

অবিশ্বাস্য শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এবং মারাত্মক, প্রায় নীরব, ক্লান্তিকর ও জানবাজি সংগ্রাম শেষে আমি আমার প্রতিপক্ষকে প্রায় কাবু করে আনলাম। একবার ওটাকে হাঁটুর চাপে প্রায় গেঁথে ফেলার পর—চাপটা দিচ্ছি সম্ভবত তার বুকে—বুঝলাম আমি জিতছি। দম ফিরে পাওয়ার জন্য একটু বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। শুনতে পেলাম আমার শরীরের নিচে, অন্ধকারে, হাঁপাচ্ছে প্রাণীটা। অনুভব করলাম আমারটা ছাড়াও অন্য একটা হৃৎপিণ্ড প্রচণ্ড বেগে লাফাচ্ছে। ভাবসাবে মনে হলো, আমার মতোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। আমার জন্য সেটা বেজায়  স্বস্তিকরই বটে। এই সময় মনে পড়ল বালিশের তলায় সব সময় আমি একটা সিল্কের রুমাল রাখি। সঙ্গে সঙ্গে হাত ঢোকালাম। আছে ওটা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি ওই প্রাণীর হাত দুটো এক করে বেঁধে ফেললাম।

এখন আমি নিজেকে অনেকটাই নিরাপদ বলে মনে করতে পারছি। আলো জ্বালানো ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। দেখা দরকার মাঝরাতে কোন সে অতিথি আমার ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিজেকে নিয়ে সাামন্য হলেও গর্ব হচ্ছিল—আতঙ্ক আমাকে হাউমাউ করে কাঁদাতে পারেনি। ভয় পেয়েছিলাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙাইনি। এখনো আমি একাই শত্রুকে ধরে রাখতে চাইছি, কারও সাহায্য নিতে রাজি নই।

ওটাকে আমি শক্ত করে ধরে রেখেছি, মুহূর্তের জন্যও এতটুকু ঢিল দিইনি, নিতম্ব হড়কে বিছানা থেকে পা নামালাম মেঝেতে, টেনেহিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি আমার বন্দীকে। আমাকে মাত্র কয়েক পা হেঁটে সুইটবোর্ডের নাগাল পেতে হবে। এইটুকু দূরত্ব হেঁটে পেরোনোর সময় সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকলাম আমি, লোহার মতো শক্ত হাতে ধরে আছি তাকে। অবশেষে চার্জারের লাল আলোটার কাছে পৌঁছালাম, ওটার পাশেই বাল্ব জ্বালানোর সুইচ। আমার একটা হাত তাকে ছেড়ে দিল, বিদ্যুচ্চমকের মতো ক্ষিপ্র গতির সঙ্গে বোতামে চাপ দিলাম, আলোর বন্যায় ভরে গেল কামরা। ঘাড় ফিরিয়ে আমি আমার বন্দীর দিকে তাকালাম।

আলো জ্বালার পর মুহূর্তে আমার কী অনুভূতি হলো, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করব না আমি। আসলে আমার পক্ষে সেটা সম্ভবই নয়। সম্ভবত আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছি, আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছে আার গলা চিরে। কারণ, দেখলাম এক মিনিটেরও কম সময়ের ভেতর আমার ঘরে মেসের সব সদস্য ঢুকে পড়েছে। ওই মুহূর্তের কথা মনে পড়ায় এখনো আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি কিছু দেখিনি! একদম কিচ্ছু দেখতে পাইনি! হ্যাঁ, আমি আমার এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ছিলাম শ্বাসগ্রহণরত, স্পর্শযোগ্য একটা আকৃতিকে; আমার অপর হাত সবটুকু শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে এমন একটা গলা, যেটা আমার শরীরের মতোই উষ্ণ, অনুভবে মনে হচ্ছে মাংসল, ওটা নিজের শরীর আমার শরীরের সঙ্গে চেপে রেখেছে, অথচ তার পরও আমার ধরে থাকা এই জীবিত বস্ত্তকে চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি নিঃশর্তভাবে বলতে পারি, দৃশ্যমান কিছু আমি ধরে রাখিনি! একটা কাঠামোর রেখা পর্যন্ত নয়! নয় বাষ্পসুলভ কিছুও!

কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে পেলাম, সেটা আমি তখনো বুঝিনি, এমনকি এখনো বুঝতে পারি না। ওই হতবুদ্ধিকর ঘটনার সবটুকু আমি নিখুঁত মনে করতেও পারি না। অসম্ভব একটা ধাঁধার মতো লাগে, যার সঙ্গে দুনিয়ার অন্য কোনো ধাঁধার এতটুকু মিল নেই।

ওটার শ্বাসপ্রশ্বাস বইছিল। আমি আমার মুখে ওটার নিঃশ্বাস অনুভব করেছি। আমার সঙ্গে জান বাজি রেখে লড়েছে। হাত আছে ওটার। ওগুলো আঁকড়ে ধরেছে আমাকে। ওটার ত্বক মসৃণ, আমারই মতো। ওখানে ওটা পড়ে ছিল, আমার বুকের সঙ্গে সাঁটা, পাথরের মতো নিরেট। অথচ পুরোপুরি অদৃশ্য!

ভাবতে আমার সত্যি খুব অবাক লাগে যে সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারাইনি বা পাগল হয়ে যাইনি। নিশ্চয় ভারি চমৎকার কোনো ইন্সটিঙ্কট আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। তা না হলে ওই ভয়ংকর প্রতিপক্ষকে যেখানে ভয়ে আমার ছেড়ে দেওয়ার কথা, তা তো ছাড়িইনি, বরং আতঙ্কের মুহূর্তে শরীরে কোত্থেকে কে জানে প্রচণ্ড শক্তি চলে এসেছিল, সেই অতিরিক্ত শক্তির সাহাযে্য আমি ওটাকে আরও জোরে চেপে ধরি, অনুভব করি আমার কঠিন পেষণে যন্ত্রণায় ছটফট করছে ওটা।

ঠিক সেই মুহূর্তে ডাক্তার নিস্তার ঢুকল ঘরে। আমার মুখে তার চোখ পড়া মাত্র—নিশ্চয়ই সেটা আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছিল—এগোনোর গতি বেড়ে গেল, চেঁচানোর সময় গলার রগ ফুলে উঠল। ‘হায়, আল্লাহ, ধরন! কী ঘটছে এখানে?’

‘নিস্তার! নিস্তার!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘এদিকে এসো! ইশ্, এটা স্রেফ সম্ভব না! বিছানায় আমার ওপর হামলা...আমি আক্রান্ত হয়েছি...কী বা কিসের দ্বারা জানি না! কিন্তু ওটাকে আমি ধরে রেখেছি, যদিও কী ধরে রেখেছি দেখতে পাচ্ছি না!’

আমার মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে নিস্তারের ঘাবড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে এক কি দুই পা সামনে বাড়ল সে। নার্ভাস কিংবা বিব্রত বোধ করলে মানুষ যেভাবে কাঁপা কাঁপা একটু হাসে, সে রকম একটু হাসি বেরোল তার মুখ থেকে। ডাক্তারবন্ধুর এই চাপা হাসি আমাকে খেপিয়ে তুলল। আমার অবস্থায় থাকা একজন মানুষকে দেখে কেউ হাসতে পারে! এটা সবচেয়ে জঘন্যতম নিষ্ঠুরতা।

সেদিন বা তখনকার কথা আলাদা, আজ আমি বুঝতে পারি আমাকে দেখে যদি মনে হয় আমি বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছি এবং আত্মরক্ষার জন্য লোকজনের সাহায্য চাইছি, সেটা তো চরম হাস্যকরই লাগবে। তবে ওই সময় আমার রাগ এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছিল যে ক্ষমতা থাকলে ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই মাথায় বজ্রপাত ঘটিয়ে মেরে ফেলতাম।

‘নিস্তার! নিস্তার!’ মরিয়া হয়ে আবার আমি চেঁচাচ্ছি। ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার কাছে এসো। ওটাকে আমি আর কতক্ষণ ধরে রাখতে পারব জানি না। ওটার সঙ্গে আমি পারছি না...আমি হেরে যাচ্ছি! সাহায্য করো! আমাকে সাহায্য করো!’

‘ধরন,’ ফিসফিস করল নিস্তার, ‘তোমার এই অবস্থার জন্য একা শুধু আমি দায়ী। তোমাকে অত আঙুর খেতে দেওয়া...অনভ্যস্ত পেটে...একদমই উচিত হয়নি আমার।’

‘আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, নিস্তার, এটা কোনো স্বপ্ন নয়, আমি কোনো রকম ঘোরের মধ্যেও নেই।’ তার মতো আমিও নিচু গলায় কথা বলছি। ‘তুমি দেখতে পাচ্ছ না, ওটা ধস্তাধস্তি করায় আমার গোটা কাঠামো কেমন ঝাঁকি খাচ্ছে? আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, নিজেকে বিশ্বাস করাও। অনুভব করো ওটাকে, ছোঁও!’

ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে আমার দেখানো জায়গায় নিজের হাত রাখল নিস্তার। আহত পশুর মতো দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল তার গলা চিরে।

ওটার স্পর্শ পেয়েছে সে!

এক কি দুই সেকেন্ডের মধ্যে আমার ঘরের কোথাও থেকে লম্বা একপ্রস্থ শক্ত কর্ড জোগাড় করল নিস্তার, তারপর যত দ্রুত পারা যায় প্যাঁচের পর প্যাঁচ ঘুরিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল আমার সেই অদৃশ্য বন্দীকে, যাকে আমি এখনো শক্ত হাতে জাপটে ধরে রেখেছি।

‘ধরন,’ বলল নিস্তার, গলার স্বর কর্কশ, চেহারায় দিশেহারা  ভাব। উপস্থিত বুদ্ধি না হারালেও প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছে সে। ‘ধরন, পরিস্থিতি এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তুমি নিরাপদ। ক্লান্ত বোধ করলে এখন ওকে ছেড়ে দিতে পারো। ওটা নড়তে পারবে না।’

আমার ক্লান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, বাঁধনটা আমি খুশি মনে শিথিল করলাম।

যে কর্ড দিয়ে অদৃশ্য অস্তিত্বকে বাঁধা হয়েছে, সেটার শেষ প্রান্ত নিস্তারের হাতে, কবজিতে শক্ত করে প্যাঁচানো। তার অপর হাতে আরেক প্রস্থ লম্বা রশি রয়েছে, লেস দিয়ে বোনা, খালি একটা বিস্তৃৃতির চারদিকে টান টান হয়ে আছে।  বিস্ময়ের আঘাতে এতটা হতবিহ্বল হতে আগে কাউকে কখনো দেখিনি আমি, অথচ তার চোখে-মুখে ফুটে আছে সাহস আর দৃঢ়তা, যেগুলো তার ভেতর আছে বলে আগে থেকেই জানা ছিল আমার। তার ঠোঁট, যদিও রক্ত সরে যাওয়ায় সাদা হয়ে গেছে, পরস্পরের সঙ্গে নিরেট ভঙ্গিতে এক করা এবং একবার কেউ তাকালেই বলে দিতে পারবে আতঙ্কে অস্থিরতা বোধ করলেও সে তার আত্মবিশ্বাস হারায়নি।

মেসের বাকি সদস্যদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেশি হবে তো কম নয়। আমরা দুজন কী করছি না করছি, তারা সবাই তা চাক্ষুষ করছে এবং বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ঘটা মহাবিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য এবং হাজার কোটি টাকা মূল্যের একটা ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে।

আমরা, আমি আর নিস্তার, ধস্তাধস্তিতে মত্ত একটা ভূতকে, যে ভূত নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কর্ড দিয়ে বাঁধলাম। তারপর ক্লান্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে ওটাকে আমি ছেড়ে দিলাম। এই দৃশ্যের পুরোটা দেখার পর কোনো দর্শকের পক্ষে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। কেউ কেউ, যারা মনের দিক থেকে কিছুটা দুর্বল, দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে দিতে ঘর ছেড়ে পালাল। পরে শুনেছি, শুধু ঘর থেকে নয়, দু-একজন বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। প্রতিজ্ঞা করে গেছে, ভুলেও তারা আর কখনো এদিকে আসবে না।

অল্প দু-চারজন যারা দোরগোড়ায় ভিড় করে থাকল, তাদের কারও সাহস হলো না নিস্তার বা নিস্তারের হাতে বন্দী প্রাণীটার কাছাকাছি আসার। তার পরও তারা যতটা না আতঙ্কে অস্থির, তার চেয়ে বেশি অবিশ্বাসে অসুস্থ। নিজেদের সন্তুষ্ট করার জন্য যে সাহসের দরকার হয়, সেটা তাদের নেই, অথচ তারা সন্দেহে ভুগছে।

আমি ওদের ডাকলাম। বললাম কাছে এগিয়ে এসে দেখো, ছোঁও, বোঝার চেষ্টা করো, ঠিক কী ঘটছে এখানে। কিন্তু বৃথাই। যাচাই করার সাহস দেখাতে রাজি নয়, কিন্তু অবিশ্বাস করার অধিকার আছে বলে দাবি করবে! আমি বা নিস্তার অদৃশ্য একটা প্রাণীর সঙ্গে লড়ছি, এটা ওখানে উপস্থিত কাউকেই বিশ্বাস করানো গেল না। তারা বলতে চাইছে জ্যান্ত, নিরেট, শ্বাস নেয় এমন একটা শরীর কীভাবে অদৃশ্য হয়?

আমার উত্তর ছিল এ রকম: নিস্তারকে একটা সংকেত দিলাম আমি। তারপর আমরা দুজন একসঙ্গে, অদৃশ্য একটা জীবকে স্পর্শ করার ঘৃণা কাটিয়ে উঠে, মেঝে থেকে শূন্যে তুলে ফেললাম ওটাকে, তার ওই হাত আর সারা শরীর রুমাল ও রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থাতেই এবং বয়ে নিয়ে গেলাম আমার বিছানার দিকে। ওটার ওজন হবে ১৪ বছরের একটা কিশোরের মতো।

‘এবার আপনাদের আমি,’ ওদের বললাম, আমি আর নিস্তার বিছানার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছি অদ্ভুতুড়ে জীবটাকে, ‘নিরেট প্রমাণ দিতে পারব যে এখানে নিরেট, অস্থির একটা শরীরের অস্তিত্ব আছে, অথচ আপনারা সেটাকে দেখতে পাচ্ছেন না। দয়া করে বিছানার ওপর, অর্থাৎ চাদরের ওপর, সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।’

এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর একটা ঘটনাকে এতটা প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে কীভাবে সামলাতে পারলাম, ভাবতে গেলে নিজেরই এখন অবাক লাগে। তবে বিস্ময়, অবিশ্বাস আর আতঙ্কের প্রাথমিক ধাক্কা খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে আমি একটা বৈজ্ঞানিক গর্ব খুঁজে পেয়েছি, ওটাই বাদ-বাকি সমস্ত অনুভূতিকে ম্লান করে দিয়েছে।

বিমূঢ় দর্শকদের চোখ সঙ্গে সঙ্গে আমার বিছানার ওপর স্থির হলো। আগে থেকে ঠিক করা সংকেত অনুসরণ করে নিস্তার আর আমি জীবটাকে বিছানার ওপর শূন্যে ছেড়ে দিলাম। নরম গদিতে ভারি কিছু পড়ার ধপ মতো একটা আওয়াজ হলো। খাটের কাঠ ক্যাচক্যাচ করে উঠল। বালিশের ওপর স্পষ্ট ফুটে উঠল একটা গর্তের আকৃতি, সেটার  লম্বাটে সংস্করণ বিছানার ওপরও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দর্শক যারা দৃশ্যটা চাক্ষুষ করল, তাদের গলা থেকে চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল, লাফ দিয়ে কামরার সামনে থেকে পালিয়ে গেল তারা। মীমাংসার অযোগ্য রহস্যটা নিয়ে আমি আর নিস্তার একা রয়ে গেলাম কামরার ভেতর।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম দুজন। বিছানায় পড়ে থাকা প্রাণীটার নিস্তেজ ও অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস শুনছি। দেখতে পাচ্ছি চাদরের টান টান হওয়া আর ভাঁজ খাওয়া—নিজের বন্দিত্ব ঘোচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে ওটা।

তারপর নিস্তার বলল, ‘ধরন, এটা কোনো ধরন হলো না।’

‘না, হলো না,’ উত্তর দিলাম, দুজনের কেউই ওর কথাটাকে কৌতুক হিসেবে নিইনি আমরা।

‘তবে চিন্তা বা কল্পনার অতীত কিছু নয়।’

‘কল্পনার অতীত কিছু নয়! কী বলতে চাও তুমি? দুনিয়ার জন্ম হওয়ার পর থেকে এ রকম কিছু কখনোই ঘটেনি। কী ভাবব, আমার জানা নেই, নিস্তার। আল্লাহ সাক্ষী যে আমি পাগল নই এবং এটা বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো ফ্যান্টাসি নয়!’

‘এসো ধরন, খানিকটা যুক্তির পথে থাকি,’ বলল নিস্তার।

আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সুরে বললাম, ‘এটা আমরা যুক্তিসিদ্ধ কোনো সমস্যার মধ্যে পড়িনি কিন্তু!’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, তোমার কথা মেনে নিচ্ছি আমি। আমাদের এই সমস্যা যুক্তি দিয়ে মীমাংসা করা যাচ্ছে না। ফ্যাক্ট এখানে এতটাই অস্বাভাবিক যে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কিছু কি নেই? এর সমকক্ষ বা সমান্তরাল? নির্ভেজাল এক টুকরা কাচ নাও। ওটা স্পর্শযোগ্য ও স্বচ্ছ। নির্দিষ্ট একটা রাসায়নিক কর্কশতাই শুধু ওটাকে পুরোপুরি স্বচ্ছ হতে দেয় না, যে কারণে ওটা পুরোপুরি অদৃশ্য নয়। তত্ত্বগত দিক থেকে এটা অসম্ভব নয়, মনে রেখো তুমি, এমন কাচ বানানো সম্ভব, যেটার অ্যাটমগুলো এত খাঁটি যে সূর্যের আলো ওটাকে ভেদ করে যাবে ঠিক যেভাবে বাতাসকে ভেদ করে যায়, বেঁকে যাবে, কিন্তু প্রতিফলিত হবে না। আমরা তো বাতাসকে দেখতে পাই না, কিন্তু তার পরও ওটাকে অনুভব করি।’

‘ভালো কথা, নিস্তার, তোমার কথা বুঝলাম, কিন্তু এগুলো জড় পদার্থ, প্রাণহীন বস্ত্ত। কাচ শ্বাস নেয় না। এই জিনিসটার একটা হৃৎপিণ্ড আছে, যেটা ব্লাড পাম্প করছে; আছে ইচ্ছাশক্তি, যার সাহাযে্য নড়াচড়া করতে পারছে; আছে ফুসফুস, যেটা অক্সিজেন গ্রহণ করছে; আছে একটা মন, যেটা অনুপ্রাণিত হয়, ভয় পায়, বাঁচতে চায়।’

‘তুমি একটা বিচিত্র ধারণার কথা ভুলে যাচ্ছ, যেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আমরা বিস্তর আলোচনা করেছি,’ বলল ডাক্তার, থমথম করছে চেহারা, গলার স্বর গম্ভীর। ‘বৃত্তের ভেতর আত্মাদের ডেকে আনার যে আসর বসানো হয়েছিল, তুমিও শুনেছ, অদৃশ্য হাত ঢুকে গেছে টেবিলে উপস্থিত লোকজনের হাতের ভেতর—উষ্ণ, মাংসল হাত, যে হাতে পালস পাওয়া গেছে, যে হাত জ্যান্ত প্রাণীর অংশবিশেষ।’

‘কী? তুমি কি ভাবছ এই জিনিসটা তাহলে...’

‘এটা কী, তা আমি জানি না,’ জোর দিয়ে বলল ডাক্তার নিস্তার, ‘তবে খোদার কসম খেয়ে বলছি, এটা সম্পর্কে জানতেই হবে। তোমার সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। এটাকে নিয়ে আমরা পুরোদস্ত্তর তদন্ত আর গবেষণা চালাব।’

বিছানার কিনারায় বসে সারা রাত ওটার ওপর নজর রাখলাম আমরা। ঘুম তাড়ানোর জন্য কখনো চা, কখনো কফি, আবার দু-একবার ধূমপানও করা হলো। নিজেকে বাঁধনমুক্ত করার জন্য চাদরের ওপর মোচড় খেতে লাগল ওটা, আমরা তার হাঁপানোর শব্দ শুনতে পেলাম। রাত যত বাড়ল, ততই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে, একসময় নিজের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি থেমে গেল। নিচু, নিয়মিত নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম ঘুমিয়ে পড়েছে।

ফিস ফিস করে ডাকলাম, ‘নিস্তার!’

চোখ মেলল ডাক্তার। ‘সরি। তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।’

‘সে তো আমারও আসতে পারে। আমি তোমাকে জাগালাম, সে রকম তুমিও আমাকে জাগাবে, ঠিক আছে?’

আমার দিকে ভালো করে তাকাল নিস্তার। ‘কী ব্যাপার, ধরন, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি?’

‘তোমার প্রশ্নটা এমন, যেন ভয় একা শুধু আমি পাচ্ছি!’

হেসে ফেলল ডাক্তার। ‘ডাকলে কেন?’

‘তুমি কী বলো? আমি বলি, এটা মানুষ নয়।’

‘জিনটিন?’

‘আমরা কেউ ছ্যাঁকা খাইনি।’

‘তুমি কী বলো?’ আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘হয়তো অন্য কোনো জগতের, তবে মানুষই। ওদের জগতের সবাই নিশ্চয় সবাইকে দেখতে পায়, সম্ভবত অন্য জগতের কাউকে দেখতে পায় না, অন্য জগতের প্রাণীরাও হয়তো ওদের দেখতে পায় না।’

‘তুমি বলতে চাইছ ও আমাদের দেখতে পাচ্ছে না?’ মাথা নেড়ে দ্বিমত পোষণ করলাম। ‘সিলিং থেকে লাফ দিয়ে আমার বুকে পড়েছিল ওটা, পড়েই আমার গলা টিপে ধরেছিল। দেখতে না পেলে কীভাবে তা সম্ভব, বলো?’

‘তাহলে দেখতে পায়,’ দ্বিধা নিয়ে বলল নিস্তার। ‘হয়তো আবছা বা অস্পষ্টভাবে। কিংবা হয়তো তাপ অনুভব করে মাত্র, সত্যি সত্যি দেখতে পাায় না। আমি বলতে চাইছি, ওটার চোখ নাও থাকতে পারে।’

‘তোমার তাহলে ধারণা, আমাদের জগতের ভেতর বা পাশাপাশি আরেকটা জগৎ? প্যারালাল ইউনিভার্স?’

‘অসম্ভব কী! বিশেষ করে বিজ্ঞানীরা ইদানীং যেখানে বহু বিশ্বের সম্ভাবনার কথা এত জোর দিয়ে বলছেন। বিগ ব্যাং নাকি অহরহ ঘটে চলেছে, একটার পর একটা। মহাবিশ্বের ভেতর মহাবিশ্ব, তৈরি হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে—আল্লাহর দোহাই লাগে, যদি কিছু মনে না করেন!’

‘ওটা প্রাণী, ঠিক আছে, কিন্তু মানুষ কি না?’ আবার আমি আমার প্রথম প্রশ্নে ফিরে এলাম।

‘সেটা আমরা একটু চেষ্টা করলেই জেনে নিতে পারি।’

‘ছুঁয়ে দেখো, আকৃতিটা আমাদের মতো কি না?’

‘হুঁ।’

বললাম, ‘ওটা কি আমাদের ভাষা বুঝতে পারছে?’

‘মনে হয় না। অন্য কোনো জগতের প্রাণী হলে ভাষা আলাদা হতে বাধ্য। তবে ওর ভাষাটা কী বা কেমন, বলা যাচ্ছে না।’

‘যেহেতু ও সে রকম কোনো শব্দ করেনি?’

‘হ্যাঁ।’

‘এমন কী হতে পারে যে ওটা বোবা?’ প্রশ্ন তুললাম আমি। ‘এবং অ্যাবনরমাল? আর হয়তো অ্যাবনরমাল বলেই নিজের জগৎ ছেড়ে আমাদের জগতে চলে আসতে পেরেছে?’

নিস্তার কিছু বলল না। ঘাড় তুলে তাকাতেই দেখলাম, চোখ বুজে ঢুলছে সে।

‘ডাক্তার!’

চোখ মেলল নিস্তার, লজ্জাটে একটু হেসে নড়েচড়ে বসল, তারপর হাত বাড়াল কফিভর্তি ফ্ল্যাস্কের দিকে।

পরদিন সূর্য ওঠারও আাগে জেগে গেল আমাদের মেসবাড়ির সব লোকজন। আমার কামরার বাইরে, সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে, ভিড় জমাল তারা। কাল রাতের পর সিতারা বেগমকে আমরা কেউ দেখিনি। শুনলাম, গভীর রাত থেকে নামাজ-পাটিতে বসে আছেন তিনি, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করছেন নিজের, নিজ সন্তানদের এবং মেস সদস্যদের কারও যেন কোনো ক্ষতি না হয়। পরহেজগার নারী তিনি, তাঁর কাছ থেকে আমরা এ রকমটিই আশা করি।

ল্যান্ডিংয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের সামনে নিস্তার আর নিজেকে অসম সাহসী সিংহ বলে মনে হলো আমার। আমাদের মহাবিস্ময়কর বন্দী কেমন আছে, এ-সংক্রান্ত এক হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। কারণ, আমরা দুজন ছাড়া কাল রাত থেকে আমার ঘরে ওরা কেউ ভুলেও পা ফেলেনি। এখনো তারা ওদিকে পা বাড়াতে রাজি নয়।

মহা বিচিত্র ওই জীব জেগে আছে। এটার প্রমাণ পাওয়া গেল চাদর কুঁচকে যাওয়ায়, টান আর ভাঁজ পড়ায়; পালানোর চেষ্টায় করছে ওটা। এ রকম একটা দৃশ্য চাক্ষুষ করা সত্যিকার রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা—আবার দেখতে পাচ্ছি সেই পুরানো কাণ্ড—নিজেকে মুক্ত করার জন্য ছটফট করছে ওটা, যতটুকু পারা যায় শরীরটাকে মোচড়াচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, অথচ এত সব কে করছে, তা আমাদের জানা নেই।

আমি আর নিস্তার রাত জাগার সময়টা কাটিয়েছি একটা বুদ্ধি পাওয়ার চেষ্টায়, কী করলে বুঝতে পারব ওটার আকৃতি, আন্দাজ করা যায় কেমন দেখতে ওটা। অদৃশ্য শরীর যতটা সম্ভব স্পর্শ করে আঁচ পাওয়া গেছে আকৃতিতে ওটা মানুষের মতোই, অন্তত বাইরের কাঠামোর দিক থেকে। তার একটা মুখ আছে, আছে গোলাকার ও মসৃণ মাথা, সেখানে কোনো চুল নেই; একটা নাক, মুখের ওপর দিকে একটু উঁচু মতো, অর্থাৎ খাড়া কিছু নয়, বরং বেশ চ্যাপ্টাই; আর তার হাত দুটো যেন একটা ছেলের।

প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম জ্যান্ত ওই অস্তিত্বকে একটা মসৃণ সারফেসে শোয়ানো হবে, তারপর চক ব্যবহার করে তার কিনারার দাগ নেব, জুতা তৈরি করতে মুচি যেমন পায়ের দাগ নেয়। এর কোনো মূল্য নেই বুঝতে পেরে এই প্ল্যান আমরা বাতিল করে দিই। এ রকম আউটলাইন আমাদের ওটা সম্পর্কে নিশ্চিত বা নিখুঁত কোনো ধারণা দেবে না।

মনে আনন্দ জাগার মতো একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মনে। প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহার করে আমরা ওটার একটা সঠিক আকৃতি পেতে পারি। আমরা নিরেট একটা মূর্তি পাব, তাতে আমাদের সমস্ত কৌহূহলও মিটবে বলে আশা করা যায়।

কিন্তু কাজটা করা যায় কীভাবে? ওটার হাত-পা ছেঁড়ার কারণে প্লাস্টিক আবরণ বারবার সরে যাবে, ফলে ছাঁচটা থোবড়ানো কিংবা ত্যাড়া-বাঁকা হবে। আরেকটা চিন্তা: আমরা ওটাকে ক্লোরোফর্ম দিই না কেন? শ্বাস গ্রহণ আর শ্বাস ত্যাগের নিজস্ব সিস্টেম আছে ওটার, নির্দিষ্ট অঙ্গসমূহের মাধ্যমে তা সচল থাকে, আমরা তাকে হাঁপাতে শুনে তার প্রমাণ পেয়েছি। সেগুলো একবার সাময়িক অচল করে দেওয়া গেলে ওটাকে নিয়ে যা করার অনায়াসে করতে পারব আমরা।

ডাক্তার খ-কে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠানো হলো। আজকাল কল দিয়ে ডাক্তার পাওয়ার আশা পাগলরাও করে না, তবে ডাক্তার খ-র ব্যাপারটা আলাদা—প্রথমত তিনি ডাক্তার নিস্তারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, দ্বিতীয়ত ভদ্রলোক ঢাকায় সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন, এখনো তেমন জমিয়ে তুলতে পারেননি।

 চৌকস ডাক্তার খ বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করার প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করলেন। আরও তিন মিনিট পর অবিশ্বাস্য প্রাণীটির শরীর থেকে আমরা বাঁধনগুলো খুলে নিতে পারলাম। এক লোককে নিয়োগ করা হলো, সে অত্যন্ত দ্রুত হাতে অদৃশ্য অস্তিত্বের সারা গা ভেজা ভেজা সাদা কাদা দিয়ে মুড়ে ফেলল। পরবর্তী পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা একটা ছাঁচ পেয়ে গেলাম এবং সন্ধ্যার আাগে পেয়ে গেলাম রহস্যের প্রায় হুবহু একটা প্রতিরূপ। মানুষের আকৃতিই বটে—কিছুটা বাঁকা-ত্যাড়া, কর্কশ এবং ভীতিকর, কিন্তু তবু একটা মানুষই।

সে খুব ছোট, চার ফুট কয়েক ইঞ্চি মাত্র। কিন্তু তার হাত-পা খুবই মোটাতাজা, পেশিবহুল, সন্দেহ নেই প্রচণ্ড শক্তি ধরে। তার মুখের আদল এতটাই কুৎসিত যে সেদিকে তাকালে আমার গায়ের রোম সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল। কারও চেহারা এমন থোবড়ানো আর গর্তবহুল হতে পারে বলে কল্পনা করা যায় না। আমার বিশ্বাস, কোনো সুস্থমস্তিষ্কের শিল্পীকে দিয়ে এ রকম একটা কদর্য মুখ আঁকানো কখনো সম্ভব হবে না। আমার ঠিক জানা নেই, লাশখেকো পিশাচেরা সম্ভবত এ রকমই দেখতে হয়!

আমাদের কৌতূহল মেটার পর, ইতিমধ্যে মেসবাড়ির প্রত্যেককে গোপনীয়তা বজায় রাখার কিরে-কসম খাওয়ানো হয়েছে, প্রশ্ন দাঁড়াল: এই জীবিত ধাঁধাকে নিয়ে কী করা হবে? আমরা আমাদের বাড়িতে এ রকম একটা আতঙ্ক পুষব বা পালব, এটা সম্ভব নয়। একই রকম অসম্ভব একটা অশুভ অস্তিত্বকে দুনিয়ার বুকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া। স্বীকার করছি, ভোটাভুটির ব্যবস্থা করা হলে ওটাকে ধ্বংস করার পক্ষে ভোট দিতাম আমি। কিন্তু দায়িত্বটা কে নেবে? মানুষের সঙ্গে ভীতিকর রকমের মিল থাকা এই প্রাণীকে হত্যা করার দায় কে নিজের কাঁধে নিতে চাইবে? যত দিন যাচ্ছে, ততই প্রকট হয়ে উঠছে প্রশ্নটা, পরিস্থিতি হয়ে উঠছে আরও থমথমে। মেস ছেড়ে চলে গেল সবাই। সিতারা বেগম দিশেহারা হয়ে উঠলেন। আমাকে আর নিস্তারকে একরকম হুমকি দিয়েই তিনি বললেন, মূর্তিমান এই আতঙ্ককে বাড়ি থেকে আমরা যদি বিদায় না করি, আমাদের বিরুদ্ধে আইনগত কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, উকিলকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হবেন তিনি।

জবাবে আমরা তাঁকে বললাম, ‘আপনি চাইলে আমরা চলে যাব, কিন্তু ওই জীবটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব না। যদি ইচ্ছে হয় আপনি বিদায় করুন। আপনার ভাড়া করা বাড়িতে নিজের ইচ্ছায় উঠেছে ওটা। আমরা নিয়ে আসিনি। দায়-দায়িত্ব সব আপনার ওপরই চাপে।’

আমাদের জবাব শুনে, বলাই বাহুল্য, একদম চুপ করে গেলেন সিতারা বেগম। টাকা হোক বা ভালোবাসা, কিছু দিয়েই কাউকে তিনি ওই বিকট রহস্যের কাছাকাছি যেতে রাজি করাতে পারবেন না।

গোটা ব্যাপারটার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, ওই প্রাণী কী খেতে অভ্যস্ত? খাবার জিনিস সম্ভাব্য যত রকম হতে পারে, তার প্রায় সবই ওটার সামনে পরিবেশন করা হয়েছে, কিন্তু ভুলেও একবার  ছঁুয়ে দেখেনি। দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকে এটঠ দেখা খুবই পীড়াদায়ক যে শুধু কাপড় নড়াচড়া করে, এটা শোনা যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওটার এবং এটা জানা যে তার পেটে একটা দানা পর্যন্ত পড়ছে না।

১০ দিন কাটল, তারপর ১২ দিন। পুরো দুই সপ্তাহ। কিন্তু তার পরও বেঁচে থাকল ওটা। তবে টের পাচ্ছিলাম হৃৎস্পন্দন প্রতিদিনই ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে। তারপর একসময় প্রায় থেমে এল। এটা  আমরা পরিষ্কারই বুঝতে পারছিলাম প্রাণীটা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে মারা যাচ্ছে। এ রকম একটা ভয়ংকর জীবনযুদ্ধ চলার সময় আমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। আমি ঘুমাতে পারি না। যতই কুৎসিত হোক, দেখে যতই গা ঘিন ঘিন করুক, মানুষ আকৃতির ওই প্রাণী যে ভোগান্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা চোখে দেখে সহ্য করার মতো নয়।

অবশেষে মারা গেল বেচারি। আমি আর নিস্তার এক সকালে ওটাকে বিছানার ওপর ঠান্ডা আর অড়ষ্ট অবস্থায় পেলাম। যেহেতু কিছু মুখে দেবে না, কাজেই আমি বলব মরে গেছে ভালোই হয়েছে। তার হৃৎপিণ্ড থেমে গেছে, ফুসফুসে কোনো শক্তি নেই। আমরা খুব তাড়াহুড়ো করে বাগানে ওটাকে কবর দিলাম। বড় অদ্ভুত একটা অন্তে্যষ্টিক্রিয়া ছিল সেটা, দেখা যায় না এমন একটা লাশকে ভেজা গর্তে ফেলে দেওয়া। ওটার আকৃতির ছাঁচটা আমি ডাক্তার খ-কে দিয়ে দিয়েছি, ওটা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ মিউজিয়ামের জন্য সংরক্ষণ করবেন।

(বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে)