সমস্যা

 দুশ্চিন্তায় অফিসের কাজে মন বসাতে পারছে না ফাহিম। হাতের সামনে রাখা ফাইলগুলো টেবিলের এক কোনায় রেখে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। তবুও ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই ভাবতে থাকে—মাসের এই শেষ সময় এতগুলো টাকা পাবে কোথায় সে? সামনে ছেলেটার পরীক্ষা। সেটার ফি, বাবার ওষুধ, বাড়িভাড়া, কারেন্ট বিল—এত কিছুর মধ্যে তার মিলছে না অফিসের হিসাব। হাজার বিশেক টাকার ঘাটতি। অথচ হিসাব অনুযায়ী আরও হাজার বিশেক টাকা ক্যাশে থাকার কথা। না মেলাতে পারলে বেতন থেকে কাটা হবে।

‘কী ফাহিম সাহেব! চাকরিতে ঢুকেছেন ছয় মাসও পেরোল না, এর মধ্যেই হিসাবে গন্ডগোল বাঁধিয়ে বসে আছেন?’ চেয়ারে বসতে বসতে কথাগুলো বললেন আজহার সাহেব। তিনি সব সময় পান খান। কথা বলার সময় পানের রস গড়িয়ে পড়ে। তাঁকে দেখেই বিরক্ত লাগতে শুরু করল ফাহিমের। কথার উত্তর দিল না সে।

আজহার সাহেব মুখভর্তি পান নিয়ে কথা চালিয়ে গেলেন, ‘আরে, হয় হয়। প্রথম প্রথম ওমন হিসাব মেলানোই কষ্টের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। তা নিয়ে এত ভাবছেন কেন বলুন? সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকবে।’ কথা শুনতে একটুও ভালো লাগছিল না ফাহিমের। নানা রকম সমস্যায় তার এমনিই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এর ওপর উনি এসেছেন খোঁচা মেরে কথা শোনাতে। হিসাবের ফাইলটা নিয়ে উঠে পড়ে ফাহিম। আজহার সাহেবকে বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘আজকে আমার তাড়া আছে। উঠছি।’ আজহার সাহেব একগাল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ তাড়ায় আছেন থাকুন, তবে হিসাব মেলাতে গিয়ে আবার আকাশের তারা হয়ে যাবেন না যেন। হা হা হা!’ আজহার সাহেবের কটুক্তি গায়ে না মেখে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল ফাহিম।

বিকেলের দিকে উত্তরার এই পার্কটায় অনেক রকমের মানুষ দেখা যায়। ফাহিম অফিস থেকে মাঝেমধ্যেই এই পার্কটায় এসে বসে থাকে। বেশ সুন্দর, ছিমছাম জায়গাটা। একদল ছেলেকে ফুটবল খেলতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফাহিম।

‘চা নিবেন?’ ছোকরা ধরনের এক চা-বিক্রেতা জিজ্ঞেস করে ফাহিমকে।

‘না’। বিরস মুখে জবাব দেয় ফাহিম। সে এখানে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে এসেছে, চা পানের মতো অলস সময় পার করতে নয়। মাঝেমধ্যেই ফাহিমের মনে হয় একটা নির্ভার জীবন যদি পার করতে পারত সে! কিংবা তার সব সমস্যা যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া যেত, ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে।

চা-বিক্রেতা তার পাশে বসে পড়ে। দুজনের কেউই আর কোনো কথা বলে না। তারপর ফাহিমই বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, দে এক কাপ চা।’ চা বানানো ছেলেটাকে লক্ষ করে ফাহিম। লম্বা, ছিপছিপে শরীর। মাথায় কোঁকড়া চুল। তামাটে গায়ের রং। কাঁধে চা বানানোর জন্য দুটো ফ্লাস্ক, চিনি আর কনডেন্সড মিল্কের কৌটা পলিথিনের ব্যাগে মোড়ানো দেখা যাচ্ছে। আজকাল তো এমনভাবে চা বানিয়ে বিক্রি করতে কাউকে দেখাই যায় না। ছেলেটার চা বানানোর দিকে মনোযোগ দেয় ফাহিম। নিখুঁতভাবে চা বানাচ্ছে ছেলেটা। চায়ের কাপে ঠিক এক চামচ দুধ, একটু চিনি দেয় সে। সব কেমন মাপা মাপা। চা বানাতে গিয়ে চিনি যে একটু বেশি বা কম হবে এমন না। মাপা হিসাব এদের। সবারই হিসাবের ঠিক থাকে, শুধু তারই হিসাবে গন্ডগোল!

‘স্যার, চা নেন।’ ছেলেটার ডাকে ধ্যান ভাঙে ফাহিমের।

চায়ের বিল মিটিয়ে দেয় সে। চা-বিক্রেতা ছেলেটা বিল নিয়েও তার পাশেই বসে রইল। তার বোধ হয় তাড়া নেই।

ফাহিম একটু আলাপ করতে জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি কোথায়?’ ছেলেটা কথার উত্তর দেয় না। ফাহিম একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে! তোর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করছি বলছিস না কেন?’ ছেলেটা উঠে পড়ে। যাওয়ার আগে আবার মুখের ওপর বলে যায়, ‘আমার বাড়ি কই তা দিয়া আপনের কাজ কী? চা খান আর নিজের কাজ করেনগা।’  ছেলেটার ঔদ্ধত্য দেখে অবাক হয়ে যায়। যা বাবা! এমন চা-বিক্রেতাও হয়! বিরস মুখে চায়ে চুমুক দেয় ফাহিম। চা-টা স্বাদেও হয়েছে কেমন। তিতকুটে ধরনের।

‘চা নিবেন?’ ডাক শুনে মুখ ঘুরিয়ে ফাহিম দেখল সেই চা-ওয়ালা ছোকরাটাই। ফাজলামির আর জায়গা পায় না? আগের কাপ চা-ই এখনো শেষ হলো না, এর মধ্যে আবার জিজ্ঞেস করছে, ‘চা নিবেন?’ ফাজিল ছোকরাটাকে কষে একটা চড় দিতে ইচ্ছা করল ফাহিমের।

ছোকরাটা আবার পাশে বসল ফাহিমের। এবার মেজাজ খারাপ করে ফাহিম মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘ফাইজলামি করিস? মাত্রই তো তোর কাছ থেকে চা নিলাম।’

ছেলেটা বিরস মুখে জবাব দিল, ‘একটু আগে আপনার কাছে চা বেচছি? খিয়াল নাই। মাথার নাই ঠিক বুঝলেন। এক লোকের সব সমস্যা আমার মাথায় দিয়া দিছে তো!’

ফাহিম একটু সরে বসল। পাগলদের কাছ থেকে এক শ হাত দূরে থাকা উচিত। ফাহিম অবশ্য এক শ হাত দূরে সরতে পারল না। ছেলেটার প্রলাপ তার কানে আসতে লাগল, ‘বুঝলেন, এক লোকের কাছে গেছি চা বেচতে। ব্যাটা আমারে এক শ টেকা ধরায় দিয়া কইল, “আমার সমেস্যাগুলা তোরে দিয়া দিলাম। আর এই নে তোর জইন্যে এক শ টাকা।” আমি তো ভাবছি পাগল। এক শ টাকা রাইখ্যা দিছি। এর পর থেইকাই দুনিয়ার সমেস্যা নিয়া ঘুরতাছি। সমেস্যায় কিছুই খিয়াল থাকে না।’

ফাহিম উঠে পড়ল। এ রকম পাগলের প্রলাপ শোনার মতো সময় তার নেই। তাকে হিসাব মেলাতে হবে। বিশ হাজার টাকার হিসাব। সমস্যা যদি সত্যিই দেওয়া যেত তাহলে তার এই সমস্যাগুলো সে আজহার সাহেবের ওপর চাপিয়ে দিত। কিংবা এই যে পার্কে বসে থাকা এই দম্পতিকে কিংবা ফুটবল খেলতে থাকা ওই ছেলেটাকে। সমস্যা আবার দেওয়া যায় নাকি!

হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে চলে এল সে। সেই চা-ওয়ালা ছোকরাটাও তার পেছন পেছন আসতে লাগল। একা একাই বলতে লাগল ছেলেটা, ‘স্যার একজনের সমেস্যা অন্যরে সুন্দর মতো চাপায় দেওয়া যায়।’

ফাহিম পেছন ফিরে ধমকে উঠল, ‘এই, সমস্যা কী তোর? পেছন পেছন আসছিস কেন?’

ছেলেটা হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘আমার সমেস্যা হইল আমি অন্যের সমেস্যা নিয়া ঘুরতেছি। এমনকি অন্যের সমেস্যা যে কী সেইটাও আমি বুঝতে পারি। আপনার সমেস্যা যেমন বিশ হাজার টেকা। স্যার, আমার সমেস্যাটা আপনি নিবেন?’

কী মুশকিলে পড়া গেলরে বাবা! পাগল ছেলেটার শেষ কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল ফাহিম। তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করল সে। পেছন থেকে ছেলেটা বলে যেতে লাগল, ‘আপনের সমেস্যাটা অন্য কাউরে দিয়া দেন। আর আমার সমেস্যাটা কি নিবেন স্যার?’ ফাহিম ভাবল একবার বলে, ‘তোর সমেস্যা তুই অন্যদের দে।’ কিন্তু বলতে গিয়েও বলল না সে।

বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোতে লাগল ফাহিম। সত্যি যদি তার সমস্যা কাউকে দেওয়া যেত? কাকে দিত সে? রিকশায় করে একটা ছোট ছেলে আর তার মা যাচ্ছে। ছেলেটার হাতে কতগুলো বেলুন আর আইসক্রিম। ওদের দিকে চোখ পড়তেই অস্বস্তির একটা অনুভূতি হয় ফাহিমের। ছেলেটার মায়ের এখন দশ হাজার টাকার প্রয়োজন। টাকার খোঁজে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছে সে। ফাহিম স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার সমস্যা। সে চোখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। একটা রিকশাওয়ালার দিকে নজর পড়ল তার। রিকশাওয়ালা তার বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছে না, সেটা নিয়ে বেচারা চিন্তিত। একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখল ফাহিম। ছেলেটার কাঁধে কদিন ধরেই ভীষণ যন্ত্রণা। একটা বাস পাশ দিয়ে চলে গেল ফাহিমের। বাসের জানালার পাশে বিষণ² এক মেয়েকে দেখল সে। মেয়েটার চাকরির দরকার, চাকরি মিলছে না। ফাহিম অস্বস্তি নিয়ে ইতস্তত এ দিক-ও দিক তাকাতে লাগল। রাস্তার পাশের টঙের দোকানে এক বৃদ্ধ বসে আছে। বৃদ্ধ ভাবছে তার নাতির পেটের অসুখটা সারছে না কেন? সবার সমস্যা বুঝতে পারছে ফাহিম। অসহ্য লাগতে শুরু করল তার।

সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। সবাই নানা রকম সমস্যা নিয়ে ঘুরছে। আর ফাহিম সবার সমস্যা বুঝতে পারছে। বড় অস্বস্তি হয় ফাহিমের। না, সে তার সমস্যা কাউকেই দেবে না। নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু আপাতত অন্যের সমস্যা আর বুঝতে চায় না সে। এই নতুন সমস্যা থেকে বের হতে চায় সে। নতুন এই সমস্যা নিয়ে হাঁটতে থাকে ফাহিম।

অলংকরণ: স্বপন চারুশি