ভাষাশহীদদের কথা

কঠিন কথা সহজ করে বলি। ঢাকা তখন কাঁপছিল উত্তেজনায়। ছাত্ররা তো নিজের ভাষা রক্ষার দাবিতে প্রাণ দিতেও প্রস্ত্তত। থরথর কম্পমান সেই সময়টিতেই এসেছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। সাল ১৯৫২। সেদিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। ১৪৪ ধারার মানে হচ্ছে একসঙ্গে চারজনের বেশি মানুষ এক জায়গায় জড়ো হতে পারবে না। হলেই গ্রেপ্তার। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েই ছিল সংশয়।

আরও একটু আগে ফিরে যাই। বলি ১৯৪৮ সালের কথা। সে বছর ১৯ মার্চ তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এলেন ঢাকায়। ২১ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দুটি বক্তৃতা করেন। দুটি বক্তৃতায়ই তিনি পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর কথা ঘোষণা করেন। যুক্তিহীন এই ঘোষণা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না বাঙালির। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা, অথচ জিন্নাহ সেটা অগ্রাহ্য করেছেন। তখনই মূলত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। আটচল্লিশ সাল থেকে একান্ন সাল পর্যন্ত তখনো সুতীব্র গতিতে, কখনো ঢিমেতালে চলে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন চলে আসছিল। সেটাই আবার তীব্রতা পেল ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারিতে। সেদিন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে। এই বক্তৃতা তাপ ছড়াতে লাগল বাঙালির রক্তে। শুরু হলো আন্দোলন। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার জারি করল ১৪৪ ধারা, যা আগেও বলেছি।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা দেওয়ার পর ছাত্ররা কীভাবে ১০ জনের এক একটা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে শুরু করল, সে ইতিহাস তোমাদের জানা। তাই সে বিষয়ে আর ঢুকলাম না। আমি এখন ভাষা আন্দোলনের সেই সময়টিতে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের পরিচয় তুলে ধরি। তাঁদের কথাই বলি আজ।

আবুল বরকত

জানি, আবুল বরকতের নামটি তোমাদের খুব পরিচিত। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ১৯২৭ সালের ১৬ জুন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তাঁর জন্ম। আবুল বরকত ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন তালেবপুর হাইস্কুল থেকে। এরপর ইন্টারমিডিয়েট পড়েন বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে পাস করে চলে আসেন ঢাকায়। সেটা ১৯৪৮ সাল। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৫১ সালে অনার্স পরীক্ষায় পাস করেন। মামার সঙ্গে তিনি থাকতেন ঢাকার পুরানা পল্টন লাইন এলাকার ‘বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন’-এ।

যেটুকু জানা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলের দিকে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ আর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করল, তখন অনেকেই সেই আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছিল। বরকত মেডিকেল কলেজের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। বেলা তিনটার দিকে পুলিশের ছোড়া বুলেটের আঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন ছাত্র তাঁকে মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা তাঁকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু বরকতকে বাঁচানো যায়নি। রাত ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে বরকত মারা যান।

২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে কড়া পুলিশি পাহারায় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদ বরকতকে কবর দেওয়া হয়।

আবুল বরকত ছিলেন মৌলভি শামসুদ্দীন ও হাসিনা খাতুন দম্পতির ছেলে। ছিলেন ৩ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে ৪র্থ। বড় তিন বোন ও ছোট এক ভাই ছিল তাঁর।

২০০০ সালে সরকার শহীদ বরকতকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

রফিকুদ্দিন আহমদ

বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তাঁর। পড়তেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে। আইকম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি।  একসময় পড়াশোনা শেষ না করেই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বাবার প্রেসে কাজ করতেন তিনি। আসল বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল গ্রামে। মরহুম আবদুল লতিফ আর রফিজা খানমের বড় ছেলে তিনি।

রফিকুদ্দিন রমনা এলাকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সঙ্গে ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতার মিছিলের একজন ছিলেন তিনি। বিকেলের দিকে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে একটি গুলি এসে রফিকুদ্দিনের মাথায় লাগে। মাথার মগজ বেরিয়ে যায়। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান।

বিকেল তিনটার দিকে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রফিককে মেডিকেল কলেজের ছাত্র হুমায়ুন কবির হাইমশাররফুর রহমানেরা জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। প্রখ্যাত আলোকচিত্রী আমানুল হক রফিকের মৃতদেহের একটি ছবি তোলেন।

ভাষাশহীদ রফিকের লাশ গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এত দিন পর আর জানার উপায় নেই, ঠিক কোন জায়গায় রফিককে সমাহিত করা হয়েছিল, কারণ সেই কবরটি সংরক্ষিত ছিল না। ফলে পরে আরও অনেকের কবরই সেখানে দেওয়া হয়।

২০০০ সালে সরকার শহীদ রফিকুদ্দিন আহমদকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

আবদুল জব্বার

আবদুল জব্বারের জন্ম ১৯১৯ সালে। বাবা হাসেম আলী শেখ, মা সাফিয়া খাতুন। থাকতেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে। পড়াশোনা করেছিলেন স্থানীয় পাঠশালায়। কিন্তু সেটা বেশিদূর এগোয়নি। তাই তিনি ছেড়ে দিলেন লেখাপড়া। চাইলেন বাবাকে চাষবাসে সহযোগিতা করতে। সে কাজটাই করছিলেন ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর হঠাৎ তাঁর মনে হলো রোজগার বাড়াতে হবে। বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি একদিন চড়ে বসলেন ট্রেনে। চলে এলেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ তখন বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রাচ্যের ড্যান্ডি নামে বিখ্যাত।

নারায়ণগঞ্জের জাহাজঘাটেই এক সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো আবদুল জব্বারের। জব্বারকে পছন্দ হলো সাহেবের। তাঁরই সহায়তায় একটি চাকরি নিয়ে জব্বার চলে গেলেন বার্মায়। সেখানে আয়ত্ত করলেন ইংরেজি ভাষা। থাকলেন ১২ বছর। তারপর ফিরে এলেন দেশে।

তত দিনে বিয়ে করেছেন জব্বার। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি এলেন ঢাকায়। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী আর শাশুড়ি। ক্যানসার-আক্রান্ত শাশুড়িকে ভর্তি করিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তখন চলছে ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মেডিকেল প্রাঙ্গণে যে বিশাল জনসমাবেশ হয়েছিল, সেখানেই ছিলেন জব্বার। অন্য অনেকের মতোই যোগ দেন সেই অসাধারণ ইতিহাসের অংশ হিসেবে। ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালালে জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি অবস্থায় সে রাতেই তিনি মারা যান।

আবদুল জব্বার স্ত্রী ও চার বছরের এক পুত্র রেখে শহীদ হন। তাঁর স্ত্রীর  নাম আমেনা খাতুন ও ছেলের নাম নূরুল ইসলাম বাদল। ২০০০ সালের তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।

সফিউর রহমান

ভাষাশহীদ সফিউর রহমান ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের একজন কর্মচারী। ১৯১৮ সালে তাঁর জন্ম। জন্মেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগর গ্রামে। কলকাতা গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে তিনি আইকম পাস করেন। পড়াশোনা আর এগোয়নি। দারিদ্র্য তাঁকে চাকরিজীবী হতে বাধ্য করে। চাকরিরত অবস্থায়ই দেশবিভাগ হয়। তিনি আর পশ্চিমবঙ্গে থাকেননি। স্ত্রী আকিলা বেগমকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। কেরানির কাজ নেন হাইকোর্টে।

সফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকালে তিনি সাইকেলে করে নবাবপুর রোড দিয়ে তাঁর অফিসে যাচ্ছিলেন। সে সময় পুলিশের একটি গুলি এসে তাঁর শরীরে লাগে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি মারা যান। চিকিৎসকেরা যখন সফিউর রহমানের দেহে অস্ত্রোপচার করছিলেন, তখন হাসপাতালে তাঁর বৃদ্ধা মা, বাবা, স্ত্রী ও মেয়ে শাহনাজ উপস্থিত ছিলেন।

সফিউরের মৃত্যু হলেও তাঁর লাশ স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়নি। আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। কবরটি এখনো আছে।

সফিউর রহমানের মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁর একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হয় সফিকুর রহমান।

২০০০ সালে ভাষাশহীদ সফিউর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।

শহীদ অহিউল্লাহ

রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের নাবালক ছেলে অহিউল্লাহ। বয়স আট বা নয়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত সে। ২১ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ঘটনার পর ২২ ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকার রাস্তা ছিল মানুষের দখলে। অহিউল্লাহ শহীদ হয় নবাবপুর রোডে। খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল শিশুটি। এ সময় গুলি এসে তার মাথায় লাগে। উড়ে যায় মাথার খুলি। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অহিউল্লাহর লাশ গুম করে ফেলে। তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, তা কেউ জানে না। 

আবদুস সালাম

১৯২৫ সালে জন্মেছিলেন আবদুস সালাম। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এখন গ্রামটির নাম সালাম নগর। মুন্সি আবদুল ফাজেল মিয়া তাঁর বাবা। মা দৌলতন্নেসা। বাবা ফাজেল মিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং ইরাকের বসরায় কর্মরত ছিলেন। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে সালাম ছিলেন সবার বড়।

কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর তিনি মাতুভূঞা কলিমুল্লাহ মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর দাগনভূঞা আতাতুর্ক হাইস্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অর্থাভাবে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। কাজের খোঁজে এ সময় তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে তাঁর চাচাতো বোনের বাড়িতে যান। চাচাতো বোনের স্বামী আবদুল কাদের তাঁকে কলকাতা বন্দরে চাকরি জুটিয়ে দেন। ভারত বিভাগের পর সালাম ঢাকায় চলে আসেন। আজিমপুরের পলাশী ব্যারাকে থাকতে শুরু করেন। চাচাতো ভাই আবদুল হালিমের সহায়তার তিনি দিলকুশার ‘ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এ পিয়ন পদে চাকরি নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই তিনি কাজ করেছেন।