রসট্রাম থেকে

রসট্রাম থেকে

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০০০
প্রকাশক: মাওলা বাদার্স, ঢাকা

একাত্তরের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ শুনলে এখনো যে-কারও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেতে পারে। গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপানো সেদিনের ওই ভাষণই ছিল আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অণুপ্রেরণা। এটি বারবার শুনলেও কারও ক্লান্তি আসে না। এই ভাষণ নিয়েই কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ আশির দশকে লিখেছিলেন ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের এক কবিতা।

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

কিন্তু মাত্র ৪৪ বছরে বাংলাদেশের চিত্র আমূলে বদলে গেছে। এখন আর লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা কবি বা কাঙ্ক্ষিত নেতার প্রতীক্ষায় বসে থাকে কই! এখন সবই সাজানো রাজনৈতিক নাটক বললেও ভুল বলা হয় না। ইদানীং রাজনৈতিক নেতাদের ভাষণে এতটাই রাজনীতির গন্ধ যে তা শুনতে গেলে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হবে যে-কারও। অবশ্য ওই নেতার ভক্ত-সমর্থকদের জন্য সেটি প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কিন্তু আমজনতার মতামত বা পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করেই নেতারা দিনের পর দিন বাজিয়ে চলেছেন সেই একই ভাঙা রেকর্ড। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে (নাকি অপব্যবহারে) সেগুলো দুই কান ভরে শুনতে হচ্ছে সবাইকে। এই যখন দেশের অবস্থা, তখনো কারও কারও কথা বা ভাষণ শোনার জন্য এখনো কান পেতে থাকে হাজারো মানুষ। হাতে গোনা এমন কিছু মানুষের একজন হচ্ছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

কে না জানে, একদল শিশু-কিশোর একসঙ্গে মানেই পাখির মতো কিচিরমিচির। তাদের সবাই কিছু না কিছু বলার আছে। ফলাফল হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি। তাদের চেঁচামেচি থামানোও ভীষণ ঝক্কির ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে মঞ্চে আলোকিত মানুষের ফেরিঅলা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মানেই হলজুড়ে পিনপতন নীরবতা। কারণ, তাঁর মুখের ভাষায় আছে কাব্যের জাদু আর সহজ সাবলীল ভঙ্গি। চিন্তায় আছে সহজপাচ্য দার্শনিকতা। আছে স্বভাবসূলভ হাস্যরস আর চিন্তার অফুরন্ত খোরাক। সবচে বড় কথা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের মতো, দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানানোর কোনো মিথ্যা চেষ্টা নেই তাঁর ভাষণে। নেই চলমান পক্ষপাতসর্বস্ব রাজনীতির গন্ধও। আবার একসময় শিক্ষকতা করলেও তাঁর কথা কেতাবি উপদেশনির্ভরও নয়। তাই তাঁর কথা শ্রোতাকে ভীষণ কৌতূহলী করে, কখনো বুঁদ করে ফেলে স্বপ্নে, পরক্ষণেই প্রাণখোলা হাসি হাসতে বাধ্য করে। পাশাপাশি নতুন ভাবনার খোরাক জোগায়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে মঝেমধ্যেই মঞ্চে দাঁড়াতে হয়। এভাবে একদিন তিনি খেয়াল করে দেখলেন, মঞ্চে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেওয়া ভাষণগুলো একটু ঘষামাজা করলেই চমৎকার লেখা তৈরি হয়ে যায়। ব্যস, একে একে বেশ কিছু বক্তৃতার রেকর্ড করা ক্যাসেট সংগ্রহ করে সেগুলো লিখে ফেললেন তিনি। তারপর সেগুলো একত্র করে প্রকাশিত হলো  রসট্রাম থেকে নামের বই। এ বইয়ে ১৭টি বক্তৃতা সংগ্রহ আছে। প্রতিটিই বিষয়বস্ত্ততে বৈচিত্র্যময়। কিন্তু তার ভেতরও আলোকিত মানুষের কামনার তীব্র সুর বেজেছে প্রতিটিতেই। পড়তে গেলে মনে হবে, পাঠকের সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন আর জটিল সব বিষয়ের সঙ্গে পরিমাণমতো হাস্যরসের লিকার মিশিয়ে সহজবোধ্য করে পরিবেশন করছেন তিনি। তাই বারবার পড়েও আশ মেটে না। যারা গল্প-উপন্যাসের বাইরে একটু ভিন্নধর্মী বই পছন্দ করো, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।