কেঁচো খুঁড়তে অ্যানাকোন্ডা

গগন যে তাদের পাড়ার মোটামুটি একজন ছোটখাটো গোয়েন্দা, সেটা পাড়ার সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছে।

কিন্তু মুশকিল হয়েছে শেষ কেসটা নিয়ে, শেষ কেসটা ছিল একটা মুরগি চুরিসংক্রান্ত। তাদের পাড়ার এক আন্টি শখ করে মুরগি পালেন, কিন্তু হঠাৎ করে তার মুরগি চুরি হতে শুরু করল। প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে একটা করে মুরগি চুরি হচ্ছে। তিনি হদিস পাচ্ছেন না। তিনি এসে গগনকে ধরলেন।

      গগন বাপ, দেখ তো চোরটাকে ধরতে পারিস কি না। তোকে নগদ ৫০০ টাকা দেব।

      টাকা লাগবে না আন্টি। আমি দেখছি...। গম্ভীর হয়ে গগন বলে।

তারপর তো মাঠে নেমে পড়ল গগন। আন্টির ১৭টা মুরগির পায়ে রঙিন টেক্সট মার্কার দিয়ে দাগ দিয়ে রাখল। তারপর গেল বাজারের মুরগির আড়তে। আড়তের মালিক আজমল ভাই তার চেনা। তাকে গিয়ে বিষয়টা খুলে বলল, কেউ তার কাছে মুরগি বেঁচতে এলে খেয়াল করতে যে পায়ে রঙিন দাগ আছে কি না। দাগ থাকলে লোকটাকে চিনে রাখতে।

পরদিনই রহস্য ফাঁস হয়ে গেল। আজমল ভাই বলল, ‘কী মিয়া, মুরগির ট্যাঙে ছবি আঁকা শুরু করছ নাকি?’

      কেউ কী এসেছিল আজমল ভাই ?

      হ, আইছিল, এই পাবলিক তো পেরাই আয় মুরগি বেঁচতে। এই যে মোবাইলে ছবি তুইলা রাখছি। হে অবশ্য টের পায় নাই।

মোবাইলে ছবি দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেল গগনের। এ যে আন্টির মেজো ছেলে রুবেল!

কী আর করা, বিষয়টা আন্টিকে জানায় গগন। পরে বের হয় আন্টির মেজো ছেলে শান্তশিষ্ট রুবেল, দেখলে কে বুঝবে যে সে তলে তলে নেশাখোর, নেশার দ্রব্য কিনতে প্রতিদিন একটা করে মুরগি হাপিস করছিল। এখন ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওই আন্টির বাসায় তুলকালাম কাণ্ড। রুবেল ভাই একফাঁকে গগনকেও থ্রেট করেছে তাকে দেখে নেবে বলে, সত্যি কথা বলতে কি, গগন একটু বেশ ভয়ে ভয়েই আছে, প্রফেশনাল হ্যাজার্ড বলে কথা। তার থেকেও বড় সমস্যা যেটা, পাড়ার বড় ভাইদের ফাজিল গ্রুপটা তাকে হঠাৎ করে ‘মুরগি গগন’ ডাকতে শুরু করেছে! এটা গগনের জন্য যথেষ্ট মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। কেউ কেউ ‘গোয়েন্দা গগন’ বলত আগে, তারাও এখন ‘মুরগি গগন’ বলা শুরু করেছে। গগন মোটামুটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে যাবে, তখন ঝড়ের বেগে রন্টু এসে হাজির—

      গগন দোস্ত, বিরাট সমস্যা।

      কী সমস্যা?

      তুই তো জানিস আমি কেঁচো পালি।

      কী পালিস?

      কেঁচো কেঁচো...আর্থ ওয়ার্ম।

      কই, আমি তো জানতাম না...কেন? কেঁচো পালিস কেন?

      সে কাহিনি পরে বলব...কিন্তু আমার পালা কোঁচো সব চুরি হয়ে যাচ্ছে।

      সরি। মাথা নাড়ে গগন।

      সরি বললি কেন?

      সরি বললাম...তুই নিশ্চয়ই এখন বলবি তোর চুরি হওয়া কেঁচোগুলো উদ্ধার করে দিতে বা সেই কেঁচোচোর কে ধরে দিতে।

      হ্যাঁ, সে জন্যই তো ছুটতে ছুটতে এলাম। তুই আমাদের পাড়ার গোয়েন্দা না?

      না দোস, সরি...এ লাইন আমি ছেড়ে দিয়েছি।

      কেন?

এবার একটু আগে না ফেলা দীর্ঘশ্বাসটা বেশ সময় নিয়ে ছাড়ে গগন। তারপর বলে, কারণ, ৩ নম্বর গলির আন্টির বাসার মুরগি চুরির ঘটনা সমাধানের পর আমাকে সবাই এখন ‘মুরগি গগন’ ডাকে। তোর কোঁচো কেস সমাধান করলে আমাকে ডাকতে শুরু করবে ‘কেঁচো গগন’। শুনতে ভালো লাগবে? বল?

বিষয়ের গুরুত্বটা রন্টু ঠিকই বুঝল। সে কিছু সময় চুপচাপ বসে রইল। তারপর সে গগনকে বোঝাল বিষয়টা টপ সিক্রেট থাকবে কেউ জানবেই না যে সে কেঁচো মিসিং কেস সমাধানে হাত দিয়েছে, নো বডি...শুধু রন্টু আর গগনই জানবে। শেষ পর্যন্ত গগন রাজি হলো রন্টুর পালা কেঁচো চুরির রহস্য সমাধানে।

   তার আগে বল তো তুই এত জিনিস থাকতে কেঁচো পালিস কেন?

   কারণ, কেঁচো হচ্ছে ‘নাইট ক্রলার’। অনেকে একে ‘ইকো সিসটেম ইঞ্জিনিয়ারও’ বলে। প্রকৃতিকে ওরা এত উপকার করে, তুই চিন্তাও করতে পারবি না...এই যে গাছপালা...মাটির নিচের ব্যাকটেরিয়া...রন্টুর ‘কেঁচোজ্ঞান’ দেখে ভেতরে ভেতরে চমৎকৃত হয় গগন, বেশ একটা শ্রদ্ধাও জাগে রন্টুর প্রতি। তবে না, শেষ পর্যন্ত সে অফিসিয়ালি রাজি হয়ে যায় রন্টুর কেঁচো চুরির সমাধান করতে।

সিনেমা, টিভি সিরিয়াল বা বই-পুস্তকের গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়...প্রথমে কোনো একটা কেস নিয়ে তারা গবেষণা করে। ঘটনার জায়গাটা রেকি করে একে-ওকে জেরা করে, তারপর ধীরে ধীরে মূল সমাধানে পৌঁছায়। কিন্তু গগনের ক্ষেত্রে পুরাই উল্টো, ফট করে সমাধানটাই আগে হয়ে যায়, মানে তার চোখে পড়ে যায়। যেমন: রন্টুর কেঁচো কেসটায় যেটা হলো, বিষয়টা নিয়ে সে ভাবতেও শুরু করেনি তখনো...যাচ্ছিল বাজারে। দেখে, রাইনখালী নদীর ( নদী না বলে এখন খাল বলাই ভালো। তবে জোয়ারের সময় প্রচণ্ড স্রোত) পাড়ে একটা গাছের আড়ালে বসে একটা লোক বসে মাছ ধরছে। তখনই তার মনে হল কেঁচো কী কাজে লাগে? সবচেয়ে আগে বড়শিতে মাছ ধরতে টোপ হিসেবে। তারপর...গগন কিছু না ভেবেই পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মাছ ধরতে বসা লোকটার কাছে। ঠিক যা ভেবেছিল তা-ই। লোকটার পাশে একটা গোল বাটিতে কিলবিল করছে কয়েকটা কেঁচো। এগুলো রন্টুর কেঁচো নাকি কে জানে। সে বলেই ফেলল: আঙ্কেল এই কেঁচোগুলো আপনারা কই পান?

লোকটা বিরক্তি নিয়ে তাকাল গগনের দিকে। ফিচ করে দাঁতের ফাক দিয়ে থুতু ফেলল বিশেষ কায়দায়, তারপর বলল, ‘তুমি তো মিয়া ভ্যাজালের পাবলিক।’

    কেন?

    মাছ ধরতে বইলে মানুষে মাছের খোঁজ করে কয়টা মাছ ধরলাম, কী সমাচার। তুমি দেখি কেঁচোর খোঁজ করতাছ। ঘটনা কী?

গগন অপ্রস্ত্তত হয়ে যায়। লোকটা আবার মাছ ধরায় মনোযোগ দেয়। গগন আর কোনো প্রশ্ন না করে হাঁটা দেয় বাজারের দিকে। সপ্তাহে একদিন তাকে বাজার করতে হয়, আজ সেই দিন। বাকি দিনগুলোয় মামাই বাজার করে। গগন মামার সঙ্গে থাকে। মামা বলে, ‘এখন থেকেই বাজার করা শেখ, না হলে বড় হয়ে বিপদে পড়বি। যা দেখি কেমন পচা মাছ কিনতে পারিস...।’ না, পচা মাছ না, গগন এখন বুঝে গেছে ভালো তাজা মাছ কীভাবে চিনতে হয়।

বাজারে যেতে যেতে গগন ভাবে, রন্টুর কেঁচো মিসিং ব্যাপারটা নিয়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে, রাইনখালী নদীর পাশে মাছ ধরতে বসা লোকার মধ্যে কোনো একটা চিকন রহস্য আছে। গোয়েন্দাদের মধ্যে একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। তবে কি গগনের মধ্যেও এটা কাজ করতে শুরু করেছে? আর তখনই একটা ব্যাপার চিন্তা করে গগন সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে। আরে তাই তো, সে তো কখনো রাইনখালী নদীর পাড়ে বসে কখনো কাউকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখেনি। কখনোই না। সবাই জানে, রাইনখালী নদীতে মাছ নেই। তাহলে আজ কেন ওই লোকটাকে দেখল বড়শি হাতে?

আর লোকটা কেঁচো নিয়ে কথা বলাতে সন্দেহ প্রকাশ করল। লোকটা যে নিজেই কেঁচো জোগাড় করেছে, এটা মনে হয় না। কারণ, কাপড়চোপড়ে সে যথেষ্ট শৌখিন বলেই মনে হলো। নিশ্চয়ই কেউ তাকে কেঁচো এনে দিয়েছে, কে সে? সে-ই কি রন্টুর কেঁচোচোর?

বাজারে গিয়ে দেখে হুলুস্থুল কাণ্ড। বিরাট হাউকাউ...কী ব্যাপার? বাজারে নাকি একটা লোক বড় একটা তেলাপিয়া মাছ কিনেছে। তারপর মাছটা কাটাতে গিয়ে দেখে সেই মাছের পেটে একটা ছোট্ট সোনার বার । ব্যস, তারপর সেই সোনার বার নিয়ে হাউকাউ লেগে গেল। মাছওয়ালা নাকি টের পেয়ে সোনার বারটা সরিয়ে ফেলার তালে ছিল। মাছ ক্রেতা দেখে ফেলায় হাউকাউ শুরু হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত পুলিশ এল বাজারে। মাছওয়ালা-মাছ ক্রেতা দুজনকেই থানায় নিয়ে গেল, মাছের পেটের এই সোনার বার যে শেষ পর্যন্ত কার পেটে যায়—এই নিয়ে বাজারে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। আর তেলাপিয়া মাছের পেটে সোনার বার পাওয়া গেছে, এটা চাউর হওয়ায় বাজারে তেলাপিয়া মাছের দাম বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে, ১৪০ টাকার তেলাপিয়ার কেজি এখন হয়ে গেছে ৭০০ টাকা! গগন কোনোমতে ২০০ টাকায় এক কেজি কই মাছ কিনে বাসার দিকে রওনা দিল। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা চলছে।

ফেরার পথে দেখে তখনো সেই লোকটা বসে আছে। বড়শি হাতে। গগন এখন খেয়াল করল লোকটা এমনভাবে বসেছে, চট করে কেউ বুঝতে পারবে না যে সে বসে মাছ ধরছে। একটা গাছের আড়ালে প্রায় ক্যামোফ্লেজ হয়ে আছে লোকটা। গগন এগিয়ে গেল প্রায় নিঃশব্দে তারপর আস্তে করে বলল: আঙ্কেল, মাছ পেয়েছেন? লোকটা চমকে তাকাল তার দিকে। তারপর সন্দেহের চোখে বলল, ‘তুমি সেই ভ্যাজালের পাবলিক না? কেঁচোর খোঁজ করছিলা একটু আগে?’

   হ্যাঁ, এখন তো মাছের খোঁজ করছি।

   হ, পাইছি...কিছু।

   কী মাছ ধরেন, তেলাপিয়া? লোকটা আবার চমকে তাকাল গগনের দিকে। বলল, ‘ ক্যামনে বুঝলা?’

   এমনি মনে হলো।

   এই মরা নদীতে তেলাপিয়া ছাড়া আর কিছু নেই। বলে লোকটা বড়শি তুলে আবার ফেলে।

   তেলাপিয়ার পেটে সোনার বার আছে কি না, চেক করছেন? এই কথা শুনে লোকটা হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর পড়িমড়ি করে বড়শি আর মাছের ব্যাগ নিয়ে নদীর পাড়ের ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় কেঁচোর বাটিটা অবশ্য ফেলে গেল। গগন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল...মানে কী? কী হলো হঠাৎ! লোকটা এত ভয়ই-বা পেল কেন?

   এগুলো তোর কেঁচো?

   হ্যাঁ হ্যাঁ, কই পেলি?

   যেখানেই পাই, তোর কেঁচো কীভাবে বুঝলি?

   আমি সাইজ দেখে বুঝতে পারি। কারণ, সব কটির লেজ কাটা। আমিই কেটেছিলাম। কেঁচোর লেজের দিকে কাটলে দুইটা কেঁচো তৈরি হয়...একটা ছোট, একটা বড়...দেখ।

এই ঘিনঘিনে কেঁচো দেখার শখ অবশ্য গগনের মোটেই নেই। সে অনেক বড় কিছু ভাবছিল। যাকে বলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ টাইপের কিছু ...তবে সেই সাপাই বেরোলো...যেমন তেমন সাপ না অ্যানাকোন্ডা সাপ!

ঘটনাটা এ রকম: রাইনখালী নদীর ( নাকি খাল) মুখটায় একটা মাছের আড়ত। এক প্রভাবশালী লোক এর মালিক। এই আড়ত থেকে জোয়ারের সময় গভীর রাতে মাছ ছাড়া হয়। তেলাপিয়া মাছ, মাছের পেটে থাকে একটা করে সোনার বার। ব্যস, মাছ চলে যায় সোজা দেশের সীমানা পেরিয়ে এঁকেবেঁকে পাশের দেশে...নদীটা যে ওই দিকেই গেছে। অর্থাৎ, সোনা পাচারের একটা অভিনব বুদ্ধি আরকি। অবশ্য সব তেলাপিয়া মাছে নয়। তারা মাছে একটা চিহ্ন দিয়ে দেয়। সেই চিহ্ন ধরে অন্য পক্ষ সোনার বার সংগ্রহ করে। এই খবর দুদিন পর পেপারে বেরোলো ফলাও করে...‘সোনা পাচারের অভিনব পন্থা’। যেদিন পেপারে বেরোলো খবরটা, সেদিন বিকালেই অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল সবাই। শত শত লোক বড়শি নিয়ে রাইনখালী নদীতে মাছ ধরতে বসে গেছে। এর মধ্যে সেই প্রথম লোকটাকে আর খুঁজে পেল না গগন। তবে গগনের বেশ ভালো লাগল যে বিষয়টা সে আগেই সন্দেহ করেছিল সেটাই ঘটেছে এবং সে যে ভেতরে ভেতরে একজন সত্যিকারের গোয়েন্দা হয়ে উঠছে, এটা মনে করেই মনটা খুশি হয়ে উঠল। অবশ্য এই খুশি শেয়ার করার মতো কাউকে পেল না তার আশপাশে। কারণ, তার পাড়ার বন্ধুরা সবাই তখন বড়শি নিয়ে বসে গেছে রাইনখালী নদীতে তেলাপিয়া মাছ ধরতে।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন