চল যাই তেল-গ্যাস আহরণে

প্রাকৃতিক জ্বালানি যে আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, সেটা নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। বাসার রান্না থেকে শুরু করে গাড়ির বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর কারণ হচ্ছে জ্বালানি থেকে শক্তি আসে আর বর্তমান দুনিয়ায় এই শক্তির তেমন একটা বিকল্প নেই। বলা হয়, বিশ্ব যে জাতির হাতে যত বেশি জ্বালানি শক্তির মজুত কিংবা নিয়ন্ত্রণ আছে তাঁরা তত বেশি শক্তিশালী। কিন্তু আমরা কি জানি, এই জ্বালানি অর্থাৎ তেল ও গ্যাস আসলে কীভাবে তৈরি হয় এবং আহরণ করা হয়? না জানলে সমস্যা নেই, এটা তারই গল্প।

আমরা জানি, পৃথিবীতে প্রাণের আগমন মিলিয়ন বছর আগে। বহু বছর ধরে যেসব উদ্ভিত ও প্রাণী পৃথিবীতে বসবাস করেছে তাদের দেহাবশেষ মাটির নিচে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে তেল ও গ্যাস তৈরি করে। মাটির নিচে চাপ অনেক বেশি থাকার কারণে এই তেল বা গ্যাস উপরে উঠতে থাকে। মাটির ফাঁকফোকর দিয়ে এভাবেই উঠতে তাদের খুব একটা সমস্যা হয় না এবং কখনো কখনো বাইরেও চলে আসে। সিলেট ও সীতাকুণ্ডে এই রকমের কিছু জায়গা থেকে সব সময় এভাবে গ্যাস ওঠে। সাধারণত এর পরিমাণ খুব কম হয় এবং কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না।

বেশির ভাগ সময় তেল-গ্যাস বাইরে বের হতে পারে না। কারণ মাটির এমন কিছু স্তর আছে যেগুলো এরা ভেদ করতে পারে না। ফলে তারা ওই স্তরের নিচে জমতে থাকে এবং একসময় প্রচুর পরিমাণে জমা হয়। যে স্তরে খনিজ জমা হয়ে তাদের ডাকা হয় রিজার্ভার বা মজুত আর ওপরের অভেদ্য স্তরকে ডাকা হয় ট্র্যাপ বা ফাঁদ। এখান থেকেই খনিজ তোলা হয় এবং শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

প্রাকৃতিক জ্বালানি খুঁজে বের করা খুব একটা সহজ কাজ না। প্রধান কারণ মাটির নিচে খনিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করার কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে কীভাবে খনিজ খোঁজা হয়? ‘সিসমিক সার্ভে’র সাহায্যে। এই পদ্ধতিতে মাটির নিচে সাউন্ডওয়েভ পাঠিয়ে এর প্রতিধ্বনি রেকর্ড করা হয়। সেই প্রতিধ্বনি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, খনিজ সম্পদ ধারণক্ষম স্তর আর ট্র্যাপ কি মাটির নিচে আছে কি না? স্থলভাগে এই কাজে সাধারণত শক্তিশালী বিস্ফোরক ফাটিয়ে সাউন্ডওয়েভ মাটির নিচে পাঠানো হয়। আর সাগরে জাহাজের মাধ্যমে এয়ারগান দিয়ে সাউন্ডওয়েভ তৈরি করা হয়।

সমুদ্রে যেভাবে খনিজ সম্পদ খোঁজা হয়
সমুদ্রে যেভাবে খনিজ সম্পদ খোঁজা হয়

শব্দ তরঙ্গের তথ্য বিশ্লেষণের পরে ভূতাত্ত্বিকেরা ওই এলাকার মাটির স্তরের ম্যাপ তৈরি করেন এবং খনিজ সম্পদ থাকার সম্ভাবনা খাতিয়ে দেখেন। কোথাও সম্ভাবনা থাকলে খনিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে ওই জায়গায় গর্ত খনন করতে হয়। গর্ত খোঁড়া ছাড়া উপস্থিতি নিশ্চিত করার আর কোনো উপায় নেই। সাধারণত এই রকমের দশটা গর্ত করলে একটা ভালো খনিজ ক্ষেত্রের দেখা মেলে। এ থেকে বোঝা যায় যে খনিজ সম্পদ আবিষ্কার কতটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর কাজের দিক দিয়ে এটা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

খনিজ সম্পদ যেকোনো জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। খনিজের সম্ভাবনাময় জায়গা গহিন জঙ্গল, সুউচ্চ পাহাড় বা গভীর সমুদ্রের মাঝখানে হতে পারে। এটি মাটির ১০০০ ফুটের ওপরেও থাকতে পারে আবার ১০,০০০ ফুট নিচেও থাকতে পারে, গর্ত করার আগে তার উপস্থিতি জানতে পারা যায় না। এত গভীর গর্ত করার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় ড্রিলিং রিগ। বিশাল আকৃতির এই যন্ত্র থেকে ড্রিল বিট বা কাটার দিয়ে মাটির নিচে গর্ত খোঁড়া হয়। কাটার নামানো হয় স্টিলের পাইপ দিয়ে। পাইপের ভেতরে ঘন তরল পদার্থ পাম্প করা হয়, যা ‘মাড’ বলে পরিচিত। এরা পাইপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গর্তের নিচে কাটারের সামনের ছিদ্র দিয়ে বের হয় এবং কাটা মাটি সঙ্গে নিয়ে ওপরে উঠে আসে। ফলে কোনো বিরতি ছাড়া গর্ত করা যায়, আলগা মাটি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। এই তরল ঘন ও ভারী হয় যেন তা গর্তের মাটির ওপরে চাপ দিয়ে আটকে রাখে। ফলে গর্ত যত গভীর হোক না কেন, পাশ থেকে মাটি ধসে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় না। গর্ত খোঁড়ার পর পাইপ ও বিট বের করা হয় এবং টেকসই পাইপ নামানো হয়। সে পাইপ গর্তের তলদেশ পর্যন্ত নামিয়ে সিমেন্ট দিয়ে ভরাট করা হয়। ফলে একটা গভীর গর্ত লম্বা সময়ের (২০-৫০ বছর) জন্য দৃঢ় ও টেকসই থাকে।

যদি কোনো জায়গায় খনিজের উপস্থিতি শনাক্ত হয় এবং বিশ্লেষণে উত্তোলনযোগ্য হয় তাহলে যে গভীরতায় খনিজ আছে সেখানে বিস্ফোরক দিয়ে কেসিং, সিমেন্ট ও খনিজের স্তরের ভেতরে ছিদ্র তৈরি করা হয়। সেখান থেকেই কেসিং দিয়ে খনিজ ওপরে ওঠে এবং উৎপাদনের জন্য প্রস্ত্তত হয়। খননকালে কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গর্ত থেকে খনিজ বের হয়ে আসে। একে বলে ব্লো-আউট। ব্লো-আউট যে কত ভয়ংকর তা আমরা দেখেছি মাগুরছড়া ও টেংরাটিলাতে। একে ঠেকাতে রিগে অনেক ধরনের নিরাপত্তা সিস্টেম থাকে। কিন্তু যেহেতু মাটির নিচে আসলে কী অপেক্ষা করছে তা অনেকটা অজানা এবং তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি, তাই এই অপরিসীম ঝুঁকি নিয়েই একের পর এক গর্ত খনন করে যায় রিগগুলো।

হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র
হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র

রিগ নানা রকমের হতে পারে। এগুলোকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: স্থলভাগের রিগ ও জলভাগের রিগ। স্থলভাগের রিগের মধ্যে কিছু বিশাল ট্রাকের ওপরে বসানো থাকে এবং খুব সহজে স্থানান্তর করা যায়। কিছু রিগ আবার বেশ বড় হয় এবং তা আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত করে স্থানান্তর করা হয় এবং পরে জোড়া লাগানো হয়। তবে সবচেয়ে বিচিত্র ধরনের রিগগুলো চোখে পড়ে সমুদ্রে। এর মধ্যে আছে গভীর ও অগভীর পানির রিগ। অগভীর পানির রিগগুলোর কিছু ভাসমান আর কিছু স্থির। স্থির রিগগুলো তাদের পায়ের সাহাযে্য সমুদ্রে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে পারে। গভীর পানির রিগগুলোর সবগুলোই সাধারণত ভাসমান। কিছু আবার দানব আকৃতির রিগ জাহাজের ওপরে বসানো থাকে, এদের বলে ড্রিলশিপ। এগুলোকে নোঙর বা অত্যাধুনিক ডায়নামিক পজিশনিং সিস্টেম দিয়ে সামুদ্রিক সেÊাতের বিপরীতে এক জায়গায় ধরে রাখা হয়। ফলে সমুদ্রের গভীরে গর্ত খুঁড়তে খুব একটা সমস্যা হয় না। এই রিগগুলো হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। গর্ত খোঁড়ার জন্য যা যা লাগবে তা তো থাকেই, থাকে নিজস্ব জেনারেটর, জিম, আইসক্রিম মেশিন, বিনোদনের সরঞ্জাম এবং ক্রুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ক্রুরা এসব রিগে আসা-যাওয়া করে।

জ্বালানি সম্পদ আহরণ পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম। কিন্তু তার পরও বহু প্রতিষ্ঠান এবং মানুষ এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কেননা বর্তমান বিশ্বকে চালিয়ে নিতে এর কোনো বিকল্প নেই। আর এ রকমই চলতে থাকবে যত দিন না এর কোনো কার্যকর বিকল্প আবিষ্কৃত হবে।

লেখক: খনন প্রকৌশলী