গল্প নিয়ে গল্প করি

একটা গল্প। ধরো, শুরুটা এমন:

‘সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল, ছেলে দুইটার নাম শুনলেই রাগে আমার গা জ্বালা করে। ক্রিকেট নাকি “জেন্টেলম্যানস গেম”। ছ্যাহ, এরা বুঝি ভদ্দরলোক! অসভ্য, বর্বর, মারকুটে...’

এটুকু পড়েই খেপে গেলে? গল্পটা তো এখনো শেষ হয়নি। ধরো শেষ করার দায়িত্বটা তোমাকেই দিলাম। কী লিখবে তুমি? ভাবতে থাকো। যা খুশি, যেভাবে খুশি ভাবতে পারো। গল্প লেখার মজাই এটা। নিজের ইচ্ছেমতো চরিত্র আঁকা যায়, ঘটনাপ্রবাহ সাজিয়ে নেওয়া যায়। ‘এ প্লাস বি হোলস্কয়ার’ সূত্রের মতো গল্প লেখার আসলে কোনো সূত্র নেই। নিয়মকানুন কিছু আছে বটে। চাইলে তুমি সেসবের তোয়াক্কা না করেও একটা কিছু লিখে ফেলতে পারো। হয়তো এমন এক নতুন ধরনের গল্প তুমি লিখবে, যেটা আগে কেউ কখনো ভাবেইনি!

আবার উল্টোটাও হতে পারে। কাগজ-কলম নিয়ে বসে আছ। জানালা দিয়ে মশা আসছে, বাতাস আসছে, তোমার চোখে ঘুম আসছে কিন্তু মাথায় গল্প আর আসছে না! একটা প্যারা লিখে ঝিম মেরে বসে আছ।

দেখা যাক, তোমাকে খানিকটা সাহায্য করা যায় কি না।

 লিখতে হলে পড়তে হবে

 প্রথম কথাই হচ্ছে ভালো লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। জানার পরিধিটা যত বড় হবে, ততই বিচিত্র সব আইডিয়া তোমার মাথায় কিলবিল করবে। তুমি হয়তো ভাবছ, ‘অত পড়ার আমার দরকার নেই। আমি ব্যতিক্রম কিছু লিখব।’ যাকে বলে একদম ‘আউট অব দ্য বক্স’। বাক্সের ভেতরে কী কী আছে, তা যদি তুমি না-ই জানো, বাক্সের বাইরের আইডিয়া কোনটা, সেটা তুমি বুঝবে কেমন করে?!

ধরো, একটা গোয়েন্দা গল্প লিখতে বসেছ। অপরাধীকে তাড়া করতে করতে তোমার নায়ক আফ্রিকায় গিয়ে হাজির। তুমি কখনো আফ্রিকা যাওনি। সেখানকার ঘটনা তুমি লিখবে কেমন করে? মঈনুস সুলতানের ভ্রমণকাহিনিগুলো যদি তোমার পড়া থাকে, না গিয়েও তুমি দেশটা সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যাবে। বিভিন্ন লেখকের বিচিত্র সব গল্প তোমাকে বিচিত্র সব চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। এসব চরিত্রের মধ্যেই হয়তো তুমি তোমার গল্পের চরিত্রটাকে খুঁজে পাবে।

গল্প লেখার নিয়মকানুন নিয়ে বাংলা ভাষায় খুব বেশি বই নেই। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মার্জিনে মন্তব্য (গল্পের কলকবজা) পড়ে দেখতে পারো। এ ছাড়া বিভিন্ন বিদেশি ওয়েবসাইটে কিছু পরামর্শ পাবে।

 মস্তিষ্কে ঝড়

 ইংরেজিতে বলে ব্রেইনস্টর্ম। বাংলায় বলা যায় মস্তিষ্কে ঝড় তোলা। গল্প লিখতে হলে এই ঝড় তোমাকে তুলতেই হবে। কীভাবে গল্পটা শুরু হবে, চরিত্র কারা, চরিত্রগুলোর পরিণতি কী হবে, মূল টুইস্টটা কোথায়...সবটাই ভাবতে হবে। কোনো কোনো লেখক শুরুতেই পুরোটা ভেবে নেন। আবার কেউ কেউ একটা কিছু ভেবে লেখা শুরু করেন, চরিত্রগুলোই গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তুমি কোন পদ্ধতিটা পছন্দ করছ সেটা তুমিই বের করো।

আশপাশটা দেখ। কোন মানুষটা কীভাবে কথা বলে, কে কীভাবে হাঁটে, কীভাবে হাসে, কার কোন আচরণটা রহস্যময় মনে হয়... খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে তোমারে আশপাশেই অনেক গল্প, অনেক চরিত্র খুঁজে পাবে। শুধু মানুষ নয়। একটা কাক, একটা তেলাপোকা, একটা গাছের পাতা, একটা আস্ত গ্রহ কিংবা সেÊফ একটা ছায়া—তোমার গল্পের চরিত্র হতে পারে যে কেউ, যে কোনো কিছু। পারলে হাতের কাছে সব সময় একটা নোটবুক রাখো। মাথায় কিছু এলেই চট করে লিখে ফেল। কী থেকে কী আইডিয়া বেরিয়ে আসবে, তুমি নিজেও হয়তো জানো না!

একটা উদাহরণ দিই। হ‌ুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র মিসির আলি। এই চরিত্রের জন্ম কীভাবে জানো? মিসির আলি অমনিবাস বইয়ের প্রচ্ছদে হ‌ুমায়ূন আহমেদ যা লিখেছেন, তার অংশবিশেষ এমন: 

...গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম

 Close your eyes and try to see.

বাহ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা... 

এভাবেই একটা গানের কলি থেকে জন্ম নিয়েছে একটা বিখ্যাত চরিত্র। তোমার গল্পের চরিত্রটাকে তুমি কোথায় খুঁজে পাবে, কে জানে!

 গল্পের ছবি

 তুমি যদি একজন লেখক হও, তোমাকে শুধু গল্পটা লিখলেই হবে না, দেখতেও হবে। কল্পনায় যে দৃশ্যটা তুমি দেখছ, সেটাই তুমি লিখবে। ধরো, তোমার গল্পের নায়ক বসে আছে একটা নদীর পাড়ে। গাছের নিচে। গাছটা কী গাছ? নদীটা কি ছোট না বড়? সময়টা কখন? নায়কের পরনে কী? তুমি মনে মনে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছ, পাঠককেও সেটাই দেখানোর চেষ্টা করো।

গল্পের প্রতিটা চরিত্র তৈরি করতে হবে ভেবেচিন্তে। ধরো, তুমি একটা সুপারহিরোর চরিত্র নিয়ে ভাবছ। সে দেখতে কেমন? সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, নাকি বোকাসোকা টাইপ? তাঁর হয়তো এইট প্যাক অ্যাবস নেই, রোগা টিংটিঙা শরীর, কিন্তু গায়ে ভয়ানক শক্তি! সে হয়তো সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের মতো কস্টিউম পরে না। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েই ভয়ানক সব শত্রুকে ঘায়েল করে ফেলে! চরিত্রগুলোকে মনে মনে যেভাবে খুশি আঁকতে পারো। হিংসা, রাগ, ভালোবাসা, ভয়, দ্বিধা, হাস্যরস...কমবেশি সব ধরনের মানবিক গুণাবলিই তার মধ্যে থাকা চাই। চরিত্রটির কথায়, আচরণে সে পাঠকের কাছে একটা নিজস্ব পরিচয় পাবে। চাইলে তুমি তার মধ্যে কোনো মুদ্রাদোষও দিয়ে দিতে পারো। তিন গোয়েন্দার মুসা আমান যেমন কথায় কথায় ‘খাইছে’ বলে, তোমার গল্পের চরিত্র হয়তো কথায় কথায় ‘ধুত্তোরি’ বলবে। তোমাদের বাসার পাশে এক চায়ের দোকানদার হয়তো সারাদিন চিরুনি দিয়ে পিঠ চুলকায়! এই ‘পিঠ চুলকানো’ লোকটাকেও তোমার গল্পের একটা চরিত্র করতে পারো। এমন ছোট ছোট বিশেষত্বের জন্য পাঠক চরিত্রটাকে মনে রাখে। 

আমি-তুমি-সে

গল্পটা পাঠককে বলবে কে? লেখক নিজে, নাকি তৃতীয় কেউ? ধরো, তুমি লিখছ:

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম দরজাটার দিকে। ঠোঁটে আঙুল রেখে নিশাকে বললাম, ‘শশ্, একদম শব্দ করবি না।’ নিশা কোনো কথা বলল না। শুধু খামচি দিয়ে আমার হাতটা ধরে রাখল। 

এভাবে লেখার অর্থ হলো, গল্পের একটা চরিত্র হয়ে লেখক গল্পটা বলছেন। ব্যাকরণের ভাষায় বলা যায় ‘উত্তম পুরুষ’ বা ‘আমি-আমার-আমাদের’ ব্যবহার করে লেখা। এভাবে লিখলে গল্পটা একদম বাস্তব মনে হয় সেটা ঠিক। তবে এর একটা অসুবিধাও আছে। গল্পটা কেবল একটা চরিত্রের চোখেই দেখতে হয়। অন্যের ভাবনাটা জানা যায় না বা অন্য কিছু দেখাও যায় না। যেমন, আগের গল্পটাই ধরো তুমি নাম পুরুষে লিখছ: 

রনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে। ঠোঁটে আঙুল রেখে নিশাকে বলল, ‘শশ্, একদম শব্দ করবি না।’ নিশা মুখে কোনো শব্দ করল না। মনে মনে হিসহিসিয়ে বলল, ‘একবার শুধু দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোক। আজ তোর ঘাড় মটকাব!’ 

কীভাবে গল্পটা বলবে, সেটা তুমিই বেছে নাও। চাইলে গল্পের একটা পরিচ্ছদ উত্তম পুরুষে বলে আরেকটা পরিচ্ছদ নাম পুরুষেও বলতে পারো। কিছু কিছু গল্প মধ্যম পুরুষেও লেখা হয়। যেখানে পাঠককেই ধরে নেওয়া হয় গল্পের একটা চরিত্র। যেমন: 

তুমি যখন খুব ছোট, তখন একটা পিপড়ার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে কথা এখন আর তোমার মনে নেই। রোজ সকালে কনুইতে কামড় দিয়ে পিঁপড়াটা তোমার ঘুম ভাঙাত। আর তুমি রেগেমেগে কনুই ডলতে ডলতে বলতে, ‘উফ, এত জোরে কামড় দিতে বলেছি?!’ 

চাইলে এভাবেও গল্প লেখার চেষ্টা করে দেখতে পারো।

 তারপর? তারপর??

 গল্পজুড়ে আকর্ষণ রাখাটা খুব জরুরি। পাঠক যেন পরের ঘটনাগুলো জানতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। প্রথম প্যারাতেই পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। যেমন, সুকুমার রায়ের লেখা হযবরল গল্পের শুরুটা যদি দেখো: 

বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের ওপর রুমালটা ছিল; ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি, অমনি রুমালটা বলল, ‘ম্যাঁও!’ কি আপদ! রুমালটা ম্যাঁও করে কেন? 

গল্পটা তুমি হয়তো আগেও পড়েছ। তবু, প্রথম প্যারাটা পড়েই এক্ষুনি আরেকবার পুরোটা পড়ে ফেলার ইচ্ছা হলো কী না বলো? এমন একটা জাদুই গল্পে থাকা দরকার। পাঠক যদি আগেই ঘটনাটা বুঝে ফেলে, তাহলে তো আর মজা থাকল না। চমক রাখো। ট্র্যাজেডি, ক্লাইমেক্স, টুইস্ট—এসব একটা গল্পে ভীষণ প্রয়োজন। চরিত্রটাকে কঠিন একটা বিপদে ফেলে দাও। পাঠক যেন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। মনে মনে ভাবতে থাকে, ‘এখন কী হবে!’ চমকপ্রদ কোনো উপায়ে সেই বিপদ থেকে বের করে আনো, কিংবা বিপদ থেকে বেরোতে গিয়ে আরও বড় বিপদে ফেলে দাও! টানটান উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোই পাঠককে ধরে রাখবে।

 গল্পেরসাইজ

 বেশির ভাগ সময় তোমরা গল্পের শব্দসংখ্যা নিয়ে বিপদে পড়ে যাও। হয়তো কোথাও ৪০০ শব্দের গল্প চাওয়া হয়েছে, তোমার লেখা গল্প হয়ে গেছে দুই হাজার শব্দের! অল্প কথায় চমৎকার একটা গল্প লিখতে পারাটাই কিন্তু বড় সাফল্য। যেমন একটা বিখ্যাত পুঁচকে গল্প (ধারণা করা হয়, গল্পটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা। কিন্তু এ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি) আছে এমন:

বিক্রয় হবে।

একটি ছোট বাচ্চার জুতো। অব্যবহৃত।

এইটুকুন একটা গল্পের ভেতরে কত কথা! অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় হয়তো বাবা-মা জুতা কিনে রেখেছিলেন। কিংবা ছোট্ট ফুটফুটে একটা বাচ্চার জন্য হয়তো কেনা হয়েছিল, যে বাচ্চাটা এখন আর নেই। পাঠক যেভাবে খুশি গল্পটার অর্থ দাঁড় করিয়ে নিতে পারে। এতটা ছোট করে লিখতে না পারলেও তোমার গল্পে এই মজাটা রাখার চেষ্টা করো। ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেটা খুব সহজ ভাষায় বলে গেছেন, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ছোটগল্প যদি ভালো লিখতে পারো, তোমার লেখা বড় উপন্যাসটার প্রতিটা পরিচ্ছদও ঝরঝরে, আকর্ষণীয় হবে।

 নকল নয়

 ভালো গল্প লিখতে না পারাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু নকল গল্প লেখাটা শুধু দোষই না, অনেক বড় অপরাধ। একটা বোকা ছেলে হয়তো কোনো গল্প নকল করে পত্রিকায় পাঠাল, আর সেটা ছাপাও হয়ে গেল। আজ বা কাল না হোক, ইন্টারনেটের এই যুগে একদিন না একদিন সেটা নিশ্চয়ই ধরা পড়ে যাবে। কী লজ্জাটাই না তাকে পেতে হবে, ভাবো! গল্পের দুনিয়া কত্ত বড়! যা খুশি লেখা যায়। সেখানে অন্যের একটা গল্প নকল করতে হবে কেন?

 শেষ কথা

 আগেই বলেছি, এতসব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেও তুমি গল্প লিখতে পারো। রবীন্দ্রনাথ কখনো গুগলে ‘হাউ টু রাইট আ শর্ট স্টোরি’ লিখে সার্চ করার সুযোগ পাননি। রবীন্দ্রনাথ নিজের ইচ্ছেমতো লিখেই ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়েছেন। তবে তিনি যা করেছেন, প্রচুর বই পড়েছেন। যত বড় বড় লেখক আছেন, সবার মধ্যেই দেখবে এই ব্যাপারটা কমন। ভালো পাঠকই আসলে ভালো লেখক হন।

 পুনশ্চঃ

 ও হ্যাঁ, লেখার শুরুতেই একটা গল্প বলছিলাম। পুরো গল্পটা এমন হলে কেমন হয় দেখত:

‘সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল, ছেলে দুইটার নাম শুনলেই রাগে আমার গা জ্বালা করে। ক্রিকেট নাকি “জেন্টেলম্যানস গেম”। ছ্যাহ, এরা বুঝি ভদ্দরলোক! অসভ্য, বর্বর, মারকুটে...আমাকে কাছে পেলেই ব্যাট দিয়ে এমন জোরে মারে। উফ, কেন যে একটা “ক্রিকেট বল” হয়ে জন্মেছিলাম!’