পাখির জন্য মায়া

মানুষ কত অদ্ভুত কাজই না করে। এমনই এক অদ্ভুত কাজ হলো পাখি দেখা! তবে শুধু দেখা বা ছবি তোলা নয়, রীতিমতো দুরবিন, ক্যামেরা, জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে পাখি অনুসরণ করে অনেকে। পাখিদের অনুসরণ করার এই কাজ যারা করে তাদের ইংরেজিতে বলে টুইচার। এমনই এক টুইচার মায়া রোজ ক্রেইগ, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই কিশোরীর বয়স এখন মাত্র বারো। এই মুহূর্তে মায়াই সম্ভবত পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ টুইচার। এ বয়সেই মায়া পৃথিবী ঘুরে তিন হাজারের বেশি পাখিকে অনুসরণ করেছে।

বাবা-মাকে দেখেই টুইচারিংয়ের দুনিয়ায় এসেছে মায়া। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মায়ার মা হেলেনা আহমেদ সিলেটের মেয়ে আর বাবা ক্রিস ক্রেইগ ব্রিটিশ। যুক্তরাজ্যের সমারসেটে বসবাস তাদের। পাখি দেখতে এর মধ্যে বেশ কবার মায়ের দেশ বাংলাদেশে এসেছে সে।

চামচঠুঁটো বাটান
চামচঠুঁটো বাটান

পাখির দেশ বাংলাদেশ

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চামচঠুঁটো বাটান পাখির জরিপে বাংলাদেশে এসেছিল মায়া। চামচঠুঁটো বাটান পাখির বাস রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে। শীতকালে বাংলাদেশে আসে পাখিটি। পৃথিবীতে মাত্র শ দুয়েক এই জাতের পাখি আছে। মায়া বাংলাদেশের দক্ষিনের সোনাদিয়া দ্বীপে চামচঠুঁটো বাটান পাখিকে অনুসরণ করতে যায়। সেখানে গিয়ে সে চমকে যায়। এক দিনে ১৯টা চামচঠুঁটো বাটান পাখির দেখা পায় মায়া। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যও মুগ্ধ করেছে তাকে। মায়া জানায়, ‘ছোট্ট একটা দেশে চামচঠুঁটো বাটান পাখির ১০ শতাংশ দেখে আমি মুগ্ধ।’

সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারি পাখি
সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারি পাখি

রেকর্ডের হাতছানি

মা-বাবার হাত ধরে চার বছর বয়স থেকেই পাখি দেখা শুরু মায়ার। জন্মের পরে তার শেখা তৃতীয় শব্দটি ছিল বার্ডি। এরই মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা বাদে সব মহাদেশেই পাখি গোনার কাজ করেছে সে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, পেরু, অস্ট্রেলিয়াসহ চল্লিশটির বেশি দেশের বনে-জঙ্গলে ঘুরে তিন হাজারের বেশি পাখি অনুসরণ করেছে। মায়ার প্রিয় পাখি অবশ্য সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারি পাখি, অনেকটা এমু পাখির মতো দেখতে এটি। মায়া ১৫ বছর বয়স পেরোনোর আগেই ১০ হাজার পাখি দেখার রেকর্ড করতে চায়। পাখি দেখা ছাড়াও মায়া পাহাড়ে চড়া ও ফটোগ্রাফি নিয়েও আগ্রহী।

বাবা, মা ও বড় বোনের সঙ্গে মায়া
বাবা, মা ও বড় বোনের সঙ্গে মায়া

পরিবেশ রক্ষায় মায়ার ব্রত

২০১০ সালে মায়াকে নিয়ে বিবিসি ফোর চ্যানেল ‘টুইচার্স: আ ভেরি ব্রিটিশ অবসেশন’ নামে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে। বর্তমানে অষ্টম গ্রেড পড়ুয়া মায়া পড়াশোনা শেষ করে পাখি সংরক্ষণ, পরিবেশ আন্দোলন-সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করতে চায়। ২০১৪ সালের বাংলাদেশের সুন্দরবনের তেল দুর্ঘটনা নিয়ে মায়া তার ব্লগে বেশ কটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। মায়ার ব্লগ থেকেই ইংল্যান্ডের দৈনিক পত্রিকা  ইন্ডিপেন্ডেন্টডেইলিমেইল সুন্দরবনের দুর্যোগের তীব্রতা ও ক্ষতির সংবাদ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের পাখি নয়, সারা বিশ্বের পাখি ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য মায়া দিয়ে কাজ করতে চায় মায়া।

বাংলাদেশ পাখির দেশ

- মায়া রোজ ক্রেইগ

বদ্বীপ দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আসলে পাখির অভয়ারণ্য। বাংলাদেশে ৪৩টি পরিবারের মোট ৩২০ জাতের পাখি পরিযায়ী হয়ে আসে। এই পাখিগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে খাবার আর আশ্রয়ের সন্ধানে আসে এই বাংলাদেশে। আবার কিছু পাখি আছে, যারা বাংলাদেশে আসে শুধু বাচ্চা ফোটানোর জন্য। চামচঠুঁটো বাটান নামের সৈকত পাখিটি একসময় নিয়মিত দেখা যেত ভোলা আর নোয়াখালীর উপকূলে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে পাখিটিকে এ এলাকায় আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। এখন এর অন্যতম আবাসস্থল হলো সোনাদিয়া দ্বীপ। বাংলাদেশে মোট ৭০০ জাতের পাখির মধ্যে অর্ধেকই পরিযায়ী। বছরের বড় একটা সময় এরা বাংলাদেশে কাটায়। পাখি অনুসরণ করতে করতে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আমি হারিয়ে যাই। এমন বৈচিত্র্যময় দেশে আসতে পেরে আমি রোমাঞ্চিত। আমার দাদা-দাদি আর নানা-নানির দেশ বাংলাদেশ। সিলেট থেকে তারা ১৯৫০ সালের দিকে লন্ডন পাড়ি দেয়। ইংল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশের পাখির বৈচিত্র্য বেশি। ভবিষ্যতে আমি পাখি এবং বন্য জন্তু রক্ষা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের শক্তিই পারে বন্য প্রাণীদের রক্ষা করতে।

মায়ার ব্লগ লেখার সাইট থেকে অনুবাদ
সব ছবি মায়া রোজের সৌজন্যে