ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি

ডেসিম্যালের পরে আবার একটা ভেঙ্কুলাম, এর সঙ্গে ভগ্নাংশ। এমন জটিল জিনিসকে সরল করা অন্তত আমার কাজ নয়। পটলডাঙ্গায় থাকি আর পটোল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাই—এসব গোলমালের মধ্যে পা বাড়িয়ে আমার কী দরকার?

পণ্ডিতমশায় যখন দাঁত খিঁচিয়ে লু-লুঙকে মাথায় ঢোকাতে চেষ্টা করেন, তখন আমি আকুলভাবে ‘ঘিনুন’ আর ‘আলু’ প্রত্যয়ের কথা ভাবতে থাকি। ওর সঙ্গে যদি ‘দাদখানি চাল’ প্রত্যয় থাকত—তাহলে আর কোনো দুঃখ থাকত না। তবে ‘চাঁটি’ আর ‘গাঁট্টা’ প্রত্যয়গুলো বাদ দেওয়া দরকার বলেই আমার ধারণা।

কিন্তু অঙ্ক আর সংস্কৃতের ধাক্কা যদি বা সামলানো যায়—ক্রিকেট খেলা ব্যাপারটা আমার কাছে স্রেফ রহস্যের খাসমহল। ‘ক্রিকেট’ মানে কী? বোধ হয় ঝিঁঝি? দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে চাঁদিতে ফোসকা পড়িয়ে ওসব ঝিঁঝি খেলা আমার ভালো লাগে না। মাথার ভেতর ঝিঁঝি করতে থাক আর মনে হয়—মস্ত একটা হাঁ করে কাছে কেউ ঝিঁঝিট খাম্বাজ গাইছে। অবশ্য ঝিঁঝিট খাম্বাজ কী, আমার জানা নেই—তবে আমার মনে হয়, ক্রিকেট অর্থাৎ ঝিঁঝি খেলার মতোই সেটাও ভয়াবহ।

অথচ কী গেরো দ্যাখো! পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের পক্ষ থেকে আমাকে ক্রিকেট খেলতে হচ্ছে। গোড়াতেই কিন্তু বলে দিয়েছিলুম—ওসব আমার আসে না। আমি খুব ভালো ‘চিয়ার আপ’ করতে পারি, দুই-এক গেলাস লেমন স্কোয়াশও নয় খাব ওদের সঙ্গে—এমনকি লাঞ্চ খেতে ডাকলেও আপত্তি করব না। কিন্তু ওসব খেলা-টেলার ভেতরে আমি নেই—প্রাণ গেলেও না।

কিন্তু প্রাণ যাওয়ার আগেই কান যাওয়ার জো! আমাদের পটলডাঙার টেনিদাকে মনে আছে তো? সেই—খাঁড়ার মতো উঁচু নাক আর রণডম্বরুর মতো গলা—যার চরিতকথা তোমাদের অনেকবার শুনিয়েছি? সেই টেনিদা হঠাৎ গাঁক-গাঁক করে আর আধমাইল লম্বা হাতখানা আমার কানের দিকে বাড়িয়ে দিলে।

—খেলবিনে মানে? খেলতেই হবে তোকে। বল করবি, ব্যাট করবি, ফিল্ডিং করবি ধাঁই করে, আছাড় খাবি, মানে যা যা দরকার সবই করবি। সই না করিস, তোর ওই গাধার মতো লম্বা লম্বা কান দুটো একবারে গোড়া থেকে উপড়ে নেব—এই পাকা কথা বলে দিলুম!

গন্ডারের মতো নাকের চেয়ে গাধার কান ঢের ভালো, আমি মনে মনে বললাম। গন্ডারের নাক মানে লোককে গুঁতিয়ে বেড়ানো, কিন্তু গাধার কান ঢের কাজে লাগে—অন্তত চটপট করে মশা-মাছি তো তাড়ানো যায়!

কিন্তু সেই কান দুটোকে টেনিদার হাতে, বেহাত হতে দিতে আমার আপত্তি আছে। কী করি, খেলতে রাজি হয়ে গেলাম।

তা, প্যান্ট-ট্যান্ট পরতে নেহাত মন্দ লাগে না। বেশ কায়দা করে বুক চিতিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ হতভাগা ক্যাবলা বললে, তোকে খাসা দেখাচ্ছে প্যালা!

—সত্যি?

একগাল হেসে ওকে একটা চকলেট দিতে যাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললে, বেগুনখেতে কাকতাড়ুয়া দেখেছিস? ওই যে, মাথায় কেলে হাঁড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকে? হুবহু তেমনি মনে হচ্ছে তোকে। আমি ক্যাবলাকে একটা চাঁটি দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আর দরকার হলো না। হাবুল সেন ঢাকাইয়া ভাষায় বললে, ‘আর তোরে ক্যামন দেখাইতে আছে? তুই তো বজ্রবাঁটুল—পেন্টুল পইরা য্যান চালকুমড়া সাজছস!’

ক্যাবলা স্পিকটি নট। একেবারে মুখের মতো। আমি খুশি হয়ে চকলেটটা হাবুল সেনকেই দিয়ে দিলাম।

হঠাৎ ক্যাপ্টেন টেনিদার হুংকার শোনা গেল—এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্যারেন্ডা ভাজছিল প্যালা? প্যাড পর, দস্তানা পর, তোকে আর ক্যাবলাকেই যে আগে ব্যাট করতে হবে!

আমাকে দিয়েই শুরু! পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলেটা ধপাৎ করে লাফিয়ে উঠল একবার।

টেনিদা বললে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? যেই বল আসবে ঠাঁই করে পিটিয়ে দিবি। অ্যায়সা হাঁকডাবি যে এক বলেই ওভার বাউন্ডারি—পারবি না?

—পারা যাবে বোধ হয়, কান-টান চুলকে আমি জবাব দিলাম।

—বোধ হয় নয়, পারতেই হবে। তাড়াতাড়ি যদি আউট হয়ে যাস, তোকে আর আমি আস্ত রাখব না। মনে থাকবে?

এর মধ্যে হাবুল সেন আমার পায়ে আবার প্যাড পরিয়ে দিয়েছে, সেইটে পরে, হাতে ব্যাট নিয়ে দেখি নড়াচড়া করাই শক্ত!

কাতর স্বরে বললাম: হাঁটতেই পারছি না যে! খেলব কী করে?

—তুই হাঁটতে না পারলে আমার বয়েই গেল! টেনিদা বিচ্ছিরি রকম মুখ ভ্যাংচাল: বল মারতে পারলে আর রান নিতে পারলেই হলো!

—বা রে, হাঁটতেই যদি না পারি, তবে রান নেব কেমন করে?

—মিথ্যে বকাসনি প্যালা, মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার। হাঁটতে না পারলে দৌড়ানো যায় না? কেন যায় না, শুনি? তাহলে মাথা না থাকলেও কী করে মাথাব্যথা হয়? নাক না ডাকলেও লোকে ঘুমোয় কী করে? যা যা, বেশি ক্যাঁচম্যাচ করিসনি! মাঠে নেমে পড়!

একেবারে মোক্ষম যুক্তি।

নামতেই হলো অগত্যা। খালি মনে মনে ভাবছি প্যাড-ফ্যাডসুদ্ধ পড়ে না যাই! ব্যাটাকে মনে হচ্ছে ভীমের গদার মতো ভারী—আগে থেকেই তো কবজি টনটন করছে! আমি ওটাকে হাঁকড়াব, না ওটাই আমায় আগে হাঁকড়ে দেবে, সেইটেই ঠাহর করতে পারছি না।

তাকিয়ে দেখি, পেছনে আর দুই পাশে খালি চোরাবাগান টাইগার ক্লাব। ওদের সঙ্গেই ম্যাচ কি না!

কিন্তু এ আবার কী রকম ঝিঁঝি খেলা! ফুটবল তো দেখেছি সমানে-সমানে লড়াই, এ-ওর পায়ে ল্যাং মারছে, সে তার মাথায় ঢুঁ মারছে, আর বল সিধে এসপার-ওসপার করার জন্য দুই গোলকিপার দাঁড়িয়ে আছে ঘুঘুর মতো। এ পক্ষের একটা চিত হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও পক্ষের আর একটা কাত। সে এক রকম মন্দ নয়।

কিন্তু এ কী কাপুরুষতা! আমাদের দুজনকে কায়দা করার জন্য ওরা ১১ জন! সেই সঙ্গে আবার দুটো আম্পায়ার! তাদের পেটে-পেটে যে কী মতলব, তাই-বা কে জানে! আম্পায়ারদের গোল-গোল চোখ দেখে আমার তো প্রায় ভ্যাম্পায়ার বলে সন্দেহ হলো!

তার পরে লোকগুলোর দাঁড়িয়ে থাকার ধরন দ্যাখো একবার! কেমন নাড়ুগোপালের মতো নুলো বাড়িয়ে উবু হয়ে আছে, যেন হরির লুটের বাতাসা ধরবে! সব দেখে-শুনে আমার রীতিমতো বিচ্ছিরি লাগল।

এই রে, বল ছোড়ে যে! ব্যাট নিয়ে হাঁকড়াতে যাব, প্যাড-ট্যাড নিয়ে উলটে পড়ি আর কী! বলটা কানের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল দমদম বুলেটের মতো। একটু হলেই কানটা উড়িয়ে নিত। একটা ফাঁড়া তো কাটল। কিন্তু ও কী? আবার ছোড়ে যে!

জয় মা ফিরিঙ্গি পাড়ার ফিরিঙ্গি কালী! যা হোক, একটা কিছু এবার হয়ে যাবে। বলি দেওয়ার খাঁড়ার মতো ব্যাটটাকে মাথার ওপর তুলে হাঁকিয়ে দিলাম। বলে লাগল না...স্রেফ পড়ল আমার হাঁটুর ওপরে। নিজের ব্যাটাঘাতে ‘বাপ্রে’ বলে বসে পড়তেই দেখি, বলের চোটে স্টাম্প-ফাম্পগুলো কোথায় উড়ে বেরিয়ে গেছে।

—আউট, আউট!

চারদিকে বেদম চিৎকার। আম্পায়ার আবার মাথার ওপরে একটা হাত তুলে জগাই-মাধাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে।

কে আউট হলো? ক্যাবলা বোধ হয়? আমি তক্ষুনি জানতাম, আমাকে কাকতাড়ুয়া বলে গাল দিয়েছে, আউট না হয়ে যায় কোথায়!

হাঁটুর চোটটা সামলে নিয়ে ব্যাট দিয়ে স্টাম্পগুলো সব ঠিক করতে যাচ্ছি, হঠাৎ হতচ্ছাড়া আম্পায়ার বলে বসল, তুমি আউট, চলে যাও।

আউট? বললেই হলো? আউট হওয়ার জন্যই এত কষ্ট করে প্যাড আর পেন্টলুন পরেছি নাকি? আচ্ছা দ্যাখো একবার! বয়ে গেছে আমার আউট হতে!

বললাম, আমি আউট হব না! এখন আউট হওয়ার কোনো দরকার দেখছি না আমি!

আমি ঠিক বুঝেছিলাম ওরা আম্পায়ার নয়, ভ্যাম্পায়ার। কুইনিন চিবোনোর মতো যাচ্ছেতাই মুখ করে বললে: দরকার না থাকলেও তুমি আউট হয়ে গেছ। স্টাম্প পড়ে গেছে তোমার।

—পড়ে গেছে তো কী হয়েছে। আমি রেগে বললাম, আবার দাঁড় করিয়ে দিতে কতক্ষণ? ওসব চালাকি চলবে না স্যার, এখনো আমার ওভার-বাউন্ডারি করা হয়নি।

কেন জানি না, চারদিকে ভারি যাচ্ছেতাই একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেল। চোরাবাগান ক্লাবের লোকগুলোই বা কেন যে এ রকম দাপাদাপি করছে, আমি কিছু বুঝতে পারলুম না।

তার মধ্যে আবার চালকুমড়ো ক্যাবলাটা ছুটে এল ওদিক থেকে।

—চলে যা, চলে যা প্যালা! তুই আউট হয়ে গেছিস।

আর কতক্ষণ ধৈর্য থাকে এ অবস্থায়? আমি চেঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে থাকে তুই আউট হ-গে। আমি এখন ওভার-বাউন্ডারি করব!

আমার কানের কাছে সবাই মিলে তখন সমানে কিচিরমিচির করছে। আমি কান দিতাম না, যদি না কটাং করে আমার কানে টান পড়ত।

তাকিয়ে দেখি, টেনিদা।

ধাঁই করে আমার কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে কানে একটা চিড়িং মেরে দিল, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

—যা, যা উল্লুক! বেরো মাঠ থেকে। খুব ওস্তাদি হয়েছে, আর নয়।

রামছাগলের মতো মুখ করে অগত্যা আমার চলে যেতে হলো। মনে মনে বললাম, আমাকে আউট করা! আউট কাকে বলে সে আমি দেখিয়ে দেব!

গিয়ে তো বসলাম, কিন্তু কী তাজ্জব কাণ্ড! আমাদের দেখিয়ে দেওয়ার আগেই চোরাবাগানের টাইগার ক্লাব আউট দেখিয়ে দিচ্ছে। কারোরও স্টাম্প উল্টে পড়েছে, পেছনে যে লোকটা কাঙালি-বিদায়ের মতো করে হাত বাড়িয়ে বসে আছে, সে আবার খুটুস করে স্টাম্প লাগিয়ে দিচ্ছে। কেউ-বা মারার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বল লুফে নিচ্ছে। খালি আউট-আউট-আউট! এ আবার কী কাণ্ড রে বাবা!

আমাদের পটলডাঙা থান্ডার ক্লাব ব্যাট বগলে যাচ্ছে আর আসছে। এমন যে ডাকসাইটে টেনিদা, তারও বল একটা রোগাপটকা ছেলে কটাৎ করে পাকড়ে নিলে। হবেই তো! এদিকে মোটে দুজন, ওদিকে ১১, সেই সঙ্গে আবার দুটো আম্পায়ার। কোনো ভদ্দরলোকে ঝিঁঝি খেলতে পারে কখনো!

ওই চালকুমড়ো ক্যাবলাটাই টিকে রইল শেষতক। কুড়ি না একুশ রান করল বোধ হয়। ৫০ রান না পেরোতেই পটলডাঙা থান্ডার ক্লাব বেমালুম সাফ।

এইবার আমাদের পালা। ভারি খুশি হলো মনটা। আমরা ১১ জন এবারে তোমাদের নিয়ে পড়ব। আম্পায়ার দুটোও দেখি ওদের দল ছেড়ে আমাদের সঙ্গে এসে ভিড়েছে। কিন্তু ওদের মতলব ভালো নয় বলেই আমার বোধ হলো।

ক্যাপ্টেন টেনিদাকে বললাম, আম্পায়ার দুটোকে বাদ দিলে হয় না? ওরা নয় ওদের সঙ্গেই ব্যাট করুক।

টেনিদা আমাকে রদ্দা মারতে এল। বললে, বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা? ওখানে দাঁড়া। একটা ক্যাচ ফেলেছিস কী ঘ্যাঁচ করে কান কেটে দেব। ব্যাট তো খুব করেছিস, এবার যদি ঠিকমতো ফিল্ডিং করতে না পারিস, তাহলে তোর পালাজ্বরের পিলে আমি আস্ত রাখব না।

হাবুল সেন বল করতে গেল।

প্রথম বলেই, ওরে বাপ রে! টাইগার ক্লাবের সেই রোগা ছোকরাটা কী একখানা হাঁকড়ালে! বোঁ করে বল বেরিয়ে গেল, একদম বাউন্ডারি। ক্যাবলা প্রাণপণে ছুটেও রুখতে পারল না।

পরের বলেও আবার সেই হাঁকড়ানি। তাকিয়ে দেখি, কামানের গুলির মতো বলটা আমার দিকে ছুটে আসছে।

একটু দূরেই ছিল আমাদের পাঁচুগোপাল। চেঁচিয়ে বললে, প্যালা—ক্যাচ—ক্যাচ—

—ক্যাচ! ক্যাচ! দূরে দাঁড়িয়ে ওরকম সবাই-ই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করতে পারে। ওই বল ধরতে গিয়ে আমি মরি আর কী! তার চেয়ে বললেই হয়, পাঞ্জাব মেল ছুটছে প্যালা লুফে নে? মাথা নিচু করে আমি চুপ করে বসে পড়লাম, আবার বল বাউন্ডারি পার।

হইহই করে টেনিদা ছুটে এল।

—ধরলিনে যে?

—ও ধরা যায় না!

—ধরা যায় না? ইশ্, এমন চমৎকার ক্যাচটা, এক্ষুনি আউট হয়ে যেত!

—সবাইকে আউট করে লাভ কী? তাহলে খেলবে কে? আমরাই তো আউট হয়ে গেছি, এখন খেলুক না ওরা!

—খেলুক না ওরা! টেনিদা ভেংচি কাটল, তোর মতো গাড়লকে খেলায় নামানোই আমার ভুল হয়েছে! যা যা, বাউন্ডারি লাইনে চলে যা!

চলে গেলাম। আমার কী! বসে বসে ঘাসের শিষ চিবুচ্ছি। দুটো-একটা বল এদিক-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল, ধরার চেষ্টা করেও দেখলাম। বোঝা গেল, ওসব ধরা যায় না। হাতের তলা দিয়ে যেমন শোলমাছ গলে যায়, তেমনি সুড়ুত-সুড়ুত করে পিছলে বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে যেতে লাগল।

আর শাবাশ বলতে হবে চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের ওই রোগা ছোকরাকে! ডাইনে মারছে, বাঁয়ে মারছে, চটাং করে মারছে, শাঁই করে মারছে, ধাঁই করে মারছে। একটা বলও বাদ যাচ্ছে না। এর মধ্যেই ৪২ রান করে ফেলেছে একাই। দেখে ভীষণ ভালো লাগল আমার। পকেটে চকলেট থাকলে দুটো ওকে আমি খেতে দিতাম।

হঠাৎ বল নিয়ে টেনিদা আমার কাছে হাজির।

—ব্যাটিং দেখলাম, ফিল্ডিং দেখছি। বল করতে পারবি?

এতক্ষণ ঝিঁঝি খেলা দেখে আমার মনে হয়েছিল, বল করাটাই সবচেয়ে সোজা। এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম, খুব পারব। এ আর শক্তটা কী?

—ওদের এই রোগাপটকা গোসাঁইকে আউট করা চাই। পারবিনে?

—এক্ষুনি আউট করে দিচ্ছি, কিছু ভেবো না!

আমি আগেই জানি, আম্পায়ার দুটোর মতলব খারাপ। সেই জন্যই আমাদের দল থেকে ওদের বাদ দিতে বলেছিলাম। টেনিদা কথাটা কানে তুলল না। যেই প্রথম বলটা দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে বললে, নো বল!

নো বল তো নো বল, তোদের কী! বলতেও যাচ্ছিলাম, কিন্তু গোসাঁই দেখি আবার ধাঁই করে হাঁকড়ে দিয়েছে, বাউন্ডারি তো তুচ্ছ। একেবারে ওভার-বাউন্ডারি!

আর চোরাবাগান টাইগার ক্লাবের সে কী হাততালি! একজন তো দেখলাম আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে!

এইবার আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে আগুন জ্বলে গেল। মাথায় টিকি নেই। যদি থাকত, নিশ্চয় তেজে রেফের মতো খাড়া হয়ে উঠত। বটে, ডিগবাজি! আচ্ছা দাঁড়াও! বল হাতে ফিরে যেতেই ঠিক করলাম, এবার গোসাঁইকে একেবারে আউট করে দেব! মোক্ষম আউট!

প্যাডটা বোধ হয় ঢিলে হয়ে গেছে। গোসাঁই পেছন ফিরে সেটা বাঁধছিল। দেখলাম, এ সুযোগ। ব্যাট নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালে কিছু করতে পারব না—এই সুযোগেই কর্ণবধ!

মামার বাড়িতে আম পেড়ে পেড়ে হাতের টিপ হয়ে গেছে, আর ভুল হলো না। আম্পায়ার না ভ্যাম্পায়ার হাঁ-হাঁ করে ওঠার আগেই বোঁ করে বল ছুড়ে দিলাম।

নির্ঘাত লক্ষ্য! গোসাঁইয়ের মাথায় গিয়ে খটাং করে বল লাগল। সঙ্গে সঙ্গে—‘ওরে বাবা!’ গোসাঁই মাঠের মধ্যে ফ্ল্যাট!

আউট যাকে বলে! অন্তত এক সপ্তার জন্য বিছানায় আউট!

আরে, এ কী, এ কী! মাঠসুদ্ধ লোক তেড়ে আসছে যে! ‘মার মার’ করে আওয়াজ উঠছে যে! অ্যাঁ—আমাকে নাকি?

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। কান ঝিঁঝি করছে, প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে এবারে টের পাচ্ছি—আসল ঝিঁঝি খেলা কাকে বলে!

অলংকরণ: তুলি