উভচর মানুষ - আলেক্সান্দর বেলায়েভ

উভচর মানুষ

আলেক্সান্দর বেলায়েভ

প্রথম প্রকাশ: ১৯২৮ সাল, রাশিয়া

ভাষা: বাংলা

১৯১৪ সালে ৩০ বছর বয়েসী আলেক্সান্দর বেলায়েভ কঠিন অসুখে পড়লেন। যক্ষ্মা। সেকালে যার আরেক নাম রাজরোগ। এ রোগের টিকা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই’ শব্দবন্ধটি হয়ে উঠেছিল প্রবাদের মতো। চিকিৎসা নিলেও খুব বেশি লাভ হলো না। ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ল সংক্রমণ। প্যারালাইসিসে চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় স্থানু হয়ে গেলেন তিনি।

ঠিক এ সময় স্বার্থপরের মতো বেলায়েভকে স্রেফ একা ফেলে চলে গেলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী। বাধ্য হয়ে ক্রিমিয়ার আল্টায় মা আর নানির আশ্রয়ে গেলেন বেলায়েভ। আবারও চিকিৎসা শুরু হলো। তবে তখনো বিছানায় বন্দী জীবন। অথচ ছোটবেলায় তিনিই কি না জুল ভার্নের বই পড়ে কল্পনায় ঘুরে বেড়াতেন বিশ্বময়। স্বপ্ন দেখতেন পাখির মতো ওড়ার। সে স্বপ্নপূরণে একবার বোকার মতো বিশাল ছাতা নিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলেন। আরেকবার বোকামির মাত্রা বাড়িয়ে কাগজের প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দিয়েছিলেন ছাদ থেকে। স্বভাবতই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে। অবশ্য এবার সময় কাটাতে হাসপাতালে শুয়ে তিনি আবারও গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগলেন জুল ভার্ন। সেই সঙ্গে এইচ জি ওয়েলসসহ নামকরা লেখকদের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। কল্পরাজ্যে আবারও পাখির মতো উড়তে লাগলেন তিনি। টুকটাক লিখতেও লাগলেন। অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন একাধারে আইনজীবী, সাংবাদিক। কিন্তু আইন পেশা ছেড়েছিলেন শুধু লেখক হওয়ার জন্য। হাসপাতালে শুয়ে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, তিনি ঠিক কী ধরনের লেখা লিখবেন।

টানা ছয় বছর অসুখে ভুগে সবাইকে অবাক করে সুস্থ হলেন বেলায়েভ। রীতিমতো হাঁটতেও পারলেন। কিন্তু তখন তিনি আপাদমস্তক বেকার। মাথায় লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজের খোঁজে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন। পেলেনও কিছু কিছু। একবার পুলিশ হন তো আরেকবার লাইব্রেরিয়ান, তো তার পরের বার ডাক অফিসের সহকারী। কিন্তু কোনোটাইতেই থিতু হতে পারলেন না। কোথাও মন ভরে না। এদিকে পৈতৃক-পেট চালানোও কঠিন হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে ১৯২৩ সালে মস্কো ফিরে পুরোনো আইন পেশা শুরু করলেন বেলায়েভ। অবশ্য লেখক হওয়ার আশা ছাড়লেন না। সে স্বপ্নপূরণে প্রতিদিন লিখতেও লাগলেন।

দুবছর বাদেই শেষ করে ফেললেন তাঁর প্রথম উপন্যাস  প্রফেসর ডোয়েল’স হেড । মানবিক বোধসমপন্ন নতুন ধরনের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পেয়ে লুফে নিল রুশ পাঠকেরা। কিন্তু চমক আরও বাকি ছিল, সে কথা জানত না কেউই। তিন বছর বাদেই প্রকাশিত হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘চেলোভেক অ্যামফিবিয়া’। ওহ, সরি, ভুলেই গিয়েছিলাম, তোমরা তো রুশ ভাষা জানো না। বইটির ইংরেজি নাম: অ্যামফিবিয়ান ম্যান; বাংলায় উভচর মানুষ। ব্যস! রাতারাতি বিশ্ব আসনে ঠাঁই পেলেন আলেক্সান্দর বেলায়েভ। অনেকে তাঁকে ডাকতে লাগলেন রাশিয়ার জুল ভার্ন হিসেবে।

উভচর মানুষ প্রকাশের প্রায় এক দশক পরে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়ায় আগ্রাসন চালাল জার্মান নেতা হিটলারের নাৎসি বাহিনী। তার আগেই মস্কো ছেড়ে রাশিয়ার লেলিনগ্রাদের ছোট্ট শহর পুশকিনে থাকতে শুরু করেছিলেন বেলায়েভ। সে শহরটিও দখল নিয়েছিল নাৎসিরা। নাৎসিদের নির্দেশে সবাই শহর থেকে চলে গেলেও গুটি কয়েকজনের মতো শহর ছাড়তে অস্বীকার করেন বেলায়েভ। পরিণতিতে অবরোধে তাঁকে অনাহারে কাটাতে হয় দীর্ঘকাল। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সেখানেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বেলায়েভ। দিনটি ছিল ১৯৪২ সালের ৬ জানুয়ারি।

তবে বেলায়েভের সৌভাগ্যই বলতে হবে, অন্য অনেকের মতো তাঁকে অসহায়ভাবে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হতে হয়নি। কারণ, বাঁচার জন্য নূ্যনতম খাবার না দিলেও তাঁর মৃতদেহ সৎকারে এগিয়ে আসেন জার্মান বাহিনীর এক সেনা কর্মকর্তা। বেলায়েভকে ধর্মীয় রীতিতে কবর দেন তিনি। যতদূর জানা যায়, তাঁর এ উদারতার পেছনে ছিল একটিই কারণ। সেটি হচ্ছে, ওই নাৎসি কর্মকর্তা ছোট্টবেলায় জার্মান অনুবাদে পড়েছিলেন উভচর মানুষসহ বেলায়েভের বেশ কিছু বই। কৈশোরে পাওয়া সেই অলৌকিক আনন্দের কথা তিনি ভোলেননি যুদ্ধক্ষেত্রেও। প্রতিদানে শত্রুপক্ষের হলেও প্রিয় লেখকের প্রতি ছোট্ট এ সম্মান দেখিয়ে ঋণ শোধ করেছিলেন ওই জার্মান সেনা।

এই হলো রুশ লেখক আলেক্সান্দর বেলায়েভের ৫৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন-মানিকের খানিক গল্প। তাকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেওয়া উভচর মানুষের গল্পটি আরও বর্ণাঢ্য, গতিময় আর মানবিক। সারা জীবন মনে রাখার মতো। সে গল্পটি জানতে চাইলে বইটি পড়তেই হবে। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে বইটির বাংলা অনুবাদ।