একটা ভাইরাস আর একটা বোনরাস

আম্মুটা না খুব বোকা ছিল, জানো। এটা করো, ওটা করো শুনতে শুনতে আমার ইরিটা ঝালাপালা। প্রতিদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই রাগী রাগী গলায় বলত, ‘যাও, এক্ষুনি টিটথু ব্রাশ করো।’

এই যাহ্‌। বলতে তো ভুলেই গেছি। তোমরা কি আর ইরিটা, টিটথু এসব বুঝবে? ইরিটা মানে হচ্ছে কান। আর টিটথু, উমমম, তোমরা যে ওটাকে কী বলো, মনেই পড়ছে না। কী যেন, কী যেন, ওহ হ্যাঁ, দাঁত। টিটথু মানে দাঁত। আমাদের এখানে বড় বড় বিলবোর্ডে লেখা থাকে: যদি করে টিটথু ব্রাশ, তোমরা হবে ফাস্টো কেলাশ। মানে ফার্স্ট আর কি।

আমাদের এখানে টিটথুর খুব গুরুত্ব, জানো। টিটথুই আমাদের সব। এই যাহ্‌, বলতে বলতে আমার দাঁতগুলো কেমন জানি শিরশির করছে। কিছু মনে কোরো না। ‘আননেসেসারি’ লেখা ফোল্ডারটায় এক্ষুনি একটা কামড় বসাতে হবে। আর পেটেও কেমন ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি তো। আচ্ছা, একটু ওয়েট করো। আমি এক্ষুনি ফোল্ডারটায় একটা কামড় বসিয়ে আসি, কেমন?

তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ পাতা উল্টিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছ দেখছি। আমি তো মাত্রই ছুটে গিয়ে দুটো কামড় বসিয়েই চলে এলাম। আরে বাবা, এত ধৈর্য কম হলে চলে! এই কথাটা না আমার মা-ও খুব বলত, জানো। আমি তো ছোটবেলায়... মানে এখনো আমি অনেক ছোটই। বয়স মাত্র ৬ কিরিকুশ। কিরিকুশ মানে হচ্ছে মাস।

তো আমি যখন আরও ছোট ছিলাম, খুব দুষ্টু আর দুরন্ত ছিলাম। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করতাম। এই ফোল্ডার থেকে ওই ফোল্ডার। এই ড্রাইভ থেকে ওই ড্রাইভ। মা এ জন্য খুব বকা দিত। আমাদের আবার সব জায়গায় যেতে নেই।

কিছু কিছু জায়গা আছে আমাদের জন্য খুব বিপদের। এ জন্যই তো আমাদের ফোল্ডারের ভেতরের সাব-ফোল্ডার, তার ভেতরের ফোল্ডার, তার ভেতরের সাব-ফোল্ডার... মানে যত বেশি ভেতরে থাকা যায়, ততই মঙ্গল।

আমরা থাকি কম্পিউটারের ভেতরে। কম্পিউটার হলো আমাদের দেশ। ইন্টারনেটের জগৎটা হচ্ছে আমাদের জন্য পৃথিবী। আর পেনড্রাইভ হচ্ছে আমাদের জন্য ধরো একটা বিমান। ছোট মেমরির পেনড্রাইভ হলে ওটাকে বাস-মিনিবাসও ভাবতে পারো।

একবার তো কী হয়েছে বলি। আমার এক বন্ধু, কিটকুশ নাম। কিটকুশ নাম শুনলে মনে হতে পারে সারাক্ষণ বুঝি কুটুশকুটুশ করে ফাইল বা ফোল্ডারে কামড় বসাচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়।

ও ঘাপটি মেরে বসে ছিল ‘সি’ ড্রাইভের মাই ডকুমেন্টস ফোল্ডারে। যে পিসিটায় আমরা ছিলাম, ওই পিসির অ্যান্টিভাইরাসটার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তো সেই পিসির ইউজার যেই না একটা পেনড্রাইভ ঢোকাল, ওমনি ও লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ল সেই পেনড্রাইভে। ও নিজেকে খুব দ্রুত কপি করে ছড়িয়ে দিতে পারত। বিশেষ করে পেনড্রাইভে। ওর আবার ঘোরার খুব শখ। কিন্তু হলে কী হবে, যতই তুমি হদ্দমদ্দ ঘুরে বেড়াও, ঘরে তো ফিরতেই হবে।

কদিন ধরে কিটকুশের আবার ঘুম হয়নি। পেনড্রাইভে ঢুকে একটা নরম-সরম ফোল্ডার পেয়ে দিয়েছে এক ঘুম। ফেরত আসতে পারেনি। ততক্ষণে রিফাত ভাইয়া পিসি থেকে পেনড্রাইভ রিমুভ করে নিয়েছে। রিফাতকে ভাইয়া বলে ডাকছি বলে তাকে আবার আমাদের ভাই বলে ভেব না। রিফাত ভাইয়া আসলে রাইসামণির ভাই।

এই যে, যে ল্যাপটপটায় আমরা আছি, যে ল্যাপটপটা এখন আমাদের ঘর, সেটার মালিক আসলে রাইসা। কিন্তু ও তো কম্পিউটারের সবকিছু বোঝে না। কোনো গান-মুভির দরকার হলে রিফাত ভাইয়াকে বলে। রিফাত ভাইয়া পেনড্রাইভে করে এনে দেয়।

এমনই এক পেনড্রাইভে করেই তো কিটকুশটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ও যে এখন কোথায় আছে কে জানে! হয়তো অপেক্ষায় আছে, আবার এই পিসিতে রিফাত ভাইয়া পেনড্রাইভ ঢোকালে আবার ঘুপুৎ করে লাফ দিয়ে চলে আসবে। তখন খুব মজা হবে। ওকে বলার জন্যে কত কথা আমার পেটলুতে জমা হয়ে আছে!

ইয়ে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ। হ্যাঁ, বলতে একটু লজ্জা লজ্জাই লাগছে। আমি আসলে একটা ভাইরাস। তবে আমরা কিন্তু খুব খারাপ ভাইরাস নই। ভাইরাস তো তোমরা জানোই। আমরা একধরনের প্রোগ্রাম। অনেকে অন্যের ক্ষতি করার জন্য ভাইরাস বানায়। প্রোগ্রামাররা। আবার অনেকে মজা করার জন্যও কিছু কিছু মজার ভাইরাস বানায়।

আমি যেমন কোনো ক্ষতি করি না। শুধু মাঝেমধ্যে কোনো ফোল্ডার বা ফাইলের নাম পাল্টে দিই। খুব মজা লাগে। কেউ হয়তো ‘সং’ নামে কোনো ফোল্ডার বানাল, আমি চুপটি করে সেই ফোল্ডারের নাম পাল্টে দিলাম ‘মুভি’। খুব মজা লাগে তখন। হিহিহি।

বুঝতেই পারছ, আমরা অন্তত মানুষের দেহে রোগ-জীবাণু ছড়ানোর সেই ভাইরাস নই। ইদানীং ইন্টারনেটে ঢুকলেই দেখি ইবোলা না অবলা কী এক ভাইরাসে মানুষের সে কী কষ্ট! কত কত মৃত্যু! সেসব পড়ে আমারও মন খুব খারাপ হয়, জানো! কত মা সন্তান হারাচ্ছে! কত সন্তান মা হারাচ্ছে।

মা হারানোর কষ্ট কি আর আমি বুঝি না। আমিও তো তোমাদের আমার মায়ের গল্পই বলছিলাম। ওই যে, আমাদের খুব বকাঝকা করতেন। বলতেন, প্রতিদিন টিটথু ব্রাশ না করলেন না সব টিটথু পড়ে যায়। আচ্ছা, আমার দাদু তো রোজ টিটথু ব্রাশ করতেন। তবে তাঁর দাঁত পড়ল কেন? আম্মুটা না আসলেই বোকা ছিল।

তোমরা হয়তো এরই মধ্যে খেয়াল করেছ, আমি আমার মায়ের ব্যাপারে যা কিছু বলছি, সবই পাস্ট টেনসে, অতীতকালে। কারণ আম্মু এখন আমাদের কাছে অতীত! তখন আমি খুব ছোট। সে সময় এই পিসিতে একটা অ্যান্টিভাইসার ইনস্টল করা হয়। তা দিয়ে স্ক্যান করতেই বড় ভাইরাসগুলো ধরা পড়ে। জালের মতো করে ছেঁকে ছেঁকে সব ভাইরাস ধরে নিয়ে যায় সেই অ্যান্টিভাইরাস দৈত্যটা। আর সে কী কলজে পানি করে দেওয়া ক্রূর হাসি হাসে! হু হু হি হি হা হা।

বেঁচে যাই শুধু আমরা ছোটরা। আমি, কিটকুশ আর ইরিকা। ইরিকা হলো আমার বোন। ওর বয়স ৪ কিরিকুশ। আমার চেয়ে দুই কিরিকুশ ছোট। খুব বেশি ছোট নয়। কিন্তু হলে কী হবে, খুব চঞ্চল, জানো। সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায়। প্রজাপতির মতো।

আমার বারণ একদমই শোনে না। মনে করে, আমি ওর ওপর বড় ভাইগিরি ফলাই শুধু শুধু। আর তাইতে আরও বেশি জেদ করে ঘুরে বেড়ায়। এই ফোল্ডার থেকে সেই ফোল্ডার শুধু নয়, এক ড্রাইভ থেকে অন্য ড্রাইভেও। ওকে বারবার বলে দিয়েছি, ইরিকা, এত ঘুরো না। চুপটি করে এই ফোল্ডারেই থাকো। এটার সাব-ফোল্ডার অনেক বেশি। তার ওপর হিডেন করা। খুব সহজে আমাদের চোখে পড়বে না।

কিন্তু বারণ করাটাই আমার মত্ত বড় ভুল হলো। রাগ করে ও এমন একটা কাণ্ড করে বসল, যেটা করতে বড় বড় ভাইরাসও সাহস পায় না। ও গিয়ে ঢুকল ‘সি’ ড্রাইভে। এই ড্রাইভ হলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ড্রাইভ। এখানে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। অ্যান্টিভাইরাসগুলো সবার আগে, আর সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে এই ড্রাইভেই ভাইরাস খোঁজে। কিন্তু ইরিকা ‘সি’ ড্রাইভের ‘ফন্টস’ ফোল্ডারটায় গিয়ে ঢুকল। অক্ষর নাকি ওর খুব ভালো লাগে। ইদানীং বর্ণমালা শিখছে তো, তাই।

কিন্তু ইরিকার জন্য আমার খুব ভয় হচ্ছে। কাল আবার রিফাত ভাইয়াকে দেখলাম বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাসের সাইটে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। নিশ্চয়ই নতুন কোনো অ্যান্টিভাইরাস ইনস্টল করবে। যদি আজই করে, কী হবে তখন! ইরিকার জন্য আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কিছু করতেও পারছি না।

ল্যাপটপটা এখন শাটডাউন দেওয়া। ল্যাপটপ অন না করা পর্যন্ত আমরা আবার নড়াচড়া করতে পারি না। শুধু নিজেদের ফোল্ডারের ভেতরেই থাকতে হয়। ঠিক করেছি, ল্যাপটপটা চালু হওয়া মাত্রই ‘সি’ ড্রাইভে ছুটে গিয়ে ইরিকাকে নিয়ে আসব। ওর সামনে নিজের কানুকু মলে দেব। দরকার হলে কানুকু ধরে উঠবস করব। বলব, লক্ষ্মী বোন আমার, আর রাগ করিস না। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল। চল, এবার ঘরে চল।

আচ্ছা ল্যাপটপটা কি অন হচ্ছে। হচ্ছেই তো! নাহ্‌, দেরি করা চলবে না। এই তো সুযোগ। হ্যাঁ, এই তো অন হয়ে গেল। তোমরা একটু অপেক্ষা করো। আমি এক্ষুনি ছুটে গিয়ে ইরিকাকে নিয়ে আসি। কেন জানি, আজ খুব ভয় করছে। কীসের একটা আশঙ্কায় মনটা বারবার কেঁপে উঠছে!

আরে, ওটা কে আসছে! সে কী, এ তো দেখি কিটকুশ! যাক, ফিরতে পেরেছে তাহলে। রিফাত ভাইয়া নিশ্চয়ই আবার পেনড্রাইভটা ঢুকিয়েছে। না হলে ফিরতে পারত না।

কিটকুশ খুব জোরে ছুটে এল আমার কাছে। হাঁপাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই বলে উঠল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে কিটা। আমাদের বড় বিপদ!’

‘বিপদ, কীসের বিপদ?’

‘রিফাত ভাইয়া আজ একটা অ্যান্টিভাইরাস নিয়ে এসেছে। লেটেস্ট। আর খুব পাওয়ারফুল। এটাতে তোর-আমার মতো সব ছোট ভাইরাসও রক্ষা পাবে না।

‘কী বলছিস এসব!’

‘ঠিকই বলছি। চল, দ্রুতই ‘এফ’ ড্রাইভের ‘মুভি’ লেখা ফোল্ডারটায় চল। ওখানে অনেকগুলো সাব-ফোল্ডার আছে। সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থেকে যদি বাঁচতে পারি। চল কিটা, দ্রুত। দৌড় দে।’

কিটকুশ আমার হাত ধরে টানতে থাকে। কিন্তু আমি কী করে যাই। আমার বোনটা যে এখনো ‘সি’ ড্রাইভে...। ‘কিটা সময় নেই, দ্রুত। চল চল। নিজের জীবন আগে বাঁচা।’ কিটকুশ তাড়া দেয়।

নাহ্‌, আমি সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলি। নিজের জীবনের চেয়ে বড় আসলেই কিছু নেই। কিন্তু আমার বোন, ইরিকা। সে-ই তো আমার জীবন। ওকেই আগে বাঁচাতে হবে। আমি এক ঝটকায় কিটকুশের হাতের বন্ধন থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিই। দ্রুত ছুটতে থাকি ‘সি’ ড্রাইভ লক্ষ্য করে...।

রিফাত খুব বিরক্ত হচ্ছে। সি ড্রাইভটা কিছুতেই পুরো ক্লিন করা যাচ্ছে না। এমন তো হওয়ার কথা না। কোথাও নিশ্চয়ই সমস্যা আছে। একটা ফোল্ডারে গিয়ে বারবার স্ক্যান আটকে যাচ্ছে।

নাহ্‌, এভাবে হবে না। ম্যানুয়ালি করতে হবে। রিফাত প্রথমে খুঁজে বের করল ‘সি’ ড্রাইভের কোন ফোল্ডারটায় সমস্যাটা হচ্ছে। দ্রুতই আবিষ্কারও করে ফেলল। ফন্টস ফোল্ডারটায় কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। এখন উপায় একটাই। শিফট ডিলিট চেপে ফোল্ডারটা একেবারেই মুছে ফেলা। ফন্টগুলো নতুন করে আবার ইনস্টল করতে হবে। তা হোক।

মাউস দিয়ে ফন্টস লেখা ফোল্ডারটা সিলেক্ট করল রিফাত। শিফট চেপে ডিলিট চাপতে যাবে, ওমনি আবিষ্কার করল, ফন্টস লেখা ফোল্ডারটার নাম কীভাবে যেন হুট করে বদলে গেল। নতুন নাম হয়ে গেল ‘সিস্টার’।

আশ্চর্য তো। এভাবে আপনা-আপনি কোনো ফোল্ডারের নাম বদলে যায়! এটা আগে কখনো খেয়াল করেনি রিফাত। তবে কি এই জন্য সং লেখা ফোল্ডারে গানের বদলে থাকে মুভি। আর মুভি লেখা ফোল্ডারে থাকে গান! এটা কি তবে ভাইরাসেরই কারসাজি? মজাই পেল রিফাত।

হাসতে হাসতে এবার সিস্টার লেখা ফোল্ডারটাই সিলেক্ট করল। শিফট চেপে ডিলিটও চেপে দিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল লেখা: ‘আর ইউ শিওর ইউ ওয়ান্ট টু ডিলিট ‘সিস্টার’?

কথাটার মানে যেন অন্যভাবে ধরা দিল রিফাতের মনে। তুমি কি তোমার বোনকে মুছে ফেলতে চাও? যাহ্‌, সেটা কি কোনো ভাই পারে? ভাইয়ের কাছে বোন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভালোবাসার নাম। বোনকে কীভাবে মুছে ফেলবে সে?

‘ইয়েস’-এর বদলে ‘নো’ লেখা অপশনটায় ক্লিক করল রিফাত।

অলংকরণঃ আসিফুর রহমান