হারানো আটলান্টিস-রহস্য

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। তবু মানুষ না হয় হারাতে পারে, কিন্তু আস্ত একটা মহাদেশ হারিয়ে যেতে পারে, সে কথা শুনেছ কখনো? অবিশ্বাস্য হলেও ঠিক এমন রহস্যময় ঘটনা ঘটেছিল অন্য কোথাও নয়, আমাদের পৃথিবীতেই।

প্রাচীন নথিপত্র সাক্ষী দেয়, আমাদের জানা সাতটি মহাদেশ ছাড়াও এককালে আরও এক মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল। অথচ বহু চেষ্টায়ও হারিয়ে যাওয়া এই মহাদেশের সন্ধান আজতক পাওয়া যায়নি।

রহস্যময় আটলান্টিস

প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন পৃথিবীতে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে এক মহাদেশের অবস্থান ছিল। সহজ করে বললে, জিব্রাল্টার (আসল উচ্চারণ জাব-আল-তারেক বা তারেকের পাহাড়) প্রণালির পশ্চিমে ছিল মহাদেশটির অবস্থান, যার নাম আটলান্টিস। গ্রিক এ শব্দের অর্থ ‘অ্যাটলাসের দ্বীপ’। আয়তনে এশিয়া মাইনর ও লিবিয়ার মিলিত আয়তনের চেয়েও বড় ছিল মহাদেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত, সভ্য আর ক্ষমতাশালী এক জাতির বসবাস ছিল আটলান্টিসে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল মহাদেশটি। শোনা যায়, প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনী থাকার কারণে আটলান্টিসের শাসকেরা বর্তমানের ইউরোপ আর আফ্রিকা পর্যন্ত তাঁদের শাসনক্ষমতা বিস্তৃত করেছিলেন।

গল্পের শুরু যেখানে

গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর (৪২৭-৩৪৭ খ্িরষ্টপূর্ব) লেখা ডায়ালগ  টিমিয়াস ও  ক্রাইটিয়াস আটলান্টিস সম্পর্কিত তথ্যের একমাত্র উৎস। এ সম্পর্কে প্রাচীন কোনো বইয়ে তথ্য নেই। অবশ্য প্লেটো এসব তথ্য পেয়েছিলেন বিখ্যাত গ্রিক কবি ও অ্যাথেন্সের আইনসভার সদস্য সোলনের কাছ থেকে। প্লেটোর জন্মের প্রায় ১৫০ বছর আগে মিসরের সেইস নগরে ভ্রমণ করেছিলেন সোলন। সেখানেই নাকি এক পুরোহিতের কাছ থেকে আটলান্টিসের গল্প শুনেছিলেন কবি সোলন। মিসরের সেই পুরোহিত নাকি তাঁকে মিসরের প্রাচীন এক মন্দিরে এ বিষয়ে লিখিত বিবরণও দেখিয়েছিলেন। সেখানে সোলন দেখেন, প্রায় নয় হাজার বছর আগে অ্যাথেন্সবাসী সম্মিলিতভাবে আটলান্টিসের শাসকদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মিসর ও অ্যাথেন্স রক্ষা করেছিল। পুরোহিতের কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্য কবি সোলন তাঁর নোটবইয়ে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

সোলনের এ নোটবই পরিবারের হাত ঘুরে একসময় এসেছিল প্লেটোর হাতে। সেখান থেকেই আটলান্টিস সম্পর্কে লিখেছিলেন প্লেটো। সোলনের নোটবইয়ের ওপর ভিত্তি করে প্লেটো তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর শুরু থেকেই আটলান্টিসের অস্তিত্ব ছিল। অমর দেবতারা নিজেদের মধ্যে বিশ্বকে ভাগ করার সময় দেবতা পেসিডনের ভাগে পড়ে আটলান্টিস মহাদেশ। পেসিডন বিয়ে করেন মর্তে্যর ক্লেইটোকে। ক্লেইটোর গর্ভে পেসিডনের পাঁচটি যমজ সন্তান জন্মে, যার একটির নাম অ্যাটলাস। পরবর্তী সময়ে এ মহাদেশের শাসনকর্তা হন অ্যাটলাস। প্রথম শাসক অ্যাটলাস দীর্ঘদিন এ মহাদেশ শাসন করেন। তাঁর নামেই মহাদেশের নাম হয় আটলান্টিস। অ্যাটলাসের অন্য নয় ভাই এই মহাদেশের অন্যান্য অংশে শাসন করতেন।’

এই পৌরাণিক কাহিনি ছাড়াও বই দুটিতে আটলান্টিসের অনেক খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন প্লেটো। যেমন এ মহাদেশে বছরে দুবার ফসল চাষ হতো। শীতকালীন ফসলের জন্য বৃষ্টিই ছিল ভরসা। কিন্তু গ্রীষ্মকালে তারা ফসল ফলাত উন্নত সেচের মাধ্যমে। এখানে পর্যাপ্ত ফসল, ফলমূল উৎপাদন হতো। সেখানে হাতি-ঘোড়াসহ নানা জীবজন্তুর ছিল অবাধ বিচরণ। ওরিক্যাল নামের এক অজানা ধাতু খনি থেকে উত্তোলন করা হতো। স্বর্ণের পরই ছিল ওরিক্যালের গুরুত্ব। আটলান্টিসে ছিল সুশিক্ষিত এক সেনাবাহিনী। কিন্তু কে জানত, এ মহাদেশ একদিন শুধুই কিংবদন্তিতে পরিণত হবে! হঠাৎ একদিন প্রবল ভূমিকম্প আর বন্যায় গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যায় আটলান্টিস। এ রকম আরও অনেক অবিশ্বাস্য সব তথ্য আছে প্লেটোর উল্লিখিত বইয়ে। অন্য কারও লেখা হলে এসব বিবরণকে স্রেফ গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লেখক স্বয়ং সক্রেটিসের অন্যতম শিষ্য আর অ্যারিস্টটলের গুরু মহামান্য প্লেটো। তাই বিষয়টিকে ধাপ্পাবাজি বলে বাতিল করা যাচ্ছে না। তাহলে?

আটলান্টিস বিতর্ক

আগেই বলেছি, প্লেটোর লেখা বই-ই আটলান্টিস সম্পর্কিত তথ্যের একমাত্র উৎস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্লেটো বই দুটিতে হঠাৎ করেই আটলান্টিসের গল্প অসম্পূর্ণ রেখেই থামিয়ে দিয়েছেন। তাতে এ মহাদেশ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি। জন্ম হয়েছে অনেক রহস্যেরও। কেউই জানে না, প্লেটো মহাদেশটির অস্তিত্বে সত্যিই বিশ্বাস করতেন নাকি অন্য কিছু। অনেকে বলেন, প্লেটো আটলান্টিসের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। তাঁদের যুক্তি, তা না হলে প্লেটো এ সম্পর্কে এত বিস্তারিত বর্ণনা দিতেন না। এদিকে অবিশ্বাসীরা এ যুক্তি বাতিল করে বলেন, বিষয়টি শুধুই কল্পনা। যেহেতু প্লেটো গল্প বলছেন, তাই সেটাকে তিনি ইচ্ছেমতো বড় করতেই পারেন। তার মানে এই নয় যে, আটলান্টিসের বাস্তবে অস্তিত্ব থাকতে হবে।

এসব বিতর্ক ছাড়াও এ গল্পের সময়কালও অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। সোলন তাঁর নোটবইয়ে লিখেছেন, ৯০০০ বছর আগে এ মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ সেটা মানবসভ্যতার পাথর যুগের প্রথম দিকের ঘটনা। কিন্তু পাথর যুগে গল্পে বর্ণিত এ রকম কৃষিকাজ, স্থাপত্য ও সমুদ্রজ্ঞান এককথায় অসম্ভব। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, আসলে সোলন মিসরীয় সংখ্যা সংকেত বুঝতে ভুল করেছিলেন। কারণ, মিসরে ১০০-কে ১০০০ হিসেবে লেখা হয়। সেটি সত্য হলে সোলনের সময় থেকে আসলে ৯০০০ নয়, ৯০০ বছর আগে অস্তিত্ব ছিল আটলান্টিসের। এ সময়কালটা হচ্ছে মধ্যবর্তী ব্রোঞ্জযুগ। এ যুগে আটলান্টিসের বর্ণিত সবকিছু বাস্তবে সম্ভব।

অবশ্য ৯০০ বছরের তত্ত্ব মেনে নিলে, আটলান্টিক সমুদ্রগর্ভে ডুবে যাওয়ার কিছু ভূ-প্রাকৃতিক প্রমাণও পাওয়া যায়। কারণ, গড়পড়তা প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব আগে একটি বড় ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে একটি দ্বীপের অর্ধেক সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার প্রমাণ আছে। এ প্রমাণ হাতে নিয়ে গবেষকেরা হারানো আটলান্টিসের খোঁজে চষে ফেলেছেন আটলান্টিক মহাসাগর। তবে সবই বৃথা। এখন পর্যন্ত এর টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তবু বিজ্ঞানীরা হাল না ছেড়ে এখনো সাগরতলে আটলান্টিস খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের দৃঢ় আশা, হারানো আটলান্টিস একদিন না একদিন খুঁজে পাওয়া যাবেই যাবে।